Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story

‘গহন অরণ্যে’ অত্যন্ত সফল নাটক, ছায়া অবলম্বনে কেন? লিখেছেন আশিস ভৌমিক

//আশিস ভৌমিক//

Rananuj

বছরে অন্তত একটি নাটক লেখা কি চাট্টিখানি কথা ! এই অঞ্চলে চিত্রভানু ভৌমিক ছাড়া আর কেউ তা পারেননি। এ তাঁর বড় কীর্তি। আর লিখেই তো চিত্রভানুর (ওরফে ঝুমুর) দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তিনি একে মঞ্চস্থ করার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
দশরূপক সাংস্কৃতিক সংস্থার সর্বশেষ প্রযোজনা ‘গহন অরণ্যে’ তাঁরই লেখা, তাঁরই নির্দেশনা। তিনি তাতে অভিনয়ও করেছেন। ‘গহন অরণ্যে’ এই পূর্ণাঙ্গ নাটকটি মহাকবি উইলিয়ম শেক্সপিয়রের কালজয়ী নাটক ‘ম্যাকবেথ’-এর ছায়া অবলম্বনে রচিত। এখানে ‘ম্যাকবেথ’-এর ভাবনাটা রয়েছে, গল্পটা আলাদা। উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটা মানুষকে কোন অধঃপতনে নিয়ে যেতে পারে, এটা যেমন ‘ম্যাকবেথ’-এর মূল কথা, ‘গহন অরণ্যে’-তেও সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন নাট্য সংগঠন ‘ম্যাকবেথ’ নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে। নানা ভাষা বা নানা আঙ্গিকে করলেও তাঁরা ‘ম্যাকবেথ’ই করেছেন। শেক্সপিয়র যেখানে শেষ করেছেন, তাদের নাটকও সেখানেই শেষ হয়েছে। ‘গহন অরণ্যে’ নাটকের শেষপ্রান্তে আঙুল তোলা হয়েছে, এর পর তাহলে কী।
এখানেই আমার দুটি প্রশ্ন। ‘ম্যাকবেথ’কে বদলানোর ক্ষমতা কি রয়েছে আমাদের? হিংস্রতা মাত্রা ছাড়ালে মানুষ স্ত্রী, সন্তানকেও বিশ্বাস করে না। এ টুকু পর্যন্ত ঠিকই আছে। পরবর্তী প্রজন্মের কথা না টানলে কি কোনও সমস্যা হচ্ছিল? এ ভাবে না টানলেও তো ‘গহন অরণ্যে’ বেশ দাঁড়িয়েছিল। একে ছাড়াও তো পুরো বোঝা যাচ্ছিল। আমি তো বলব, ‘গহন অরণ্যে’ অত্যন্ত সফল নাটক। এখানে ছায়া অবলম্বনের কোনও প্রয়োজন ছিল না।


বরাক উপত্যকা এবং এর আশপাশ অঞ্চলের কালো সাম্রাজ্য যে এক সুতোয় বাঁধা, তা যথার্থই তুলে ধরা হয়েছে নাটকটিতে। এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস সার্থক হয়েছে। এই ব্যাপারগুলির মধ্যে ‘ম্যাকবেথ’-এর মিল খুঁজে পেয়েছি বটে, কিন্তু তাই বলে ‘ম্যাকবেথ’-কে ভিত্তি করার প্রয়োজন ছিল না। শয়তানদের অংশটা ‘ম্যাকবেথ’ থেকে নেওয়া হয়েছে, বোঝা যায়। পাশাপাশি মনে হয়েছে, নাটককে দীর্ঘায়িত করার জন্য এই ধরনের কিছু দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। এগুলি না থাকলেই বরং ভাল ছিল।
আমি এই নাটকে ‘ম্যাকবেথ’-কে খুঁজে পাই বটে, কিন্তু এর ছায়ার চেয়ে বেশি পাই আমাদের চিত্রভানু ভৌমিকের নাটক। এ এক শক্তিশালী দীর্ঘ পূর্ণাঙ্গ নাটক। এই নাটক আমাদের সমৃদ্ধ করল। আমরা চাই, চিত্রভানুর হাত ধরে এমন নাটক আরও আসুক।

বাচ্চু ও মাইকেলের চরিত্রে অভিনয় আবার প্রমাণ করে, শুভ্রেন্দু চক্রবর্তী আরও পরিণত হয়েছেন। ওস্তাদ ও জিন চরিত্রে জয়ন্তবিকাশ পুরকায়স্থ ও অশোক সিনহা রাজকুমার যথাযথ চরিত্রায়ণ হয়েছে। কাশী বিশ্বনাথ দাস বিজয়ের অভিনয়ে তাঁর জাত চিনিয়েছেন। সৃজয় চক্রবর্তী (বলাই), চিন্ময় চক্রবর্তী (পুরুত ঠাকুর), বলরাম দে (জলিল) মঞ্চ দাপিয়ে অভিনয় করেছেন। বিধানভাই চরিত্রে চিত্রভানু এক নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কৃত হলেন। আয়ূষ কর্মকার (কানাই), শুভ চক্রবর্তী (লোকটি ও ঘাতক), আশুতোষ ভট্টাচার্য (ঝুনু) সবাই ভাল করার চেষ্টা করেছেন। বৃদ্ধ ও সাধন চরিত্রে সন্তোষ চক্রবর্তী ব্যতিক্রমী। শিবায়ণ দেবরায় (ডাক্তার) ও প্রদীপ পাল (শঙ্কর) যথাযথ। অর্কজ্যোতি ভট্টাচার্য (রুবেল ও জিন) এবং বিনায়ক ভট্টাচার্য (সহকারী) চরিত্রের দাবি মেটাতে মোটামুটি সক্ষম হয়েছেন। শীতল চরিত্রে ড. স্বপন দাস শুরুর দিকে অত্যন্ত কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। তবে দাম্ভিক ও চরম হিংস্র শীতলকে আরও সাবলীল অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলার সুযোগ ছিল। আসলে ভালোর তো শেষ নেই।  স্বপনের মতো শক্তিশালী অভিনেতা বলে প্রত্যাশাটাও অনেক বেশি।


মিতালী রাজকুমার (বাসন্তী), এনাক্ষী রায় (কাজের মেয়ে ও বস্তিবাসী), পীযূষ দেবনাথ (ছেলেটা), হৃত্বিকা দে (বস্তিবাসী), শুভম পাল (বস্তিবাসী), দিব্যেন্দু চক্রবর্তী (নিত্য) সবাই মোটামুটি ভালো। মিতালি রাজকুমারের অভিনয়ে মাতৃস্নেহের জায়গাটা প্রবলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
এই নাটকে সবাইকে ছাপিয়ে যার অভিনয়, তিনি নয়না চৌধুরী। কণিকা চরিত্রে শক্তিশালী অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি প্রত্যাহ্বান ছুঁড়ে দিয়েছেন। গোটা টিমের পোশাক পরিকল্পনার দায়িত্বেও নয়না সাধুবাদযোগ্য।


শব্দে বিপ্রজিত ভট্টাচার্য ও (সহায়তায়) কাশী বিশ্বনাথ দাস ভালোই। তবে আবহসঙ্গীত একটু চড়া মনে হয়েছে। আলোয় দেবজ্যোতি রায় ভালো কাজ করেছেন। কিন্তু দৃশ্যকে জীবন্ত করতে গিয়ে কখনও মঞ্চকে কিছুটা অন্ধকার মনে হয়েছে। শম্পা পালের মঞ্চ পরিকল্পনা এককথায় ভালো। মঞ্চকে সঠিক মাত্রায় পৌঁছানোর জন্য উত্তম ঘোষ, অশোক সিনহা রাজকুমার, কাশী বিশ্বনাথ দাস ও চিত্রাঙ্কনা ভৌমিক প্রশংসার দাবি রাখেন। অভীক সেনগুপ্ত ও তাঁর সহযোগী দীপক নাথ ও মিশমিতা নাথ সমাজপতি রূপসজ্জায় যে ভাবে চরিত্রকে জীবন্ত করেছেন, তার জন্য তাঁদের সাধুবাদ। দীর্ঘদিন পর দশরূপকের এই প্রযোজনাকে আমি স্যালুট জানাই। গোটা নাটকের বুনন, চরিত্র চিত্রায়ণ, আলো-শব্দ সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের যে জায়গাটা পরিচালক ধরে রেখেছেন, চিত্রভানু ভৌমিককে সেজন্য কুর্নিশ জানাই।
রবিবার বঙ্গভবন প্রেক্ষাগৃহে গিয়েই মনে পড়ে গেল, গণসুরের ‘গোপী গাইন বাঘা বাইন’ নাটকের হলভর্তি এবং বাইরে অপেক্ষারত দর্শকের কথা। দশরূপকের ‘গহন অরণ্যে’ নাটকেও দর্শক উপস্থিতি ছিল অনেকটা সেই রকমের। আসলে দর্শক চায় ভালো নাটক। দশরূপক এই ব্যাপারে সার্থক। আগামীদিনে আরও ভালো প্রযোজনার আশা রইল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker