Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
কাছাড়ে দুই দশভুজা মন্দির ডিমাসা-মণিপুরি-বাঙালিদের একবিন্দুতে নিয়ে আসে
ওয়েটুবরাক, ৩ অক্টোবর : রাজ আমলে ডিমাসা-মণিপুরিদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই ছিল। স্বাধীনতার পর অনুপ্রবেশ ইস্যুতে বাঙালিদের সঙ্গে উভয় জনগোষ্ঠীর একটা সন্দেহের জায়গা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কাছাড় জেলার দুই দশভুজা মন্দির ডিমাসা, মণিপুরি ও বাঙালিদের একবিন্দুতে নিয়ে আসে। ডিমাসা ও মণিপুরি উভয় জনগোষ্ঠীর মানুষ বিহাড়া এবং বড়খলার দশভুজা মন্দিরের দেবী দুর্গাকে নিজেদের বিশেষ আরাধ্যা বলে মনে করেন। আর মন্দির দুটি রয়েছে বাঙালি পুরোহিতদের তত্ত্বাবধানে। বংশ পরম্পরায় দুই বাঙালি পরিবার সেখানকার পুরোহিত।
হৈড়িম্ব (অর্থাৎ ডিমাসা) এবং মণিপুরের রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহ ঘিরে ইতিহাস চর্চা আজও অব্যাহত৷ আছে লোকশ্রুতিও। কাছাড় জেলার বিহাড়া ব্রাহ্মণগ্রামের দশভুজা মন্দিরের দুর্গাপ্রতিমাকে নিয়ে লোকশ্রুতি, মণিপুরের রাজা কাছাড় আক্রমণ করে বহু মূল্যবান সম্পদ লুট করে নিয়ে যান। সঙ্গে নেন দশভুজা মন্দিরের পিতলের মূর্তিটিও। কিন্তু সে রাতেই রাজা স্বপ্ন দেখেন, দেবী নিজে তাঁকে মন্দিরে রেখে আসার জন্য বলছেন। পরদিন তিনি হাতির পিঠে চড়ে প্রতিমা নিয়ে এসে মন্দিরে রাখেন। সে থেকে দেবী যেমন ডিমাসাদের কাছে পূজিতা, তেমনি মণিপুরিদেরও।
মাইবাং ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মিথিলেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, “এই অঞ্চলের মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া) সম্প্রদায়ের মানুষ দেবী দশভুজার নামে নতজানু। দেবীর মুখদর্শন না করে শারদীয়া দুর্গাপূজার সময় এঁদের অন্য কোনও প্রতিমার মুখদর্শন না করার প্রথা আজও বর্তমান।”
৬৯ বছর বয়সী নীরেশ চক্রবর্তী জানান, কবে কীভাবে বিহাড়ায় এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, পিতলের দেবীমূর্তিটিই বা কত পুরনো, এর কোনও ইতিহাস জানা যায়নি৷ বর্তমান পুরোহিত সন্তু চক্রবর্তী বললেন, নিত্য দেবী পূজিতা হন৷ উৎসবের দিনে রান্না করা নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয়৷
একই পূজাপদ্ধতি বড়খলা দশভুজা মন্দিরে৷ তবে এ যে ডিমাসা রাজাদের, এ নিয়ে কারও কোনও সন্দেহ নেই৷ পুরোহিত বিক্রম চৌধুরী জানান, তাঁরা ডিমাসা রাজপণ্ডিতের বংশধর৷ ডিমাসা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে নবদ্বীপ থেকে এই অষ্টধাতুর মূর্তি নিয়ে আসেন৷ তখন মাইবাঙে ছিল রাজধানী৷ রাজবাড়ির মন্দিরেই দেবীকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল৷ কাছাড় জেলার খাসপুরে রাজবাড়ি স্থানান্তরিত হলে দশভুজা মন্দির করা হয় রানিঘাটে৷ রাজপণ্ডিত গৌড়মণি চৌধুরী সপরিবারে সেখানেই থাকতেন৷ ১৯৬৭ সালে রাজপণ্ডিতের পরিবার রানিঘাট থেকে বড়খলায় চলে এলে দশভুজা দেবীকেও নিয়ে আসেন৷ বহুদিন আগেই রাজপাট চুকে গিয়েছে৷ কিন্তু দেবী রয়ে যান রাজপণ্ডিতের কাছেই৷ প্রতিমার উপরের দিকে ডানে-বামে কৃষ্ণ-বলরাম৷ ঠিক মাথার উপরে শিব৷ সঙ্গে কার্তিক-গণেশ থাকলেও লক্ষ্মী-সরস্বতীর জায়গায় রয়েছেন জয়া-বিজয়া৷ জয়ার একহাতে পদ্মকলি, অন্যহাত অভয় মুদ্রায়৷ বিজয়ার একহাতে ঘণ্টা, অন্যহাত উপরের দিকে নৃত্য মুদ্রায়৷ বিক্রম জানান, মঙ্গলচণ্ডীতে দেবী দুর্গার সন্তান হিসাবে জয়া-বিজয়ারই উল্লেখ রয়েছে৷ তবে এই অঞ্চলে আর কোথাও দশভুজার সঙ্গে জয়া-বিজয়ার পূজা হয় না৷
বিক্রম দেখান, রাজ আমলের ঘট, বলির যূপকাষ্ঠ, দা, শঙ্খ ইত্যাদি তাঁদের মন্দিরে রয়েছে৷ দুর্গাপূজার সময় প্রতিপদে রুপোর কারুকাজ করা সেই ঘটটিই বসানো হয়৷ তাঁর কথায়, রাজা গোবিন্দচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও দশভুজার পূজা বন্ধ হয়নি কোনওদিন৷ নিত্যপূজা দিয়ে গিয়েছে রাজপণ্ডিতের পরিবার৷ দুর্গোৎসব এবং মাঘীপূর্ণিমায় আয়োজন হয় উৎসবেরও৷