Barak UpdatesIndia & World UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story
বিজয় দিবসের শ্রদ্ধার্ঘ, মেজর চমনলাল না থাকলে করিমগঞ্জ ধ্বংস হয়ে যেত, লিখেছেন পিনাকপাণি দেব
//পিনাকপাণি দেব//
তখন আমি বারো বছরের কিশোর। মোটামুটি সবই বুঝি। তবে ৫০ বছর আগের সব কথা যে পুরোপুরি মনে আছে, তা বলা যায় না। আবারও এও ঠিক, আজও সেদিনগুলির অনেক ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।
প্রথমে বলি ১৯৭১ সালের ১৯ মে-র কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আমরা জড়ো হয়েছি। হঠাৎ সকলের নজরে পড়ে, ভারতের দিকে কামান-বন্দুক তাক করে বসে পাক আর্মি। নদীর একেবারে কিনারে বাড়ি আমাদের। সবাই এ নিয়ে বলাবলি করছিলেন। মুহূর্তে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয় এলাকা জুড়ে। সে থেকে প্রায়ই শুনতে পেতাম গুলির শব্দ। মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হতো। এ পার থেকে আমরা আগুনের শিখা দেখতে পেতাম। এর পরই করিমগঞ্জ বিসর্জন ঘাটে সেনাবাহিনী ঘাঁটি গাড়ে। ইনচার্জ ছিলেন মেজর চমনলাল। এ দিক থেকেও নানা রকমের যুদ্ধসামগ্রী জড়ো করা হয়েছিল। মাস কয়েক এই ভাবেই কাটে। মেজর চমনলাল ছিলেন নদীসীমান্তে বসবাসকারী মানুষের ভরসাস্থল। বিসর্জনঘাটের কাছেই ছিল একটি ঘড়ির দোকান। তিনি সেখানে প্রায়ই গিয়ে বসতেন। সাধারণ জনতাকে অভয় দিতেন। অনেক সময় মজাস্ফূর্তিও করতেন।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে একদিন পোস্ট অফিসের কাছে আমগাছের ওপর মাইক বাঁধা হচ্ছিল। পাকিস্তানের দিকে চোঙার মুখ। প্রমাদ গুনতে শুরু করেন এলাকাবাসী। বাবা বললেন, বাড়ির সমস্ত দরজা-জানালার কাঁচে কাগজ লাগাতে, যাতে বব্দুকের গুলি এসে লাগলেও সোজা গ্লাস ভেঙে ঘরে না ঢোকে। প্রত্যেক বাড়ির মহিলাদের অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হয়। একদিন ভোর চারটায় বিকট শব্দ শুনতে পাই। তা চলতে থাকে প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিট। ভয়ে আমরা সবাই খাটের তলায় ঢুকে পড়ি। মনে হচ্ছিল, আজ আর রক্ষে নেই। তবে একসময় শব্দ বন্ধ হয়। সবাই বাইরে বেরিয়ে আসি। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর সবাই নদীর পারে আসে। দেখতে পাই ভারতীয় সেনা জওয়ানরা চোখে কাপড় বেঁধে বেশ কিছু রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসছেন। হোক না বয়স বারো, সকলের সঙ্গে আমার মধ্যেও একটা আনন্দের অনুভূতি খেলা করছিল। তখনই চমনলালের সংবাদটা সবাই জানতে পারেন। মেজর চমনলাল শহিদ হয়েছেন। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে, পাক বাহিনীর প্রচুর জওয়ান ভারতের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। চমনলাল মৃতদেহগুলি সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। কিন্তু এত মৃতদেহের মধ্যে এক পাক জওয়ান গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃতের মতই পড়েছিল। চমনলাল তাঁর কাছে যেতেই ওই পাক জওয়ান খুব কাছে থেকে নাগাড়ে গুলি করতে থাকে। সেখানেই লুটিয়ে পড়ে চমনলালের প্রাণহীন দেহ।
এখানে আমি কাউকে বিভ্রান্ত করতে চাই না। আমি অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি, মেজর চমনলালের অন্ত্যেষ্টি জকিগঞ্জে না কি করিমগঞ্জে এনে করা হয়েছিল. আমার ঠিক মনে পড়ছে না। তবে যেখানেই অন্ত্যেষ্টি হোক, তাঁর চিতাভস্ম এনেই কুশিয়ারা তীরে শহ্দি বেদী তৈরি হয়েছে।
অতি অল্প ক্ষতিতে করিমগঞ্জ সে দিন বেঁচে গিয়েছিল। তিনটি মর্টার এসে পড়েছিল শহরে। একটি মুন্সেফ কোর্টে, আর একটি এর ঠিক বিপরীতে আজ যেথানে যশোদা মিস্টান্ন ভাণ্ডারটি রয়েছে, তখন সেখানে বিমল দেব নামে এক ব্যক্তি সপরিবারে থাকতেন। সতর্কতার দরুন তাঁরা সে রাতে কালীবাড়ি চলে গিয়েছিলেন। তাই নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেলেন। তৃতীয়টি পড়ে সহচরী ফিল্ডের বাউন্ডারির ওপরে।
সে দিন মর্টারে কারও কোনও ক্ষতি করতে না পারলেও করিমগঞ্জ বাজারে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক মেয়ে প্রাণ হারায়। প্রাণ বাঁচাতে সে দুই দেওয়ালের মধ্যে বসে ছিল। তার দুর্ভাগ্য, গুলিটি সেখানে গিয়েই তাকে বিদ্ধ করে।
আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবসে আমিও শহিদ চমনলালের প্রতি আমার অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সে দিন তিনি আচমকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত না নিলে করিমগঞ্জে পাক বাহিনীর বড়সড় হামলা হতো। চমনলাল ছিলেন প্রখর বুদ্ধির অধিকারী। ইদের দিনে পাকিস্তান সেনার অধিকাংশ অফিসার-সেনা ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলে সেই দিনটিকেই তিনি হামলার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে তিনি সেদিন করিমগঞ্জকে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।
(পিনাকপানি দেব খাদ্য ও গণবণ্টন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত পরিদর্শক)