Barak UpdatesHappeningsBreaking News
শ্রীগৌরীর হাসানপুরে দেখে এলাম চারশো বছরের পুরনো পূজা, লিখেছেন শতাক্ষী ভট্টাচার্য
দুর্গাপূজা মানে উৎসব। এক জমাটি মেজাজ। নতুন কাপড়। ঘোরাঘুরি। পুষ্পাঞ্জলি। রকমারি খাওয়াদাওয়া। বিগ বাজেট, স্মল বাজেট নিয়ে আলোচনা৷ সাজসজ্জার বাহার আরও কত কিছু। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, সাধারণভাবে আমরা এমনটাই বুঝি। বছর ঘুরে যখন শারদীয়ার ঢাকে কাঠি পড়ে, আমাদের সবার মন আনন্দে মেতে ওঠে। কে কোন প্যান্ডেলে যাবেন, কোন জায়গার পূজা আগে দেখবেন, কোন ধাবা বা রেস্টুরেন্টে খাবেন সেই পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায়। দেবী পক্ষের চূড়ান্ত প্রস্তুতি শহরে বাস্তব রূপ পায় পঞ্চমী থেকেই। মোট কথা মণ্ডপ দেখা শুরু।
আমিও পঞ্চমী থেকে শুরু করে মহাষষ্ঠীর বোধন, মহাসপ্তমী, মহাষ্টমীর পরিক্রমা সেরে মহানবমীর প্ল্যান করছিলাম। ভাবতে ভাবতেই সকালে ঘরে এলেন এক প্রিয়জন। পুজোর শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। কথায় কথায় বললেন, “শহরে তো অনেক পুজো দেখলে। আজ একটা গ্রামের পুরনো পুজো দেখে এসো। ভাল লাগবে।” ঠিকানাটাও দিলেন।
তিনি যদিও এতটা সিরিয়াস ছিলেন না, কিন্তু আমি বড্ড কৌতূহলী হলাম। বিন্দুমাত্র দেরি না করে মনস্থির করে নিলাম, ওখানেই যাব। একটু ভিন্ন আবহের পুজো দেখতে চটজলদি প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
সব মিলিয়ে পৌনে দুই ঘণ্টা। পৌঁছে গেলাম করিমগঞ্জ জেলার শ্রীগৌরীর হাসানপুরে। আলো হওয়া রোদ্দুরে ভরপুর প্রাকৃতিক পরিবেশ ঘেরা একটি গ্রাম। সেখানে গিয়ে খুব ভাল করে বুঝতে পারলাম পুজো মানে পরম্পরা, পুজো মানে প্রজন্মের পরিচিতি। পুজো মানে একটি বংশের আত্মপরিচয়। হাসানপুর পুরকায়স্থ বাড়ি’র চারশ বছরের পুরনো পুজো দেখে কার্যত এটাই মনে হচ্ছিল আমার। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, নয় পুরুষ ধরে মাতৃ আবাহনের এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলেছে পুরকায়স্থ বাড়ি।
প্রয়াত আনন্দরাম দেব পুরকায়স্থ মা আনন্দময়ীর প্রথম আবাহন শুরু করেছিলেন পুরকায়স্থ বাড়িতে। তারপর থেকে চারশ বছর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই পরম্পরা বজায় রেখে চলেছে । আশি ছুঁই ছুঁই বেলা দেব পুরকায়স্থ বর্তমানে পুরকায়স্থ বাড়ির প্রবীণতমা৷ বার্ধক্যজনিত রোগে শয্যাশায়ী। কথা বলতে পারেন না ঠিক ভাবে। উঠতে-বসতে সমস্যার দরুন পুজোতে অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু সেই পরম্পরার বীজ কিন্তু ঠিক লাগিয়ে গিয়েছেন তিনি। তাই এই বংশের সর্বকনিষ্ঠ নয় বছরের সন্নিকাও বাড়ির অন্যদের সঙ্গে পুজো আয়োজনে হাত লাগায়। কোথাও যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সেই খেয়ালও রাখে এই খুদে।
হাসানপুর পুরকায়স্থ বাড়ির এখনকার পুজো আয়োজকদের মধ্যে অন্যতম শুভম দেব পুরকায়স্থ, সপ্তর্ষি দেব পুরকায়স্থদের কথায়, ‘প্রায় চার শতক ধরে এই পরম্পরা আমরা ধরে রেখেছি। এখন সেটা শুধু আমাদের পরিবারের পুজোয় সীমাবদ্ধ নয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসেন প্রাচীন এই পুজো দেখতে। পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করেন মায়ের চরণে। মহাপ্রসাদ গ্রহণ করেন।”
আরতি পর্বে হয় ব্যাপক অংশগ্রহণ। বাড়ির সবাই মিলেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করেন। বসে মাতৃ সঙ্গীতের আসর। বিজয়া দশমীতে সিঁদুর খেলায় ঘরের মেয়েদের সঙ্গে শামিল হন আশপাশের অনেকেই। মিষ্টিমুখ করানো হয় প্রত্যেককে। সবকিছু নিয়ে বলা যায়, শাস্ত্রীয়, পরম্পরা, ঐতিহ্য ও উৎসবের মিশেলেই হাসানপুর পুরকায়স্থ বাড়ির এই দেবীবন্দনা।