Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
আমাদের মেজকাকীমা রমলা দত্ত, লিখেছেন সুমিত্রা দত্ত
//সুমিত্রা দত্ত//
রমলা দত্ত, আমদের মেজকাকীমা। প্রথমে পরিচয় প্রসঙ্গ আর সম্পর্কটাকে একটু ঝালিয়ে নিতে চাই। সেখান থেকে উঠে আসবে ৭৫-৮০ বছর আগেকার সময় সমাজ আর আত্মীয়তা আন্তরিকতার স্পর্শরেণুগুলো, যা আজকের দিনে খুব সুলভ সমাচার নয়। লাখাইয়ের এই দত্তবাড়ি আমার মামীমার বাপের বাড়ি। রমলা কাকীমা আমার মামীমার মেজভাইবৌ। ছয় ভাইয়ের এক বোন আমার মামীমা। সেই অর্থে আমার রমলা মামীমা বা মেজমামীমা হবার কথা। কিন্তু হয়ে উঠলেন কাকীমা, মেজকাকীমা। বড় ভাই সুধীর চন্দ্র দত্ত শুধু আমার বড়মামু। বাকি পাঁচ ভাইয়েরা দেবব্রত, জ্ঞানব্রত, শক্তিব্রত, শান্তিব্রত, পুণ্যব্রত। এই ব্রতধারী ভাইয়েরা আমার বা আমাদের সব কাকু-মেজকাকু, সেজকাকু, ন’কাকু, ফুলকাকু, ছোটকাকু। আর তারই সূত্রধরে সব কাকীমা। শিলঙে বড়মামুদের বাড়ি আর আমাদের বাড়ি একে অন্যের গা ঘেঁসে, ওদের খাবার ঘরের আলো যেমন এসে পড়ত আমাদের বিছানাঘরের দেয়ালে, যেমন ভাইয়েদের বজ্রকণ্ঠের অট্টহাস্য আছড়ে পড়ত আমাদের ঘরে ঘরে, ঠিক তেমনি আশা, আনন্দ, ভালবাসা সব ভাবনার বাতাসও দোল খেত এক সঙ্গে দুটো বাড়িতেই। বড়মামুর বড় ছেলে স্বপন, আমাদের দাদামণি, শিলচরে দাদুর বাড়ি থেকেই পড়াশুনো করতো। দাদামণি ছুটিতে শিলং এলে আমাদের মনেও উৎসবের নৃত্য। এমনি করেই বড় হয়েছি আমরা-নন্দা, তপন, আমি। খুলুং (চয়ন) তখন খুব ছোট। এরা বড়মামুর সব ছেলেমেয়েরা। ওটাই আমাদের মামার বাড়ি। ওখানেই এই কাকু কাকীমা সম্পর্কের সূচনা পর্ব। পরবর্তী মিলনস্থল কখনো আমার মেজমামার বাড়ি, কখনো দিদিমনির বাড়ি। কখনো শিলচরের উকিলপট্রির এই দত্তবাড়িটাই। এ ভাবেই শৈশবের সম্পর্কটা বহমান ছিল। নন্দা তপনের সঙ্গে প্রবল ঝগড়া হত এই দিদিমনিকে নিয়ে। দুপক্ষেরই তর্জনি তুলে দাবি ‘আমার দিদিমনি’। দিদিমনি ওদের পিশতুতো বোন, আমার মামাতো। আমাদের মনে কখনো এই ‘তুতো’ ভাবনাটা জন্ম নেয়নি। দিদিমণি আমাদের শৈশবের বিবাদ বিন্দু, পরে মিলনবিন্দু।
মেজকাকুর যখন বিয়ে হল, তখনও হয়তো আমি স্কুলের গণ্ডিতে পা রাখিনি। বরযাত্রী গেছিলাম কী পোশাকে সেটা মনে আছে। এটাও মনে আছে ঘুমে কাদা হয়ে ফুলকাকুর কোলে চেপে বাড়ি ফিরেছিলাম। আবার এটাও মনে আছে মেজ কাকীমার আশীর্বাদে গিয়ে নিজের প্লেটের মিষ্টি সাবাড় করে মায়ের পাতের মিষ্টিটাও টুক করে তুলে নিয়ে মুখে পুড়েছিলাম। মা বাড়ি এসে আমাকে একটা ঘরে দরজা বন্ধ করে রেখেছিলেন শাস্তি হিসেবে, আমি বুঝতেই পারিনি আমার অপরাধটা কোথায়।
মেজকাকিমার বাপের বাড়ি ছিল শিলঙে৷ আমাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। মেজকাকীমার ছোট বোন বাচ্চু আমাদের বন্ধু ছিল। ওদের বাড়ির বড় উঠোনটাতে আমরা গোল্লাছুট, কবাডি, রুমালচোর, এডিম-সেডিম, নাম পাতাপাতি, গুটি খেলতাম। এই খেলার সময় মেজকাকীমা বাচ্চুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আদর করছেন, দৃশ্যটা চোখে লেগে আছে। যেন মাতৃসমা দিদি।
যে কোন ছুটিছাটা হলেই বড়মামীমা স-সন্তান শিলচর চলে আসতেন, তাঁদের মূল বাড়িতে। সেই থেকে আমার শিলচরের প্রতি একটা আগ্রহ আকর্ষণ জন্মায়। বাঞ্ছাকল্পতরু ভগবান চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে এখানে নিয়ে এলেন। তপন বলছিল, ‘স্কুল ছুটি হলেই আমরা শিলচর চলে আসতাম, মেজকাকীমাকে কখনো বিশ্রাম নিতে দেখিনি। দিবারাত্র কাজ করছেন। মাঝরাতে উঠে কাপড় ভাঁজ করছেন, খুঁটিনাটি কাজগুলো করছেন। সারাদিনে হয়তো সময় পাননি। আমার মামীমাও বলেছেন, ‘রমলাকে দেখি রাত দুটোর সময় পর্দা পাল্টাচ্ছেন, খোলা পর্দাগুলো জলসাবানে ভিজিয়ে রাখছেন। সকাল থেকে শুরু হল, দাদুকে কোর্টে, মেজকাকুকে কলেজে, অন্যদের খাইয়ে দাইয়ে যার যেথা স্থানে রওয়ানা করানো, দুপুরে সবার জন্য রান্নাবান্না, আবার বিকেলে বেলা পড়তেই বাড়ি ফেরা সকলের জন্য যার যার বিধিমত ব্যবস্থা–একসঙ্গে নয়-একে একে জনে জনে। কত রকমের খাবার দাবার যে করতেন।’ সত্যিই কাকীমার কাছে গিয়ে কোনদিন কেনা খাবার খাইনি, সব সময় নিজের হাতে তৈরি খাবার। তপন বলছিল, সেদিন মেজকাকীমা ২০ টা পাটিসাপটা করেছিলেন। তপন সবার জনান্তিকে সব কটা সাবাড় করে দিয়েছিল। এর পর সবার মুখে কোথায় গেল, কোথায় গেল রব। মেজকাকীমা বললেন, ‘তপন হয়তো বলতে পারবে।’ তপন উত্তরে বলেছিল ‘দেখ বোধহয় বেড়াল খেয়ে গেছে।’ আসলে এই ছিল তপন। হয়তো মেজকাকীমার ভাঁড়ার বলেই তপনও এই কাণ্ডটা করতে পেরেছিল। স্নেহময়ী অন্নপূর্ণা।
এ প্রসঙ্গে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। শিলচর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে ভোটে কাউন্টিঙে গেছি। আমি বাড়ি থেকে রীতিমত অন্নজল খেয়েই গেছি। সেবার কী গণ্ডগোলে গণনা কাজ শুরু হচ্ছিল না। অন্যরা খেয়ে যাননি, সবাই ক্ষুধার্ত। ৩-৪ জন ছিলাম, তারা বলল, ‘চল, রমলাদির বাড়ি যাই।’ রমলাদির নাম শুনে আমিও সঙ্গ নিলাম, তবে খাবো না, আমি খেয়ে এসেছি। ওরা খেয়ে আসেনি, তাই কাকীমা ভাত খেতে বললেন। আমি খেয়ে গেছি শুনে বারণ করা সত্ত্বেও জোর করে গরম গরম পরোটা বেগুন ভাজা করে দিলেন। আহা অমৃত। অন্যরা ভাত খেতে বসল। আমি দেখি লটে শুঁটকী বেগুন দিয়ে লাল ঝোল।’ একী! আগে বলনিতো, শুঁটকী আছে? তাহলে আমিও ভাতও খাবো।’ খেলামও। এই দাবিটাও করতে পারলাম রমলা কাকীমা বলেই তো !! আর এই রমলাকাকীমাকে আমি তো চিনেছি, জেনেছি আশৈশব বড়মামীমা, আমার মামীমা, দিদিমণি, নন্দা, তপন, ন’কাকিমা, ফুলকাকীমা, ছোট্টকাকীমার মুখ থেকেই। যারা শতমুখে এখনো বলে নতুন সংসারে কী ভাবে কাকীমা আগলে রেখে শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছেন। এসব শুনে শুনেই জেনে গেছি এখানে আব্দার করা যায়। কাকীমা ছিলেন দত্তবাড়ির খুঁটি। বাড়ির ছেলেরা উপযুক্ত হয়ে কর্মসূত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলেও ছুটি ছাটায় অনিবার্য আকর্ষণ শিলচরের উকীলপট্টির বাড়ি। ঠাকুরমা দাদু থাকার সময় তো বটেই, পরবর্তী কালেও।
কাকীমা শুধু গৃহলক্ষ্মী দ্রৌপদী-অন্নপূর্ণা নন, অসাধারণ কারুশিল্পী। সূচ, কুরুষ, ছাটকাট, উল। নিখুঁত পরিপাটি, নবতি অতিক্রান্ত বয়সেও। আমার শিলচর জীবনের প্রথম পর্বে আমার সেলাইয়ের প্রথম নমুনার জোগানদার আমার এই কাকীমা। আর ছিল অনন্ত পাঠতৃষ্ণা, আগ্রাসী পাঠক, এই বয়সে এমনটা আমি দেখিনি। শতবর্ষের চৌকাঠে পা রেখেও।
দূর্বা বলছিল, দ্বিজেন্দ্র- ডলি মেমোরিয়াল লাইব্রেরির বইয়ের সব চেয়ে বড় পাঠক ছিলেন কাকীমা। বইয়ের স্রোত বইতো এখান থেকে ওখানে। কাকীমার পাঠতৃষ্ণা নিবারণের প্রথম ও প্রধান রসদদার ছিল এই লাইব্রেরি।
কোনও বই চাইতে গেলে মেজকাকুকে নয়, আমি মেজকাকীমাকে ফোন করেছি এবং পেয়েছি। মনে আছে, এই কদিন আগেই এই শতবর্ষের চৌকাঠে দাঁড়ানো মানুষটির কাছেই হাত পেতেছি চন্দবাড়ির তথ্য সংগ্রহের জন্য। একটা লেখার কারণে। না, বই নয়, তথ্য সরবরাহ করেছেন তাৎক্ষণিক মৌখিক বয়ানে। সেই আমার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নির্দ্বিধায়। আমার মেজমামার কাদম্বরী দেবী নিয়ে লেখা বহু প্রাচীন একটি চিঠি আমি পেয়েছি তাঁরই সযত্ন সংরক্ষণ থেকে।
অন্তর্বর্তীণী এই মহিলা অন্তরালে থেকেও শিলচরের একজন সম্মানিত শ্রদ্ধার্হ মানবী। তাঁর সেলাই নিয়ে আমাদের মৈত্রেয়ী সংঘের প্রদর্শনী একাধিকবার সমৃদ্ধ হয়েছে, আমাদের অনুষ্ঠান উদ্বোধনও হয়েছে তাঁরই কল্যাণপূত হাতে। আজ নিজেকে বড় ধন্য মনে হচ্ছে। মনে পড়ছে একবার সারদা সংঘের সর্বভারতীয় সম্মেলন হল শিলচরে। আমাদের অন্নপূর্ণা-দ্রৌপদী কাকীমা ছিলেন খাদ্যবিভাগের দায়িত্বে। কী নিপুণ নিষ্ঠায় এবং নিয়মানুবর্তিতায় এই বিপুল কর্মযজ্ঞকে সামলালেন, সে আমার নিজের চোখে দেখা। সে কথা ভোলার নয়। অসাধারণ নিটিপিটি। বাড়িতেও কখনোও এলোমেলো অগোছানো দেখিনি।
বরঞ্চ এলোমেলো দেখলে শাসন করেছেন। একটা নীল ব্লাউজের হাতা সাঁটছিলাম সাদা সুতো দিয়ে। বকলেন। খোঁপা বেঁধেছি নানা রঙে রাবার ব্যান্ড দিয়ে৷ বকলেন। বিয়ে বাড়িতে পরা আমার শাড়িটা পছন্দ হয়নি, বকলেন। মেজকাকু চলে যাবার পর যাইনি, ও আমার ভালো লাগে না, কোথাও যাই না। কাকীমা বললেন কিছু কথা। বকলেন কাকীমা বলেই তো! আর সে জন্যই তো দাবি নিয়ে দাঁড়াই বার বার, আজ চোখের জলের ধারা বইছে। আজ যাবো কাকীমা, তোমার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনের অনুষ্ঠানে আমি যাবো। এবার আর শুনবো না, ‘তোমার আসা উচিত ছিল।’ মেজকাকুর সময় যেমন বলেছিলে।
উজ্জ্বল দুটি চোখ, অমলিন হাসিমাখা ব্যক্তিত্বময় মুখটি গিয়ে দেখিনি বহুদিন। কোথায় যেন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে ২৩-এর সকাল থেকে, যখন খবর পেলাম মেজবৌ হয়েও দত্তবাড়ির মূল খুঁটিটি সব বাঁধন আলগা করে চলে গেছেন পরপারের দিকে। এই ১৩ দিনের অশৌচ কাল শুধু স্মৃতি সাগরে একবার ডুবে যাওয়া, আবার ভেসে ওঠা, আবার ডুব–তবু যেন অকুল দরিয়ায় কূল খুঁজে থৈ পেলাম না। বারবার কাকীমা
অশীতিপর আমাদের তিনজনকে টেনে নিয়ে গেলেন সেই অবোধ শৈশবের দিনগুলিতে। বার বার আমি-নন্দা-তপন ফোনে একাত্ম হয়েছি। মেজকাকীমাকে কেন্দ্র করে শৈশবের বালুকাবেলায় ঝিনুক কুড়িয়েছি। আর তারই মধ্যে কিছু মুক্তো নিয়ে এই স্মৃতির মালা গাঁথা।
এই আমাদের সম্মিলিত স্মৃতি তর্পণ। শোক তর্পণ নয়। কারণ আমরা জানি, মৃত্যু মানে মুক্তি। ‘যদি বন্ধনের দিক দিয়ে দেখি তবে তা শোক আর মুক্তির দিক দিয়ে দেখি তবে তা শান্তি’। বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাই তাঁর বিশ্বাসে বিশ্বাস রেখেই বলি,
‘মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক, তবে তাই হোক।’