Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

অবসর নিয়েও অভিজ্ঞতা হিতেশ গোস্বামীর, শিক্ষকতার চেয়ে উত্তম কর্মজীবন হতেই পারে না

সমৃদ্ধ সমাজ গড়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকের অবদান চিরদিনই উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে অনেক শিক্ষাগুরু আছেন যাঁরা আড়ালে থেকেই  আদর্শের বৃত্ত তৈরি করেন। শিক্ষক ও ছাত্রসমাজের কাছে সবসময়ই থাকেন অনুপ্রেরণা হয়ে। এমনই এক শিক্ষক শিলচর জিসি কলেজের  প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ হিতেশ গোস্বামী। শিক্ষক দিবসে নিজের শিক্ষা ও শিক্ষক জীবন সম্পর্কে কিছু কথা ভাগ করলেন ৮৩ বছরেরএই বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ। শুনলেন ‘ওয়ে টু বরাক’ -এর বিশেষ প্রতিনিধি  শতাক্ষী ভট্টাচার্য।

প্রশ্ন: শিক্ষকতাই কেন পেশা হিসেবে বেছে নিলেন?

হিতেশ গোস্বামী: এই চাকরি খুব সহজেই পেয়েছিলাম। আর প্রতিষ্ঠা নিয়ে খুব একটা  উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। ফলে চাকরি জোগাড় করতে কষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু পরে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম, এর চাইতে উত্তম কর্মজীবন হতেই পারে না।

প্রশ্ন: ছোটবেলা ও শিক্ষাজীবন কেমন কাটল?

হিতেশ গোস্বামী:  জন্ম হয়েছিল  ১৯৩৮ সালে, অখণ্ড ভারতের ঢাকায়। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময়েই কলকাতায় চলে আসি। ভারত তখন স্বাধীন। ডাবল প্রমোশন পেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠলাম। মেধার জোর ছিল বলা যায়। তখন নামিদামি স্কুলে পড়াশোনার একটা আলাদা মূল্য ছিল। আমার সুযোগ ছিল বলে ভর্তি হয়ে গেলাম স্কটিশচার্চ স্কুলে। পরে স্কটিশচার্চ কলেজ ও  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে  পড়াশোনা করি।

প্রশ্ন: চাকরি জীবন শুরু হল কবে থেকে?

হিতেশ গোস্বামী:  স্নাতকোত্তর পাশ করার পর রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলে শুরু হয় কর্মজীবন৷ অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপারিন্টেন্ডেন্ট হিসেবে কাজে যোগ দেই। মাইনে ছিল কম। আমার এক বন্ধু এই  চাকরি জোটাতে সাহায্য করেছিল। তারপর তো শিলচরে চলে এলাম। গুরুচরণ কলেজে নিযুক্তি পেলাম। আর কাটিয়ে দিলাম টানা ৩৬টি বছর । রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান ও   ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে অবসর নিই। পরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে গেস্ট লেকচারার ও আইন বিভাগে পাঠদান করেছি।সবমিলিয়ে সুদীর্ঘ ৫০ বছর যুক্ত ছিলাম শিক্ষকতার সঙ্গে। তাছাড়া, গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যও ছিলাম। কর্মজীবনে পাঁচটি দশক চাট্টিখানি কথা নয়। ফলে শিক্ষকতার গভীরতা, তৃপ্তি ও গুরুত্বের জায়গাটা মনে হয় খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি। অফুরান ভালবাসা পেয়েছি ছাত্রছাত্রী ও সহকর্মীদের কাছ থেকে। পেয়েছি যথেষ্ট  সহযোগিতাও। বেশ স্বচ্ছ- সুন্দর আবহেই কেটে গেছে সময়। যা আজকের দিনে  পাওয়া বোধ হয় সত্যিই ভার।

প্রশ্ন: শিক্ষকতায়  আপনার অনুপ্রেরণা।

হিতেশ গোস্বামী: এর উত্তর দেওয়াটা বোধ হয় খুব কঠিন। স্কুলজীবনে  মিস্টার রায়কে পেয়েছিলাম। আমাদের হেড স্যার ছিলেন স্কটল্যান্ডের মানুষ। খুব ভাল ছিলেন। স্কুলের  প্রশাসনিক দিক সামলাতেন। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক। কলেজ জীবনে পেয়েছিলাম শ্রীনির্মলচন্দ্র ভট্টাচার্যকে৷ তিনি পলিটিক্যাল সায়েন্স ও ইকোনমিক্স পড়াতেন। তখন দুটো বিষয় একসঙ্গে ছিল। হ্যাঁ, তিনি আমার আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে  ডি এন সেন স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।

প্রশ্ন: এখনকার শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে আপনার অভিমত।

হিতেশ গোস্বামী: আমাদের যাঁদের বয়স হয়ে গেছে তাঁরা  আগের  সঙ্গে এখনকার তুলনা করে থাকি প্রায়ই। এখনকার চাইতে আগের পদ্ধতি ভাল ছিল, আজকের দিনের শিক্ষকরা শিক্ষাদানের নামে ব্যবসা করছেন, ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন, এরকম কথা শোনা যায়। কিন্তু আমি এটা মানি না। আমার তীব্র আপত্তি এতে। আমি মনে করি আগেও যেমন কিছু ফাঁকিবাজ শিক্ষক ছিলেন, এখনও আছেন। একই সঙ্গে আগের মতো সৎ ও নিষ্ঠাবান বহু শিক্ষাগুরু রয়েছেন।
অনেক শিক্ষক বলে থাকেন, প্রাইভেট টিউশনের প্রতি পড়ুয়ারা বেশি আগ্রহ দেখায়, ক্লাসে মনোযোগ দিতে চায় না।  আমি সেটাও মানি না। পড়ুয়াদের  আগ্রহ বাড়িয়ে তোলা শিক্ষকতারই একটা অঙ্গ।

আমি কলেজের কথা বলছি, যদি কোনও  শিক্ষক এক দিন না আসেন, তাহলে তাঁর ওই ক্লাসে  অন্য কাউকে পাঠানো খুব শক্ত । শিক্ষক বলবেন, ওই ক্লাসে  গিয়ে কী পড়াবেন। আবার ওই শিক্ষকই ঘরে সব বিষয়  পড়াচ্ছেন। এটা ঠিক নয়। শিক্ষাদানে ভাবতে হবে, একটা ছাত্রের সর্বাঙ্গীন বিকাশের কথা। এই শিক্ষাপ্রাঙ্গণে একদিকে রয়েছেন ছাত্রছাত্রী, অন্যদিকে শিক্ষক ও অভিভাবক। এসব নিয়ে অভিভাবকদেরও অনেক সচেতন হওয়া দরকার। শুধু একগাদা টিউটর ঠিক করে দিলেই দায় শেষ হয়ে যায় না। আদতে ছাত্র কতটুকু মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে, কার কাছে কী শিখছে এইসব ব্যাপারে   খবরাখবর  রাখা জরুরি। শুধু কম নম্বর পেলেই হইইচই শুরু হয়ে যায়। আগে থেকে তো ভাবতে হবে। আজকাল ভালো পড়ুয়ারা শিক্ষকতায় আসতে চান না। সবাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে চান। এটা ঠিক নয়। আমি মনে করি, এরকম চিন্তাধারা  নেতিবাচক। এখন আমাদের দেশে শিক্ষকদের মাইনেও  তো খুব কম নয়। আগে কম ছিল। কিন্তু  শিক্ষাদানে এগিয়ে যেতেন। আদর্শ, সম্মান ও জ্ঞান আদান-প্রদানের একটা সুন্দর প্ল্যাটফর্ম হল শিক্ষকতা।

প্রশ্ন: প্রকৃত শিক্ষা ও ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইবেন।

হিতেশ গোস্বামী: প্রকৃত শিক্ষার প্রভাবে চারিত্রিক উন্নতি হয়, একজনকে মুক্তমনা করে ও সঙ্কীর্ণতা মুক্ত জীবন গড়ে তোলে।
দ্বিতীয়ত , ছাত্র ও শিক্ষকদের সম্পর্ক হচ্ছে পারস্পরিক শিক্ষাবোধ। শিক্ষক ও  ছাত্রের মধ্যে স্নেহের বন্ধন থাকতে হবে। যত্ন করে  শিক্ষাদান করতে হবে ছাত্রছাত্রীদের। যে আলোর পথে আছে, সে  তো আছেই।  কিন্তু যে পিছিয়ে আছে, তাকেও আলোর পথে আনতে হবে,  একজন শিক্ষকের শিক্ষাদানের সার্থকতা সেখানেই।

প্রশ্ন: শিক্ষার আধুনিকীকরণ ও শিক্ষকতার আদর্শ  নিয়ে আপনার মতামত…

হিতেশ গোস্বামী:  নম্বরের পাহাড় থাকে মার্কশিটে। মেধার স্বীকৃতি পেয়ে শিক্ষকতায় আসেন যুবক-যুবতীরা। প্রতিযোগিতায় তো তাঁরা জিতে যান। কিন্তু এর বেড়াজালে শিক্ষার মূলস্রোত যেন কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। আদর্শের জায়গাটাও দুর্বল। এখন যে এমসিকিউ সিস্টেম চালু হয়েছে, তাতে শিক্ষার মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দক্ষতা যাচাইয়ের  জন্য বরাবরই প্রতিযোগিতার পরম্পরা রয়েছে। তাই বলে মুলভাবনা থেকে দূরে সরে যাওয়া ঠিক নয়।

প্রশ্ন: শিক্ষক দিবসে কী বার্তা দিতে চান?

হিতেশ গোস্বামী: শিক্ষাঙ্গনটা আমাদের। এটাকে স্বচ্ছ ও মসৃণ রাখতে হবে। দলাদলি ও  রাজনীতির জায়গা নেই এখানে। এসব বর্জন করে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে প্রতিটি শিক্ষালয়ে। এটাই যেন হয় শিক্ষক দিবস উদযাপনের  অঙ্গীকার, প্রতীকী সেলিব্রেশন নয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker