Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
কোথাও উপস্থিত হলে শিবতপন বসুই থাকতেন আকর্ষণের কেন্দ্রে, লিখেছেন এইচ এম আমির হোসেন
//এইচ এম আমির হোসেন//
দুই বছর চলে গেল। ড. শিবতপন বসু আমাদের মধ্যে নেই। তবে তিনি অমর হয়ে আছেন বরাকের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এবং প্রতিটি সামাজিক সংস্থা, প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে৷ বছরের প্রায় প্রতিটি দিন নানা অনুষ্ঠানে তাঁর প্রসঙ্গ উঠে আসে। এভাবেই তিনি চিরকাল এই অঞ্চলের সকলের মনে বিরাজমান থাকবেন।
আমাদের বরাক উপত্যকা সর্বধর্ম সমন্বয় সভার প্রধান আকর্ষণ ছিলেন অধ্যাপক ড. শিবতপন বসু। অত্যন্ত আকর্ষণীয় বক্তব্য রাখতেন৷ আবার সময়ের প্রতি বড় যত্নশীল ছিলেন।
২০১৩ সালের ১০ নভেম্বর করিমগঞ্জ জেলার কানাইবাজারে একটি সম্মেলন থেকে শিবতপন স্যারের সঙ্গে সংস্থার সম্পর্ক। এর পরই তিনি সংস্থার সমস্ত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৮ সালের ১৩ জানুয়ারি দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ড. বসুকে সংস্থার কেন্দ্রীয় সভাপতি মনোনীত করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে নতুন উদ্যেম পায় সংস্থা, গ্রহণ করা হয় ব্যতিক্রমধর্মী নানা কর্মপ্রয়াস। ওই বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের সরকারি অনুষ্ঠানে ‘চিফ মিনিস্টারস স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড’ পায় সর্বধর্ম সমন্বয় সভা। স্যার নিজে উপস্থিত হয়ে অ্যাওয়ার্ডটি গ্রহণ করেন।
ড. শিবতপন বসুকে ঘিরে বহু স্মৃতি এখনও আমার মনে জ্বলজ্বল করছে। প্রতিটিই শিক্ষণীয়। ২০১৪-র ১৭ জানুয়ারি আমার প্রতিষ্ঠিত কানাইবাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসার নতুন ভবনের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে তিনি সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। শিলান্যাসের ঠিক প্রাককালে এক দুষ্টচক্র অনুষ্ঠানে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছিল। কিছু সময় পর তিনি তাঁর বক্তব্যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে স্বার্থান্বেষী লবিকে একেবারে লেজেগোবরে করে দিয়েছিলেন। আমার মনে পড়ছে ২০১৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর নিলামবাজার গুণময়ী গার্লস হাইস্কুলে সর্বধর্মীয় সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানে তিনি গিয়েছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে করিমগঞ্জ রামকৃষ্ণ মিশনের অধ্যক্ষ স্বামী প্রভাসানন্দ মহারাজও উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে প্রকৃতি বেঁকে বসলো। আকাশে মেঘের ঘনঘটা।মহারাজ তাঁর গাড়িতে ওঠার জন্য ড. বসুকে ডাকলেন। তিনি গেলেন না। এরই মধ্যে ধুলোঝড় শুরু হয়ে গেল। কোনও গাড়ি আসছে না। পরে কালাম নামে এক শিক্ষক নিজের বাইকে করে তাঁকে করিমগঞ্জ পৌঁছে দিলেন। ড. বসু কোনও দ্বিধা না করে মাথায় রুমাল বেঁধে বাইকের পেছনে বসে যাত্রা করলেন।
তাঁর বহু বক্তৃতা শোনার ভাগ্য আমার হয়েছিল। এখনও কানে বাজে ২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারির সেই ভাষণ। বদরপুর খতমে বুখারী অনুষ্ঠানে ‘মাওলানা আব্দুল জলিল চৌধুরী মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড’ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এর পর সর্বধর্ম সমন্বয় ও সম্প্রীতির বিষয়ে কী যে বক্তৃতা রেখেছিলেন! হাজার হাজার মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছিলেন।
ওই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর ফকিরবাজার কলেজ ও এমকে গান্ধী কলেজে সংস্থার নির্ধারিত অনুষ্ঠান ছিল। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে তিনি সংস্থার মাইজডিহি কার্যালয়ের গেটের কড়া নাড়লেন। সেদিন কার্যালয়ে নিরামিষ ভোজের ব্যবস্থা ছিল। এক টেবিলে আমরা সবাই খেতে বসেছিলাম। খেতে খেতে বললেন, ‘আমি দুপুরবেলা ভাত খাই না। তোমরা বললে বলে খেয়ে নিলাম।’
২১ অক্টোবর (২০১৭) হাইলাকান্দি রবীন্দ্র ভবনে শান্তি, সম্প্রীতি ও ঐক্যের বিষয় নিয়ে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ড° বসু ছিলেন প্রধান বক্তা। আমি আমন্ত্রিত অতিথি। সমাবেশ শেষে এক সঙ্গে ফেরার কথা ছিল, কিন্তু তাঁকে আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফোনেও সংযোগ করা সম্ভব হচ্ছিল না। অনেক সময় ধরে না পেয়ে আমি চলে আসি। এর পর সপ্তাহখানেক তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়নি। একদিন ফোন করলাম। বললেন, ‘সেদিন হাইলাকান্দিতে ফোনটা ভুলে ফেলে এসেছিলাম। আয়োজক কমিটির একজন বললেন, ফোনটা পাওয়া গেছে, পৌঁছে দেবেন। কিন্তু কেউ ফোনটি নিয়ে এল না। শেষে তিনি নিজে গিয়ে হাইলাকান্দি থেকে ফোনটি নিয়ে আসেন।
২০১৮ সনের ১১ নভেম্বর জাতীয় শিক্ষা দিবস উপলক্ষে প্রেড ফাউন্ডেশন কর্তৃক আয়োজিত কাঁঠালতলীতে একটি অনুষ্ঠানে আমরা অংশগ্রহণ করি। শিবতপন বসু ছিলেন প্রধান অতিথি। ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ আমাকে মঞ্চে সুযোগ দেয়নি। বিষয়টা তাঁর নজরে পড়ে। প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান দিতে তিনি মাইকে প্রথম বাক্যটি বললেন, ‘আমি আপনাদের সঙ্গে একটা ছেলের পরিচয় করিয়ে দেব। না হলে আমার উপর কৃপণতার দায় বর্তাবে। আমির হোসেন এখানে এসো’, মাইকে ঘোষণা দিয়ে আমাকে কাছে নিলেন। আমার কাঁধে তাঁর ডান হাত রেখে শ্রোতাদের উদ্দেশে বললেন, ‘এই ছেলেটার নাম এইচ এম আমির হোসেন। ছেলেটাকে চিনে রাখবেন সবাই। দোয়া-আশীর্বাদ দেবেন। সমাজে ব্যতিক্রমী কিছু কাজ করার চেষ্টা করছে।’ জানি না, স্নেহবশত স্যার কতটা বাড়িয়ে বললেন । কিন্তু সেদিন আমার মনে হয়েছিল, এর চেয়ে বড় কিছু প্রাপ্য থাকতে পারে না।
ড. শিবতপন বসুর প্রয়াণে আমরা শোকাহত-মর্মাহত। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গুয়াহাটি যাওয়ার পথে সংস্থার কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে সইয়ের জন্য তাঁর শেষ সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। অন্যদিন তাঁর বাড়িতে গেলে বাইরের কোঠায় বসেই কথাবার্তা হতো। সেদিন তিনি আমাকে নিয়ে একেবারে ভেতরের কোঠায় বসালেন। একান্তে কথা হচ্ছিল, উঠতে দিচ্ছিলেন না। প্রয়াত ড. কামালুদ্দীন আহমদের প্রসঙ্গ টেনে বলছিলেন, “কামালুদ্দীন সাহেব আর আমি সমসাময়িক। দীর্ঘদিন এক সঙ্গে কাজ করেছি। উনি চিরদিনের জন্য শান্তির জগতে পাড়ি দিয়েছেন। আমারও বড় রোগ ধরা পড়েছে। কোন সময় কী হবে বলা যায় না।”
১৮ ফেব্রুয়ারি রাতে সংস্থার সদস্যা ঝুমা দাসের কাছ থেকে তাঁর গুরুতর অসুস্থতার খবর শুনি। পরের দিন সকালেই গুয়াহাটি থেকে শিলচর চলে আসি। জানতে পারি, স্যারকে শিলং নিগ্রিমসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিছুদিন পরে তিনি বদরপুরের বাড়িতে ফিরে আসেন। স্বস্তিবোধ করছিলাম। কিন্তু ৫ মার্চ দুপুরে কাঁঠালতলীর একজন সাংবাদিক জানালেন, ড. শিবতপন বসু আর নেই । বিশ্বাস হচ্ছিল না। অন্যান্যদের কাছ থেকে জানলাম, এটাই সত্য। এ আমার জীবনে বড় এক আঘাত। তিনি যে আমার প্রকৃত অভিভাবক ছিলেন।
(লেখক এইচ এম আমির হোসেন বরাক উপত্যকা সর্বধর্ম সমন্বয় সভার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক)