Barak UpdatesHappeningsFeature Story

৬১-র শহিদ-তর্পণ হোক ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণের মাধ্যমে, লিখেছেন শান্তশ্রী সোম

//শান্তশ্রী সোম//

বহু মাতকথার কথকতায় বরাকের উপর দিয়ে বয়ে গেছে কোটি কোটি গ্যালন জল। আর মাস আটেক পার হলেই ষাটে পা দেবে কমলা আর তার দশটি ভাইয়ের যৌবন সমাধি। ১৯৫২ সালে সদ্য ভারত থেকে ছেঁটে নেওয়া এদিককার একটা অংশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) যখন মায়ের হাসি, বাপের আশা বন্ধক দিতে অরাজি হওয়ায় এক দামাল পৈশাচিক তাণ্ডবের মুখোমুখি হয়েছিল, তখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তপ্ত কার্তুজের উষ্ণ আলিঙ্গন হাসিমুখে গ্রহণ করেছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ভাইয়েরা। তখন পদ্মার এপারে বরাকের কোলে কমলা নামের ছোট্ট মেয়েটি মায়ের চোখের থেকে নেওয়া, মুখের থেকে শেখা নিজের জন্মগত অধিকার ভাষাটা আধো বুলি থেকে একটু এগিয়ে ঝালিয়ে নিচ্ছিল নিজের মতো করে। সেই কমলা ‘চম্পা বোন’টি তার দশ দশটি ভাইকে অকালে হারিয়ে আজ শিলচর রেল স্টেশন থেকে ব্রডগেজের ধাক্কায় উচ্ছেদ হয়ে বাইপাসের ধারের বস্তিতে তার আবর্জনা কুড়নোর থলেটায় মুখ ডুবিয়ে রোজ রাতে কাঁদে। সদ্য কৈশোর পেরনো কচি লাউডগা মেয়েটি সিকি আধুলির ভাগা করে করে ক্ষমতা ধরে রাখার অদেখা খেলা চুপিসারে দেখতে দেখতে আজ বিভ্রান্ত।

বলছিলাম ১৯৪৭ সালে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ বোনা হয়েছিল, তা আজ ১৯৫২’র সিঁড়ি বেয়ে ১৯৭১, ১৯৮৬, ১৯৯৬ হয়ে নীচে নামতে নামতে আজ যে তলানিতে এসে ঠেকেছে, সেই মাটিতে আর যাই হোক সোনার ফসল ফলানোর স্বপ্ন দুরাশা। এই পরিস্থিতিতে ‘দিশি’ সোমরস পান করিয়ে জাতি বিদ্বেষ, সমাজ বিভাজন, পারস্পরিক অন্তর্দ্বন্দের কীটনাশক ছড়ানোর পরও যেটুকু ফসল ফলছে, তাও ধ্বংস করে দেবার এক সুকৌশলী চক্রান্তে মেতেছে রাজ্যের ‘জাতি মাটি ভেটি’র রক্ষা কর্তারা। বরাকের মানুষের আবেগে আঘাত হেনে ‘ভূমিপুত্র ‘র কার্ড খেলছে এই রক্ষা কর্তারাই। ৬১ সালে জবানের জন্য জান দেওয়া জোয়ানদের জল তর্পণ হোক ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ নামকরণের মাধ্যমে।

 

এই বরাকের বুক বেয়ে বয়ে চলেছে জিরি, চিরি, মধুরা, জাটিঙ্গা, রুকনী, সোনাই সহ আরো আরো ছড়া গাঙ্গের জল। ছড়ার পার গাঙ্গের তীরে বসবাস করছেন মার, কুকি, রংমাই, মিকির। খাসি, কার্বি, কৈবর্ত, বৈষ্ণব। মৈমনসিঙ্গা, চাটগাইয়া, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সবার মনমাঝি বরাকের জলে ডুবসাঁতার দেয়। খোঁজে পাটা বাইং, শিলগুতুম, রাণী, তিন কাটা মাছের মতো এই বরাকের পেটেন্ট নদী সম্পদ। বরাক পারের গাদাগুচ্ছের পালই (ঢেকি)শাক, কলমী লতা, হেলেঞ্চা, মালঞ্চ, বাথুয়া, ঘি শাক (ব্রাহ্মী) মাথায় আঁটি বেঁধে নিয়ে দিনের শেষে ঘরে ফেরে লালকাপ পুং আর কাজল বৈষ্ণব। সবাই দুটো শাক ভাত মুখে তুলে দিতে চায় তাদের ছানাপোনার মুখে। নদীর জল ইতিউতি ঢুকে পড়া পানা পুকুর, এঁদো ডোবায় ডুবকি সাঁতারে ছোঁ মেরে স্কুল পালানো বিশাই বর্মণ নিয়ে আসে ‘হিঙ্গাইর’। জলফল মানে জল সিঙ্গারা। এই উপত্যকার উর্বর মাটির সম্পদ ‘বনাজী’ ওষুধ কলে ঘষে শিলে বেটে হাড়হাভাতে নেই-রাজ্যের বাসিন্দারা রোগ তাপ কমায়। মৃত্যু আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে অবিরত। এই উর্বর মাটি ঠুনিমানকুনি (থানকুনি), আগিজাল, রুজণ্ট, পরশপিপল গাছের সর্বরোগহারক ভেষজ গুণকে সম্বল করে বাঁচিয়ে রেখেছে তার কোলে আশ্রয় নেওয়া প্রতিটি জাতি জনগোষ্ঠীর সন্তানকে।

বরাক ও এর দুটো তীরের এই বিশাল উপত্যকা কোথাও কোনো ভেদভাব করেনি বলেই মারকিউলিনের আনারস বরাকের গৌরব। কোনো বিশেষ জাতিগোষ্ঠীর নয়। খাসপুরের রাজবাড়ি এ অঞ্চলের লোকেদের প্রায় একমাত্র ঐতিহাসিক নির্দশনের গৌরবোজ্জ্বল সাক্ষ্য। কোনো একটি জনগোষ্ঠীর নয়। কাটাখালের গল্লা বেত সানন্দে মাথায় করে নিয়ে এ-ক্লাস পাটি বানায় বৃহত্তর ধলাই অঞ্চলের মণিপুরী বেতশিল্পীরা। নব্বুইয়ের দশকে শহর শিলচরের দুই প্রান্তে দুই নৃত্যশিল্পীর আখড়ায় ছেলেমেয়েদের নাচ শেখানোর জন্য ভক্তের মতো লেগে থাকতে দেখেছি সব জাতি জনগোষ্ঠীর মা -বাবাদের। কলেজ রোড পেরিয়ে সিঙ্গারী ভকতপুরে ছিলেন শ্রদ্ধেয় চন্দ্রকুমার সিং। কত্থক নৃত্যের অনিন্দ্য শিল্পী। উপাসনা স্থলের মতো ছিল তার নৃত্যশালা। রীতিমতো পুজো আচ্চা করে নাচ শেখানো শুরু হতো। শহরের ওপাশে রংপুরের কাছে ছিল মণিপুরী নৃত্যকলা অ্যাকাদেমি। প্রশিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় গুরু বিপিন সিংহের সুযোগ্য এক শিষ্য (নাম মনে পড়ছে না)। সেখানেও কঠিন সাধনার পদ্ধতিতে শিখতে হতো ভাব মাধুর্যে মোড়া সুললিত ছন্দের সেই অপরূপ নৃত্য।

যে দুটো নৃত্যমন্দিরের কথা উল্লেখ করলাম, দুটোতেই সংশ্লিষ্ট গুরুজির জাত জনগোষ্ঠীর ছাত্রী সংখ্যা ছিল নগণ্য। সব শেষে আরেকটা কথা। এ অঞ্চলের তাবৎ জনগোষ্ঠীর অদ্বিতীয় উৎসব দুর্গাপূজোয় দেখা যায় অন্য এক মনভোলানো দৃশ্যপট। ভকতপুরের দুর্গার পরণে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের ‘লাহিঙ’, ‘চাকসাবি’, ‘আঙেই’, জিরির পারের জুজাং পুঞ্জিতে দেবীমা কুকি/মার পোশাক পরিহিতা, ভৈরবী সংলগ্ন ঘাড়মুড়া এলাকায় তিনি রিয়াং বসন আবৃতা। আবার কুমাছড়া, কালাহাওর, গঙ্গানগরে তিনি ডিমাসা কন্যার ‘রিগু’ বা ‘বাথরমাই’ পরিহিতা। বেকরা, ধলাইর প্রত্যন্ত গ্রামে দেবী মণিপুরী ‘ফানেক’ ‘রাণীপী’ বসনা। সবাই ঘরের মেয়েকে ঘরে এনে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছেন এই চারটে দিন। সবচেয়ে পাগল করা মুহূর্ত আসে ভাসানের বিকেলে।

সদরঘাটে বরাকের জলে ডুব দিয়ে যখন দেবী আবার ফিরে যান কৈলাশে। তাঁর শ্বশুর বাড়ি। শোভাযাত্রায় ধামাইল, গীত সহযোগে দেবী ভাসানের পরই ধীরলয়ে এগিয়ে আসছে ‘সাম পা’র মতো মিউজিক্যাল ব্যাণ্ড। তারপরই প্রথাগত ‘খরাম’ আর ‘মুরি’ তে বিদায়ের বাজনা বাজিয়ে প্রতিমা ভাসানে আসছেন ডিমাসা জনগোষ্ঠীর লোকেরা। এদিকে গোটা বিষয়টা উপভোগ করে নেচে গেয়ে গোটা শহর মাথায় তুলছেন সুবিশাল এক জনসমুদ্র । তাদের জাতি জনগোষ্ঠীর হদিশ কেউ কখনো খোঁজেনি। ভাবেওনি। নিখাদ আনন্দে নিজেদের অজান্তেই ভাগ হয়ে গেছে পারস্পরিক সুখদুঃখ।

 

‘ দিবে আর নিবে’ কখনো কাগুজে বাঘ হয়ে থাকেনি এই উপত্যকায়। এবং সচেতনতা অভিযান চালিয়ে, সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলে তৈরি হয়নি সে বন্ধন। এ এক অদৃশ্য সমীকরণ। বলছিলাম না! নেইরাজ্যের বাসিন্দারা নৈরাজ্যের শিকার হতে হতে সাপলুডোর খেলার বোড়ে হয়ে হয়ে নিজেদের অজান্তেই শিখে গেছেন শিরদাঁড়া সোজা করে বেঁচে থাকতে। এতো কথা বলার একটাই কারণ। জল কাটো ভাই। রক্ত কাটো। বাপের চোয়াল, মায়ের মুখ, বোনের স্বপ্ন, ভাইয়ের অস্তিত্বের ভাঙন আর মেনে নেবেনা এই উপত্যকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker