Barak UpdatesHappeningsAnalyticsFeature Story
সর্বানন্দও বরাকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন, লিখেছেন অধ্যাপক দিলীপকুমার দে
//দিলীপকুমার দে//
১৯৭২ সালের ৬ জুন মঙ্গলবার গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হবে একমাত্র অসমিয়া। ১২ জুন কাউন্সিলের আরেক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সঙ্গে ইংরেজিকে পরীক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাখা যেতে পারে। কিন্তু তা আগামী দশ বছরের জন্য। ওই সময়ের পরে এই অতিরিক্ত মাধ্যম উঠে যাবে। এ বড় সাংঘাতিক ব্যাপার ছিল। এর পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙালিদের ঠেঙানো শুরু হয়। উদারপন্থীদেরও তখন অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি হীরেন গোঁহাইও ঢুকতে পারেননি। ৪৭ জনের কাউন্সিলে ২৭জন স্থির করে নেন, গুয়হাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হবে অসমিয়া।
এর পরই বরাক জুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনেই করিমগঞ্জের বিজন চক্রবর্তী ওরফে বাচ্চু শহিদ হন। এর পর ১৯৭২ সালের শেষদিনে আমাদের মিসা আইনে গ্রেফতার করা হয়। কয়েকজনকে পরদিনও ধরে আনে। দুদিন পরে গ্রেফতার করা হয়েছিল অধ্যাপক কমলেন্দু ভট্টাচার্যকে। আমরা শিক্ষক আন্দোলন করতাম। অভিযোগ করা হল, আমরা ছাত্রদের আন্দোলনের জন্য উসকানি দিই। গ্রেফতার হন হাইলাকান্দির নজমুল হোসেন লস্কর। তিনি পরে লালা কলেজে অধ্যাপনা করেন, উপাধ্যক্ষ হয়ে অবসর নেন, বর্তমানে প্রয়াত। তিনি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। এমএ পড়ার সময় তাঁকে খুব পিটিয়েছিল।
আমার সহপাঠী মণীন্দ্র সিংহকেও ধরা হয়েছিল। তিনি তখন সিপিএমের যুব শাখার সভাপতি। কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদের হাইলাকান্দি শাখার সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় চক্রবর্তীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। আরও কয়েকজন রয়েছেন। কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ এখনও বেঁচে আছেন। কংগ্রেস নেতা কমলেন্দু (তিনিও আমার সহপাঠী) বাদে আমাদের সবাইকে রাতে গুয়াহাটি নিয়ে যাওয়া হয়। জোর করে, টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলা হল। নিয়ে যাওয়া হল গুয়াহাটিতে ফ্যান্সি বাজার জেলে। সেখানে মাটিতে ঘুমোলাম টানা আড়াই মাস। চোর-জুচ্চোর সকলের সঙ্গে আমাদের রাখা হল। আর কয়েকজন ছিলেন বাংলাদেশ যুদ্ধের কুখ্যাত অপরাধী। তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা ছিল। একই হলে আমাদের রাখা হল।
আমাদের সে দিন গ্রেফতারের কারণ ছিল, পরদিন দিল্লিতে সভা। কংগ্রেসের নেতারা সবাই চলে গেলেন। সেখানে কথাবার্তার পরে বলা হল, সব মিটে গিয়েছে। কাছাড়ে একটা রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় হবে। আমাদের যখন ছাড়া হল, এসে দেখি, আন্দোলন স্তব্ধ। আমরা তখন কৌশল বদলালাম। আমি তখন শিক্ষকনেতা। প্রেমেন্দ্রমোহন গোস্বামী নরসিং স্কুলের অধ্যক্ষ। আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে শিক্ষা সংরক্ষণ সমিতি গড়ে তুললাম। ওই সমিতির অভিবর্তনে এসেছিলেন আরএসপি সাংসদ ত্রিদীপ চৌধুরী। আমরা বড় করে সভা করলাম। মহীতোষ পুরকায়স্থকেও ডাকলাম না। কারণ কেসি পন্থ সে সময় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি শিলঙে এসে কংগ্রেসি নেতাদের ডেকে নিলেন। সেখানে তাঁরা একটি চুক্তি করেছিলেন, আর কোনও আন্দোলন হবে না। তারাপদ ভট্টাচার্যও সই করলেন। আর সই করলেন মহীতোষ পুরকায়স্থ। তিনি সব সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তাঁদের জিজ্ঞেস করলে বললেন, চাপে পড়েই এটা করতে হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, এটা না হলে আবার গুয়াহাটিতে বঙাল খেদা শুরু হবে।
তাই পন্থ চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী সবাইকে বাদ দিয়ে শিক্ষা সংরক্ষণ সমিতিকে শক্তিশালী করে তোলা হল। তখন আমাদের আলোচনার জন্য ডাকা হল। বলল, রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় মেনে নিতে। আমরা বলি, তা কোনও মতেই নয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া মানব না। রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় হলে আবার তোমরা মাতব্বরি করবে, ইচ্ছামত বিষয় ঠিক করবে। এর বছর চারেক পর আকসা-র জন্ম হয়। রাজ্য নেতাদের নির্দেশে যেমন ছাত্র পরিষদ, তেমনি এসএফআই আমাদের আন্দোলন থেকে সরে যায়। আর বিজেপি বা আরএসএস নেতারা কখনও এই আন্দোলনে সামিল হননি। তারা বলতেন, কাছাড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি আসামে বিভাজনের ষড়যন্ত্র। কিন্ত আন্দোলন চলতে লাগল।
শেষদিকে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন সন্তোষমোহন দেব। তখন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও। সন্তোষমোহন দেব তাঁকে চেপে ধরলেন, আমাদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই। শেষপর্যন্ত তাঁকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আসাম বিশ্ববিদ্যালয় বিল আনা হল। গুয়াহাটির বিজয়া চক্রবর্তী সংসদে এর ঘোরতর বিরোধিতা করলেন। বললেন, কাছাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় করা একদম উচিত নয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের সাংসদরা আমাদের দাবিতে সমর্থন করলেন। বিল পাশ হল। এরপর শুরু হল জমি নিয়ে টালবাহানা। রাজ্যকে তো জমি দিতে হবে, নো অবজেকশন দিতে হবে। এরা দিতে রাজি হচ্ছিল না। শেষে অনেক কসরত করে এখন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে জমি পাওয়া গেল। নরসিংহ রাও এসে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। কিন্তু আসু এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। পরে তাদের সন্তুষ্ট করতে তেজপুরে আরেকটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেওয়া হয়।
ফলে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে বললেন, এই বিশ্ববিদ্যালয় আসাম চুক্তির জন্য হয়েছে, তা ভুল। আসাম চুক্তির কোথাও লেখা নেই, একটা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বরাকে হবে। সর্বানন্দ সোনোয়াল নিজেও এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন।
আমি বিস্মিত, মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য, সাংসদ রাজদীপ রায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য হজম করলেন! হাততালি দিলেন! মু্খ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ডাহা মিথ্যা কথা বলে তাঁর কথার অনুমোদন করিয়ে নিলেন!