Barak UpdatesHappeningsBreaking News

কেতাব-ছুট একটা প্রজন্মের আত্মপ্রকাশ ঘটছে, বলছেন সঞ্জীব দেবলস্কর

//সঞ্জীব দেবলস্কর//

বরাক উপত্যকার প্রান্তিক এই শহরটিকে এই মুহূর্তে কী নামে সম্বোধন করব স্থির করতে পারছি না। আমার সঙ্গে এর সম্পর্ক যে ২০২৪ সালের ২২ নভেম্বরের আগেকার। এর পেছনে রয়েছে এক অনন্ত অতীত, আবহমান বাংলার সঙ্গে বিলগ্ন সম্প্রসারিত এ বঙ্গভূমির সঙ্গে নিবিড় ভাবে বিযুক্ত কুশিয়ারার তীরে এই খণ্ডিত জেলা-শহর যে আমার প্রাণের গভীরে লুকিয়ে থাকা আরেক রূপসী বাংলা, যাকে কোনও রাষ্ট্রনৈতিক মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ যেন সেই আইরিশ কবির জলবেষ্টিত ‘লেক আইল অব ইনিসফ্রি’, যার অস্তিত্ব আমাদের রক্তের গভীরে, আমাদের চেতনার গভীরে। এই কল্পলোকের এক টুকরো বঙ্গভূমির সঙ্গে মিশে আছে হরিকেল-সমতট-নিধনপুর-কালাপুর-ভাটেরার ঐতিহ্য, যেখানে রয়েছে শুষ্ককৌশিকা, গঙ্গিনিকা, আর বৃহজ্জট্টলি পরিবৃত্ত হাজার বছরের আম্রবনশোভিত এক ধুসর নিসর্গ।
এ নিসর্গের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গড়ে দিয়েছেন মহাকাব্যোপম ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থের রচয়িতা মৈনা গ্রামের অচ্যুতচরণ তত্ত্বনিধি, হারানো দিন হারানো মানুষের প্রত্নঅস্তিত্ত্ব সন্ধানী ‘শ্রীহট্ট-কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস’কার সুজিৎ চৌধুরী।
বইমেলা প্রাঙ্গণে এইসব লোকের কথাই কিছু বলি, যাদের সঙ্গে আমাদের রক্তের নয়, আমাদের সম্পর্ক বইয়ের, সম্পর্ক আমাদের প্রাণপ্রিয় বর্ণমালার সঙ্গে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের বিপুল হট্টরোলের মধ্যেও আজকের পৃথিবীতে যে বইই মানুষের সঙ্গে মানুষের হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ককে ধরে রাখতে পারে এ তো বলা’ই বাহুল্য। প্রচণ্ড গর্জনে অগ্রসরমান দুর্দিনে একমাত্র বইকে আঁকড়ে ধরেই মানুষ অন্ধকার পেরিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে যেতে পারবে।
বইপত্রকেই জীবনের ধ্রুবতারা জ্ঞান করে সারস্বত চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ এই শহরের গ্রন্থপ্রেমীদের হিসেব নিকেশ করতে যদি বসি তবে প্রথমে যার নামটি উচ্চারণ করতে হয় তিনি আমাদের সৈয়দকূলোদ্ভব সিকন্দর আলীর রবীন্দ্রস্নেহধন্য পুত্র সৈয়দ মুজতবা আলী, যার একটি উক্তি আমাকে সততই উদ্বেলিত করে—‘জনগণ যদি পুস্তকের সম্মান করতে না শেখে তবে তারা দেবভ্রষ্ট হবে।’ জব্বর বলেছেন সৈয়দ সাহেবের ব্যাটা। গ্রন্থপাঠের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে তিনি নসিপুরের কবি ওমর খৈয়াম কল্পিত বেহেস্তের ফিরিস্তি দিয়ে মদ্য মাংস আর সংগীতের সঙ্গে একখানা ‘কেতাব’ এর সংস্থান রাখতে ভুলেননি—‘সেই নিরালা পাতায় ঘেরা বনের ধারে শীতল ছায় খাদ্য কিছু পেয়ালা হাতে ছন্দ গেঁথে দিনটি যায়।’ বাংলার কান্তি ঘোষ পারসি পঙক্তিটি ভাষান্তরিত করে বলেছেন ‘সেই তো সখি স্বর্গ আমার, সেই বনানী স্বর্গপুর।’ পুস্তক বিহীন স্বর্গের কথা কবি ভাবতেই পারেননি। আর, ইংলন্ডের এডোয়ার্ড ফিট্জিরাল্ডের তরজমায় খৈয়াম কল্পিত স্বর্গের উপাচার হিসেবে a flask wine এর সঙ্গে a book of verseও স্থান পেয়েছে। সম্মানিত শ্রোতারা মাফ করবেন, চারিদিকে বইয়ের অরণ্যে এসে যদি একটু কাব্যিই না করলাম তবে মেলায় আসাটাই বৃথা।
মুজতবা আলী সব দিক ব্যালেন্স করেই তার নিবন্ধ ‘বই কেনা’য় বইয়ের কেচ্ছাটি ফেঁদেছেন। কোরানের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন—‘আল্লাম্মা বিন কলমি, অর্থাৎ কলমের মাধ্যমে, (বর্তমান প্রসঙ্গে পুস্তক আরকি) আল্লা জ্ঞান বিতরণ করেছেন। একই সুরে তিনি বাইবেলকে স্মরণ করে বলেছেন এ গ্রন্থটি আক্ষরিক অর্থই হল Book per excellence, অর্থাৎ সর্বশ্রেষ্ঠ পুস্তক। অবশ্য বইয়ের মাহাত্ম্য কীর্তনে সৈয়দের ব্যাটা ‘সর্ববিঘ্ন বিনাশায়, সর্বকল্যাণহেতবে’ আমাদের দেবতা-লেখক গণপতিকে টেনে এনেছেন, তিনি যে স্বহস্তে আমাদের বৃহত্তম গ্রন্থটি লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন।
এক্ষণে মুজতবা আলীর দোহাই দিয়ে বইমেলা আয়োজকদের বলি আপনাদের আর দেবভ্রষ্ট হবার ভয় নেই। বইয়ের সমুদ্রে নিজেরা এবং সঙ্গে আমাদেরও অবগাহন করার সুযোগ আপনারা করে দিয়েছেন। বিস্তর আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি নিয়েই বইয়ের সম্ভার হাজির করেছেন খণ্ডিত বাংলার বিচ্ছিন্ন এই শহরটিতে যার মাথার উপর রয়েছে মমতাবিহীন কালস্রোতের প্রবল চাপ, যে চাপের ফলে আজ এ ভূমি ‘বাঙলার রাষ্ট্রসীমা হোতে নির্বাসিতা’ (কবিগুরু এ ভাবেই বানানটি লিখেছেন)। এই যার উপলব্ধি সেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের আরেকটি আশ্বাসের বাণীও শুনিয়েছেন, যেদিকে আমরা খুব মনোযোগী হয়ে উঠতে পারিনি–
‘ভারতী আপন পুণ্য হাতে
বাঙালির হৃদয়ের সাথে
বাঁধে তব হিয়া
সে বাঁধনে চিরদিন তরে তব কাছে
বাঙলার আশীর্বাদ গাঁথা হয়ে আছে।’
এ পঙক্তিগুলো উচ্চারণ করে কামনা করি যাঁরা অতীতে সারস্বত সাধনা করেছেন, যারা এখনও করছেন এদের এদের উপর বাঙলার (অস্যার্থে বাংলা ভাষাজননীর) আশীর্বাদ বর্ষিত হোক্। বইমেলার উদ্বোধনী আসরে দেবী সরস্বতীর বন্দনা করার সময় তাঁর সহোদরা মাতা লক্ষ্মীর প্রতি উদাসীনতা কিন্তু ধনেপ্রাণে বিপর্যয় টেনে আনতে পারে। এ অতি আবশ্যক কথাটা যাঁরা মেলায় প্রবেশ করবেন এদের কানে কানে আগাম দিয়ে রাখি।
এবার এ অবকাশে একজন বাঙালি হিসেবে আমার একটি আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে নিই। ইদানীং কেতাব-ছুট একটা প্রজন্মের আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এটা শুধু এই ঈশান বাংলা বা বাংলা ভাষার তৃতীয় ভুবনেই নয়, বাংলার প্রথম ভুবন পশ্চিমবঙ্গ, আমাদের চোখের সামনে ধর্মীয় মৌলবাদীর উত্থানে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গ, আর এদেশের ভিতরই ভাষিক-আগ্রাসনের শিকার বিহার, ঝাড়খণ্ড নিয়ে বাংলার (মাপ করবেন বাংলা ভাষার) চতুর্থ ভুবন এবং বিদেশভূমিতে ছড়িয়ে থাকা বাংলার পঞ্চম ভুবন– সর্বত্রই এই একই ব্যাধি।
বাঙালির চোখ যদি বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে সরে গিয়ে চার, পাঁচ ইঞ্চি মোবাইলের কিংবা অনুরূপ কোন ডিভাইসের মনিটরে নিবদ্ধ হয়ে থাকে, তবে মা সরস্বতী নিরতিশয় ব্যথিত হবেন—। ফলত, আমাদের সমাজটি চিন্তাশক্তি, ধীশক্তি, মানসিক ধৈর্য স্থৈর্য হারা হয়ে যাবে। কারণ সামাজিক মাধ্যমে বিস্তর সদুপদেশ থাকলেও এতে হিংসার অনুশীলন আর মগজ-ধোলাই ডিটারজেন্টের পরিমাণ যথেষ্টের চাইতেই বেশি থাকে, এবং যতই শান্তিবারি ঢালা হোক না কেন এর ফেনা অত সহজে মোছা যায় না।
মোদ্দা কথা হল গ্রন্থ-ছুট আজকের প্রজন্মের কাছে সুস্থ মানবিক বার্তা পৌঁছানোর রাস্তাগুলো ক্রমে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। খবরকাগজ, মুদ্রিত-ম্যাগাজিনের পাঠক কমে যাচ্ছে। বাঙালি বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আর মুদ্রিত অক্ষর নিয়ে বসলেও একটি গোটা পৃষ্ঠা গদ্য পড়ার ধৈর্য-হারা হয়ে যাচ্ছে। ভিন্নতর আকর্ষণ যে অপ্রতিরুদ্ধ। প্রতিনিয়ত মোবাইলে মোবাইলে ফরোয়ার্ডেড ম্যাসেজের কাছে বাঙালির আজ অসহায় আত্মসমর্পণ। এইসব বার্তা বন্ধুকে শত্রু আর শত্রুকে বন্ধু বানাচ্ছে। এরই ফলে সর্বত্রই আজ চলছে হিংসার অনুশীলন। একটু স্থির মস্তিষ্কে নিজেদের অসহায়ত্ব নিয়ে ভাবনার অবকাশ বাঙালির আর কোথায়!
আমার প্রার্থনা হোক্ ঈশ্বর বাঙালিকে আর যাই করুন না কেন, যেন কেতাব-ছুট করেন না। আমাদের ঘরে ঘরে আর কিছু না হোক কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলি’ বা ‘গীতবিতান’, জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’ আর নজরুল ইসলামের একখণ্ড ‘সঞ্চিতা’ থাকুক। আমাদের ঠাকুরঘরে যেমন শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন মাখা কাপড় দিয়ে মোড়া ধর্মগ্রন্থ নিরাপদে ঘুমিয়ে থাকে, মুসলিমদের ঘরে জমজমের জল দিয়ে শোধন করা কাপড়ের আচ্ছাদনে থাকে কোরান তফসির, কিংবা খ্রিস্টান পরিবারে থাকে জর্ডন নদীর জলের ছিটে দিয়ে শোধন করা পবিত্র সুসমাচার, তেমনিই না হয় কালেভদ্রে ছুঁয়ে দেখার জন্যই আমাদের ঘরে থাকুক এক খণ্ড নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’, বঙ্গিমবাবুর প্রবন্ধ, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’, বিবেকানন্দের ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’, ‘কলম্ব থেকে আলমোড়া’ (বক্তৃতামালা), সুনীতি চট্টপাধ্যায়ের ‘ভাষাতত্ত্ব’, ‘বাঙালির সংস্কৃতি’, কিংবা উপেন গুহের ‘কাছাড়ের ইতিবৃত্ত’, এবং দিলীপকান্তি লস্করের ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’। এ প্রসঙ্গে আরও একবার মুজতবা আলীকে উদ্ধার করি ‘অত কাঁচা পয়সা কোথায় বাওয়া, বই কিনে ঘর ভর্তি করব?’ উত্তরটা অবশ্য তিনিই দিয়ে বলেছেন বই কিনে কোনও মানুষ গরীব হয়েছে এরকম কথা কেউ কোনদিন শোনেনি।
তাই বলি আজই একখানা বই কিনে নিয়ে যান। এক্ষুনি পড়তে হবে না। আপাতত ঘরেই হোক এর অধিষ্ঠান, মাঝে মাঝে ধুলি ঝাড়লেও চলব। সামান্য ধুলিকণিকা গায়ে লাগলেই আমরা বর্তে যাই। অধমের প্রগলভতা মার্জনা করলে বলি, ঘরের এক কোণায় আবগারি দ্রব্য লুকিয়ে রাখলে বংশের কোনও না কোনও গুণধরের নেশাসক্তি হয়ে যায়ই। আর বইয়ের নেশা কিন্তু আরও বড় নেশা, এ নেশায় কোন মাতলামো নেই, পাগলামো কিঞ্চিত থাকলেও থাকতে পারে, তবে আখেরে এতে লাভ বই লোকসান নেই।
কুশিয়ারার তীরে আমার স্বপ্নের এই ইনিসফ্রি বা রূপসী বাংলায় একদা দাপটের সঙ্গে ফিরেছেন সারস্বত সাধক কেতাবী অশোকবিজয় রাহা, সুধীর সেন, বিধু চৌধুরী, কুমুদরঞ্জন গুহ, প্রমেশ ভট্টাচার্য, সুজিৎ চৌধুরী, কামালুদ্দিন আহমেদ, সুবীর কর, সুশান্তকৃষ্ণ দাস, ভূপেন্দ্রকুমার সিংহ, চন্দ্রজ্যোতি ভট্টাচার্য, নলিনীকান্ত দাস, মিলনশশী মজুমদার, নৃপতিরঞ্জন চৌধুরী, মতীন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, দীপ্তি ভট্টাচার্য, আব্দুল বাসিত চৌধুরী, মনোজিৎ দাস, খালেদ চৌধুরী, সুকেশ বিশ্বাস, রথীন্দ্র ভট্টাচার্য। এখনও সক্রিয় আছেন নিশীথরঞ্জন দাস, জন্মজিৎ রায়, বাণীপ্রসন্ন মিশ্র (প্রবাসী), সতু রায়, আব্দুল খালিক বাঙ্গাল, সুখেন্দুশেখর দত্ত, মনোজমোহন চক্রবর্তী (প্রবাসী), অরিজিৎ চৌধুরী (প্রবাসী), বিনোদলাল চক্রবর্তী, দিলীপকান্তি লস্কর, মৃন্ময় রায়, সামান্য দূরের মালুয়া গ্রামে আছেন বদরুজ্জামান চৌধুরী। আরও অনেকেই আসতে পারেন এ তালিকায় যদি স্থান সংকুলান হয়। তবে উল্লেখ না করে পারা যাবে না এক ব্যক্তির কথা। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক (নীরব পাঠক এবং মূল্যবান গ্রন্থের অতিশয় গোপন-সংগ্রাহক) বন্ধুবর মৃন্ময়কুমার ভট্টাচার্যের সঙ্গে একদিন গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। সেখানে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ভড়কে গেলাম। দেখলাম বাংলাভাষায় প্রকাশিত সমস্ত প্রাপ্তব্য গদ্যের বইই তিনি সংগ্রহ করে রেখেছেন তাঁর নিতান্ত সাধারণ ঘর জুড়েই। সেই গ্রন্থপ্রেমী রাণাদা এখন কেমন আছেন, তাঁর বইয়ের সংগ্রহ কেমন আছে জানি না। তাছাড়াও আমার চোখের দেখা, প্রাণের গভীরে অনুভব করা এই একটুকরো রূপসী বাংলায় এমনি আরও কত অজানা নীরব গ্রন্থপ্রেমী রয়েছেন, এদের সবার উদ্দেশে বিনম্র নমস্কার জানিয়ে এবারের বইমেলার সর্বাঙ্গীন সাফল্য কামনা করে বিদায় নিই।

//এটি আসলে শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সঞ্জীব দেব লস্করের ভাষণ//

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker