১৭ মেঃ গবেষণা তাঁর জীবনচর্চার সঙ্গে মিশে আছে। গবেষকদের গবেষক হিসেবে পরিচিত তিনি। চল্লিশটি বই লিখেছেন এ পর্যন্ত। তবে, নিজের লেখা ‘আসামের ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি প্রসঙ্গ, ১৯৪৭-১৯৬১’ গ্রন্থকেই জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনা বলে মেনে নিয়েছেন। কেন তাঁর এই রচনাকেই সেরা মনে করেন? ২০১৩-র আগে যে মানুষ কখনও অসমের মাটিতে পা রাখেননি, তিনি অসম প্রসঙ্গে কীভাবে এধরণের সমৃদ্ধ গবেষণার পথে গেলেন? ১৬ মে,বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন আয়োজিত ‘আসামের ভাষা রাজনীতি’ বিষয়ে আলোচনায় অংশ নিয়ে খোদ এমন প্রশ্নের প্রেক্ষাপট তৈরি করলেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক কলকাতার সুকুমার বিশ্বাস, উত্তরটাও দিলেন নিজেই।
অসমের বাঙালির যন্ত্রণা, তাঁদের ওপরে নির্যাতন, বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রাসন, নানা ভাবে প্রকাশিত ভাষা আন্দোলনের অসম্পূর্ণ ইতিহাস মূলত এ ব্যাপারগুলো প্রতিটা মুহূর্তে প্রভাবিত করেছে সুকুমার বিশ্বাসকে। ফলে একজন সত্যিকারের গবেষক ও মনে-প্রাণে বাঙালি, দুটি সত্ত্বাই সুকুমারবাবুর ক্ষেত্রে কাজ করেছে এখানে।
লেখক বিশ্বাসের কথায়, ‘স্বাধীনতার প্রাকমুহূর্তই হোক বা ঠিক পরবর্তী সময়, অসমের বাঙালিদের কোণঠাসা করে রাখার ষড়যন্ত্র পুরোভাগে চলছিল। ১৯৪৭ এর ২৬ আগস্ট কলকাতার একটি সভায় মহাত্মা গান্ধী অসমের উগ্রজাতীয়তাবাদী এই ভাবনার খোলসাও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে স্যার আকবর হায়দার সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, এই রাজ্যে বাঙালিদের কোনোও ক্ষমতা থাকবে না। ইচ্ছে থাকলেও স্বাধীনভাবে থাকতে পারবে না বাঙালি। অসমে থাকতে হলে অসমিয়া সত্ত্বাকে আত্মস্থ করতেই হবে। পরবর্তী সময়ে গোপীনাথ বরদলৈ, বিমলাপ্রসাদ চালিহা প্রত্যেকেই তাঁদের সিদ্ধান্ত, মন্তব্যের মাধ্যমে বাঙালিদের অধিকার খর্ব করতে কোনও কসুর বাকি রাখেন নি। বিমলাপ্রসাদ চালিহা তো কাছাড়ের ভোটে নির্বাচিত হয়েও, এঁদের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে দ্বিধাবোধ করেননি। অসমে সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়া’র সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ১৯৬০ সাল। সংখ্যালঘুদের মতামত গ্রহণের প্রয়োজন মনে করেননি তিনি।’
গবেষক বিশ্বাস আরও জানান, দীর্ঘবছর টু শব্দ না করা বাঙালি সে বারে আওয়াজ তুলেছিল। যার ভয়ঙ্কর পরিণাম ভোগ করতে হয়েছিল তাঁদের। এটি ছিল ৬০ এর ‘বঙাল খেদা’ দাঙ্গা। যা অসমের ইতিহাসে কলঙ্ক হয়ে থাকবে চিরদিন। কিন্তু ততক্ষণে চূড়ান্ত রূপ নিয়েছিল ভাষা আন্দোলন। যার প্রতিফলন হয়েছিল ১৯৬১’র ১৯ মে, তারাপুর রেলস্টেশনে। মাতৃভাষার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ১১ জন। অথচ কাছাড়ের মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে বিশ্ব সমাজের এক বিরল ইতিহাস।একাদশ শহিদের ভাষা সংগ্রামের কাহিনি।
অন্যদিকে সংগ্রাম ও আগ্রাসনের পরিসর তুলনামূলক কম থাকলেও ভাষার প্রত আবেগ উচ্ছাস ও ক্রমাগত আন্দোলনের জেরে ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা পেয়ে গেছে। এমনকী বরাকের ভাষা আন্দোলনে কজন কারাবরণ করেছিলেন, হাসপাতালে কজন চিকিৎসাধীন ছিলেন, সহ আরও বেশ কিছু তথ্য অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। ‘আসামের ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি প্রসঙ্গ, ১৯৪৭-১৯৬১’ বইয়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ রয়েছে বলে জানান সুকুমার বিশ্বাস। পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দেন, যে শহর-উপত্যকা একাদশ শহিদকে জন্ম দিয়েছে এই অঞ্চল নিয়ে গর্ব করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে, আবেদন জানান, বছরের একদিন নমো নমো করে যাতে নির্দিষ্ট কিছু আয়োজনের মধ্য দিয়ে শহিদের রক্তে রাঙানো স্মৃতিকে পরিমাপ না করা হয়। ৬১’র ভাষা আন্দোলনের গতি, অস্তিত্বের সংগ্রামী পথচলা যাতে কোনও অবস্থায়ই স্তিমিত না হয়, জোরালো আহবান রাখেন সুকুমার বিশ্বাস।
বৃস্পতিবার সন্ধে শিলচর বঙ্গভবনের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। মূলত, সংগঠনের ‘ঊনিশের আবাহন’ কর্মসূচির অন্তর্গত ছিল এই পর্ব। পৌরোহিত্য করেন বরাকবঙ্গের কাছাড় জেলা সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও আবারও বরাক বঙ্গের আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ায় সুকুমার বাবুকে ধন্যবাদ জানান। পরে সম্মাননা সামগ্রী তুলে দেন তাঁর হাতে। অন্যদের মধ্যে বরাক বঙ্গের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ইমাদ উদ্দিন বুলবুল, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. সৌরিন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য বক্তব্য রাখেন। সম্মান জানানো হয় সুকুমার বিশ্বাসের স্ত্রী শিখা বিশ্বাসকেও। এর আগে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন মঞ্জুশ্রী দাস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বরাকবঙ্গের কাছাড় জেলা সম্পাদক ড. জয়ন্ত দেব রায়। বরাকবঙ্গের কর্মকর্তা ছাড়াও উপত্যকার বিশিষ্টজনেরা সামিল ছিলেন।