Barak UpdatesHappeningsBreaking News

যেখানে অহর্নিশি চলে পরিচয় রক্ষার সংগ্রাম, লিখেছেন ড. সব্যসাচী রায়

//ড. সব্যসাচী রায়//

ভাষার প্রশ্নে এখনও সিঁদুরে মেঘ দেখে অসমের বরাক উপত্যকার বাঙালি। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, গ্রহণ-বর্জনের টানাপোড়েনে টিকে থাকা সত্বেও উৎসবের মেজাজে উনিশে মে দিনটিকে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে উদ্‌যাপন করে প্রতি বছর। জ্বলজ্বলে উনিশে মে বরাক উপত্যকার একমাত্র জীবনরেখা, তার অর্জিত অধিকার রক্ষার পথে আলোকশিখা। উনিশকে কেন্দ্র করেই বরাকবাসীর যাপনকাল। নিত্যদিনের পরিচয়সঙ্কট স্মরণে রেখে এই দিনটিতে তাঁরা ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়, ফিরে দেখে এবং আসন্ন কঠিন দিনের অনুমান করতে পেরে গলা ছেড়ে একে অপরের সুরে সুর মেলায়, “মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা।” মনে এক সুস্থির ভাষাগত পরিচয় লাভের আশা, ভাষাকে সম্বল করে টিকে থাকার সংকল্প।
ফিরে যেতে হয় দেশভাগের সময়টাতে। বরাক উপত্যকায় দেশভাগ মানে সিলেট বিভাজন, যার কাঁটাতারের ক্ষত থেকে এখানের বাঙালির হৃদয়ে আজও রক্তক্ষরণ হয়… “বহে যাহা মর্মমাঝে রক্তময়, বাহিরে তা কেমনে দেখাব।” দেশভাগের আগে সিলেট অসম প্রদেশের অঙ্গ ছিল। ১৯৪৬ সালে, বাঙালি অধ্যুষিত সিলেটকে পাকিস্তানে হস্তান্তর করার জোরালো প্রস্তাব অসমের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্যাবিনেট মিশনের কাছে রেখেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৬ এবং ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত সিলেট গণভোটের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেট পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পুরো সিলেটে উত্তোলিত হয়েছিল পাকিস্তানের পতাকা। কিন্তু, তার ঠিক দু’দিন পর রেডক্লিফ অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে সিলেটকে দু’টুকরো করে সিলেটের সাড়ে-তিন থানার ৭০৯ বর্গমাইল এপার ভারতের অসমে আবার ফেরত দেওয়া হয় যেখানে ১৭ আগস্ট আবার উত্তোলিত হয় ভারতের পতাকা। এক বিরাট সংখ্যক অসহায় বাঙালি স্বদেশের খোঁজে ওপার থেকে এপারে প্রব্রজন শুরু করে। যদিও পূর্ব-পাকিস্তানে ১৯৫০ সালের হিন্দু-বিরোধী দাঙ্গা সেই প্রব্রজনের আরেক কারণ ছিল।
সেই ১৮৭৪ সালে অসম প্রদেশ গঠনের পর থেকেই অসমকে ভাষাগত সমজাতীয় প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার বাসনার জন্ম হয়েছিল অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের মনে। এক বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী ভাবধারার পাশাপাশি অসমে এধরণের একভাষী আঞ্চলিক পরিচয় গঠনের উদ্যোগকে দ্বিমুখী জাতীয়তাবাদ বলে চিহ্নিত করেছিলেন অমলেন্দু গুহ তাঁর ‘প্লেন্টার রাজ টু স্বরাজ’ গ্রন্থে।


আসলে, দেশভাগের আগে অসমের জনবিন্যাসের চিত্রটি বাঙালিদের অনুকূলে ছিল। ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুসারে অঙ্গীভূত সিলেট-সুরমা অঞ্চলসহ অসম প্রদেশে বাঙালিরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। তখন অসম প্রদেশে অসমিয়া জনসংখ্যা ছিল বিশ লক্ষের কম, যেখানে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল প্রায় দ্বিগুণ। সিলেট বিভাজনে এই চিত্র রাতারাতি পালটে যায়, কিছুটা সন্তুষ্টি অনুভব করে অসমের আগ্রাসী জাতীয়তাবাদীরা। পরের অধ্যায় ১৯৫১ সালের জনগণনা, যার প্রতিবেদন অনুসারে রাজ্যে অসমিয়া ভাষাভাষীদের হার গিয়ে দাঁড়ায় ৫৬.৬৯ শতাংশে, ১৯৩১ সালে যা ছিল ৩১.৪২ শতাংশ। এই প্রেক্ষাপটে, ১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্য ভাষা হিসাবে ঘোষণা করার দাবি নতুন গতি অর্জন করে, যদিও ১৯৫১ সালের জনগণনার পরিসংখ্যানের বাইরে তত্ত্বগত সেরকম কোনও যুক্তি ছিল না এর পেছনে। ততদিনে, অসমিয়া ভাষা অষ্টম তফসিলের অন্যতম একটি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই উগ্র ভাষাগত জাতীয়তাবাদের আঁচ থেকে ভোট রাজনীতিই-বা রেহাই পাবে কেমন করে! অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিল ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর বিধানসভায় উত্থাপিত হয় এবং তৎকালীন কাছাড় জেলার (যা এখন তিন জেলায় ভাগ হয়ে কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলা মিলিয়ে বরাক উপত্যকা অভিধা পেয়েছে) বিধায়কদের আপত্তি সত্ত্বেও তা বহুমতে অনুমোদিত হয়। ভাষা হারানোর পরিস্থিতিতে উত্তাল হয় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ তদানীন্তন কাছাড়, শুরু হয় সর্বাত্মক গণবিক্ষোভ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬১ সালের উনিশে মে শিলচর রেল স্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান এগারোজন ভাষাসংগ্রামী। এরপরই সরকারি ও বেসরকারিস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের বিধান সংযুক্ত করে ভাষা আইনটির সংশোধন করা হয়। কিন্তু, তা হয় কেবল কাছাড়ের জন্য। রাজ্যের বাকি অঞ্চলে সরকারি পর্যায়ে অসমিয়া ভাষা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।


কিন্তু তারপরও কমেনি একভাষী প্রদেশ গঠনের সেই পুরনো ইচ্ছাপূরণের তদ্‌বির। ১৯৬১ সালের পর অসমিয়াকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রয়াস হয়েছে বার কয়েক, যার প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ শহরে ১৯৭২ সালের সতেরো আগস্ট একজন এবং ১৯৮৬ সালের একুশে জুলাই দু’জনকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে। ভাষাগত অধিকার রক্ষার জন্য বারবার প্রাণ দেওয়ার এমন নজির আর কোথাও নেই।
সিলেট বিভাজন আখেরে কোনও পক্ষকেই সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ভাষা-বিদ্বেষের সূত্র ধরে ‘ভূমিপুত্র-বহিরাগত’ বিরোধের আবহ অসমিয়াদের মধ্যে যেমন জিইয়ে রয়েছে, তেমনি দেশভাগের অভিশাপ অসমবাসী বাঙালিদের তাড়া করে আজও। বিগত শতক থেকে অসমে চালু থাকা একভাষী রাজ্য অর্জনের প্রয়াস ফলপ্রসূ না হলেও এই অভিলাষের যে মৃত্যু হয়নি তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রমাণ — বিদেশি খেদা আন্দোলন, অসম চুক্তি, নাগরিকপঞ্জি নবায়ন, রাজ্যে দেশের সবচাইতে বড়ো ডিটেনশন ক্যাম্প নির্মাণ ইত্যাদি। সঙ্গে, নিযুক্তিতে বঞ্চনা বা নিযুক্তির পরীক্ষায় বাংলাকে মাধ্যম হিসেবে না রাখা, ভাষা শহিদ দিবস এবং রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনগুলোতে স্কুল-কলেজে পরীক্ষা রাখা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নামফলক ও বিজ্ঞাপন-বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা বাদ, সাহিত্য-সংস্কৃতির সংগঠনগুলোর জন্য মঞ্জুর করা সরকারি অনুদান থেকে বাঙালিদের ব্রাত্য রাখা ইত্যাদি অভিযোগ তো রয়েছেই। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে একেবারেই যে কিছু সুরাহা হচ্ছে না, তেমনটাও নয়। সম্প্রতি মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের আকাদেমিক ক্যালেন্ডারে বরাক উপত্যকার জন্য উনিশে মে এবং রবীন্দ্রজয়ন্তী উদ্‌যাপন দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, পরীক্ষার নির্ঘন্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে দিনগুলো। কিন্তু বরাক উপত্যকার ভাষাশহিদদের সরকারি স্বীকৃতি, সরকারি তরফে বরাক উপত্যকায় একটি শহিদ স্মারক নির্মাণ বা রাজ্যে একটি অনুবাদ সংস্থা গঠনের দীর্ঘদিনের আশ্বাস থাকলেও সেগুলো এখনও অধরা। ক’বছর আগে বড়ো ভাষাকে রাজ্যের সহযোগী সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর বাংলা ভাষাকেও এই পর্যায়ে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। বলা প্রয়োজন, ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে রাজ্যে বড়ো ভাষাভাষী লোকের সংখ্যা মাত্র ৪.৫৩ শতাংশ, যেখানে বাঙালি জনসংখ্যা ২৮.৯১ শতাংশ।

তবে, বরাক উপত্যকায় বাঙালি জনসংখ্যা প্রায় আশি শতাংশ হওয়ায়, ভাষা ও জাতিসত্তার সঙ্কটে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের এপিসেন্টার এই সুরমা-বরাক-কুশিয়ারা বিধৌত বরাকভূমিই। যদিও, আজকের পরিস্থিতিতে, সামগ্রিকভাবে বিচার করলে, বলতে হয় যে সময়ের গতিতে পরিচয় সঙ্কোচনের পথ ও মাত্রা পাল্টেছে। চিড় ধরেছে আমাদের নিজেদের অখণ্ড জাতিসত্তায়, মাথাচাড়া দিয়েছে ধর্মের নামে অন্তর্লীন বিভাজন। আজ ভাষার প্রশ্নে বরাক উপত্যকার বাঙালিকে এক ছাতার নীচে নিয়ে আসা কষ্টসাধ্য। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে এই মলিন চিত্রপট কেবল বরাক উপত্যকার স্বকীয় নয়, দেশের বাঙালিবহুল অনেক অঞ্চলেই আজ একই পরিস্থিতি।
আরেকটি ব্যাপার, সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর উপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্য কায়েমের ইতিহাস অসমের গণ্ডিতেই কেবল সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দেশে বা দেশের রাষ্ট্রসীমা অতিক্রম করলে ইতিহাসের বিস্তির্ণ প্রান্তরে এর অনেক সাক্ষ্য মিলবে। কিন্তু আজ ভাষাকেন্দ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক বয়ান ধর্মের রাজনৈতিক বয়ানের সামনে যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আজ, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদীরা অসমের ‘ভূমিপুত্র-বহিরাগত’ বিরোধের আবহকে চাগিয়ে দিয়ে সারা দেশে বাঙালিকে ‘ঘুস্‌পেটিয়া/উইপোকার’ পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ভাষাগত সমজাতীয় প্রদেশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের নিরঙ্কুশ অস্তিত্বই তো সঙ্কটে! শ্রীনিকেতনের পল্লী উন্নয়ন কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বভারতীর পল্লীচর্চা কেন্দ্রের নামফলকেই আজ বাংলা ব্রাত্য!


’৫২ ছিল ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠনের বিরুদ্ধে গিয়ে ভাষা-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সফল প্রয়াস। এর সুফল হিসেবে ১৯৭১ সালে ভাষার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এই ’৫২-প্রসূত ভাষা-তরঙ্গমালায় উদ্দেলিত হয়ে বরাক উপত্যকা ১৯৬১ সালের উনিশে মে বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার আরেক উজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করতে পেরেছিল। ভাষাকেন্দ্রিক জাতি হিসেবে নিজের পরিচয়কে অক্ষত রাখতে হলে আজকের দিনে বিভিন্ন ভূবনে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিদের উনিশে মে-কে বরাক উপত্যকার গণ্ডির বাইরে নিয়ে গিয়ে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যেতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারির মতো তারও এক সর্বজনীন বয়ান তৈরি করতে হবে। তৈরি করতে হবে বাঙালির জাতিসত্তার এক উদার কিন্তু অভেদ্য বলয়। ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের হত ধরে বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক স্বীকৃতি রক্ষায় এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিক পশ্চিমবঙ্গ। আলো দেখাবে একুশে ফেব্রুয়ারি, আলো দেখাবে উনিশে মে।

(ড. সব্যসাচী রায় করিমগঞ্জ কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker