Barak UpdatesHappeningsBreaking News
নানা প্রশ্ন সামনে রেখে ‘প্রস্তাবিত ডিলিমিটেশন প্রতিবাদী মঞ্চে’র আহ্বান
ওয়েটুবরাক, ৮ জুলাই : মালুগ্রাম এলাকা দিয়েই শহর শিলচরের সূচনা হয়েছিল। ১৮৩২ সালে খাসপুরের রাণী ইন্দুপ্রভা দেবীকে সামরিক সহায়তা করার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন থমাস ফিশার এসে ছাউনি ফেলেছিলেন মালুগ্রামের বর্তমান পঞ্চানন শিববাড়ির পাশে। পরবর্তীতে সদরঘাট এলাকায় স্থায়ী প্রশাসনিক হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। তার পরেই ধীরে ধীরে মালুগ্রাম প্রথম আবাসিক এলাকা এবং জানিগঞ্জ এবং সেন্ট্রাল রোড এলাকা শহরের ব্যবসা বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।
শহরের জ্ঞান, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সৌহার্দ্য ইত্যাদির কেন্দ্রস্থলও হচ্ছে এই মালুগ্রাম–জানিগঞ্জ–সেন্ট্রাল রোড অঞ্চল। এই এলাকাতেই কামিনী কুমার চন্দ, রুক্মিণীকুমার দাস, হেম চন্দ্র দত্ত, নগেন্দ্রনাথ শ্যাম, দেবব্রত দত্ত, বৈকুন্ঠ চরণ গুপ্ত, জয়কুমার দেব, নসিব আলি মজুমদার প্রমুখ ব্যক্তিগণ তাদের প্রথম বসত তৈরি করেন। এই এলাকা থেকেই রাজনীতিতে বিপুল অবদান রেখে গেছেন অরুণ কুমার চন্দ, অচিন্ত্য ভট্টাচার্য, জ্যোৎস্না চন্দ, তারাপদ ভট্টাচার্য, নন্দকিশোর সিংহ, দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, পরেশ চন্দ্র চৌধুরী, দ্বারিকা প্রসাদ তেওয়ারি, গৌরী শংকর রায়, নলীনাক্ষ চৌধুরী, রশিদা হক চৌধুরী, জগন্নাথ সিংহ, মতিলাল জায়গীরদার, সমরেন্দ্রনাথ সেন, কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ। আজও রাজনীতির আঙিনায় যথেষ্ট সক্রিয় বর্ষীয়ান নেতা কবীন্দ্র পুরকায়স্থ। শচীন্দ্র মোহন দত্ত (লাখু দা), সরোজ কুমার দাস প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই অঞ্চলেরই সম্পদ। ক্যাপ্টেন নলিনী মোহন গুপ্ত, খগেশ চন্দ্র সেন, ডোনাল্ড ক্রোজিয়ার প্রমুখ বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়া সংগঠকেরা এই এলাকারই সন্তান। ১৮৬৩ সালে এখানেই গড়ে ওঠে শহরের প্রথম বিদ্যালয় গভর্নমেন্ট বয়েজ স্কুল, ১৮৮২ সালে শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান অভয়াচরণ ভট্টাচার্য পাঠশালা এবং ১৮৯১ সালে প্রথম মেয়েদের স্কুল, মিশন গার্লস স্কুল, পরবর্তীতে যা গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল নামে পরিচিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ঢেউয়ের শীর্ষে এই এলাকাতেই গড়ে উঠে প্রথম মেয়েদের স্বদেশী স্কুল ‘দীননাথ নবকিশোর বালিকা বিদ্যালয়’ এবং প্রথম ছেলেদের স্বদেশী স্কুল ‘কাছাড় হাইস্কুল’। আসামের প্রথম বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র ‘প্রান্তজ্যোতি’ এই এলাকা থেকেই প্রকাশিত হয় জ্যোতিরিন্দ্র দত্ত (কালা দা)র সম্পাদনায়।
১৮৮২ সালে যখন শিলচরের প্রথম নাগরিক সংস্থা ‘স্টেশন কমিটি’ গঠিত হয়, সেই দিন থেকেই মালুগ্রাম অঞ্চল শহরের এক নম্বর ওয়ার্ডের মর্যাদা পেয়ে আসছে। আজও সেই মর্যাদা অক্ষুন্ন রয়েছে। জন্মলগ্ন থেকেই মালুগ্রাম সহ শহরের এই কেন্দ্রীয় অঞ্চল শিলচর বিধানসভা চক্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ এলাকাবাসীর আত্মমর্যাদায় চরম আঘাত হেনে সাম্প্রতিক ডিলিমিটেশন খসড়ায় যুক্তিহীন ভাবে পুর এলাকার এক, দুই, তিন, চার, ছয় এবং সাত নম্বর ওয়ার্ডকে উধারবন্দ বিধানসভার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
একে নিন্দনীয় বলে অভিহিত করেছে প্রস্তাবিত ডিলিমিটেশন প্রতিবাদী মঞ্চ৷ তাঁদের কথায়, “কোনও যুক্তিতেই এই উদ্ভট প্রস্তাব আমরা এ অঞ্চলের জনসাধারণ মেনে নিতে পারি না। তুঘলকি এই সিদ্ধান্ত কোন বুদ্ধিতে নেওয়া হয়েছে তা কোনও ভাবেই আমাদের বোধগম্য হচ্ছে না। কেন না, এই ডিলিমিটেশন গৃহীত হলে কাছাড় জেলার জেলাশাসকের কার্যালয়, জেলা ন্যায়াধীশের আদালত, জেলা পরিষদের কার্যালয়, শিলচর পুরসভার কার্যালয়, হেড পোস্ট অফিস, ট্রেজারি ইত্যাদি অনেক অফিস আদালত চলে যাবে উধারবন্দ বিধানসভা এলাকায়।” এটা কী একটা বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত হতে পারে, প্রশ্ন মঞ্চের৷
ডিলিমিটেশন একটি সংবিধান স্বীকৃত প্রক্রিয়া। ডিলিমিটেশন কমিশনের তত্ত্বাবধানে ১৯৭৬ সালে শেষবার সারা দেশেই ডিলিমিটেশন হয়েছিল। আগামী ডিলিমিটেশন হওয়ার কথা ২০২৬ সালের পর। কিন্তু নিয়ম কানুন সংশোধন করে শুধু আসামেই এবার ডিলিমিটেশন করা হয়েছে। সেখানেও রয়েছে আরেক প্রশ্ন। ডিলিমিটেশন কমিশনের অধিকার কর্তন করে এই ডিলিমিটেশন করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের আওতায়। কেন ডিলিমিটেশন কমিশনের হাত থেকে এই দায়িত্ব সরিয়ে নেওয়া হলো? কেন ২০২৬ এর বদলে ২০২৩ সালেই এই ডিলিমিটেশন করা হলো? কেনই বা সারা দেশের সাথে একসাথে না করে শুধু আসামেই এই ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া তড়িঘড়ি করে করার চেষ্টা হচ্ছে? নিয়ম অনুযায়ী জনগণনার রিপোর্টে প্রাপ্ত দেশের জনসংখ্যার নিরিখে বিধানসভা ও লোকসভার আসন সংখ্যা বাড়ানো বা কমানো হয়। কিন্তু বিধি অনুযায়ী, ২০২৬ সালের আগে আসামে বিধানসভার ১২৬টি আসন এবং লোকসভার ১৪ টি আসন সংখ্যার হেরফের করা যাবে না। তা হলে কোন যুক্তিতে ৪৪ লক্ষ জনসংখ্যার বরাক উপত্যকা থেকে দুটো বিধানসভার আসন কমিয়ে ১৫ থেকে ১৩ করা হলো? আর কোন যুক্তিতেই সেই আসন দুটি নিয়ে গিয়ে ১৬ লক্ষ জনসংখ্যার বোড়ো টেরিটোরিয়াল রিজিওনের ১৬ আসনের জায়গায় ১৯ আসন করে দেওয়া হলো? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, এই ডিলিমিটেশনের ফলে রাজ্যের ভূমিপুত্ররা অধিক শক্তিশালী হবে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে আসে, বরাকের অধিবাসীদের কি তিনি ভূমিপুত্র মনে করেন না? যদি মনে করেন, তবে আসন সংখ্যা কমিয়ে কি তিনি আমাদের শক্তিশালী করতে চাইছেন! সরকার আজ পর্যন্ত ভূমিপুত্র (খিলঞ্জিয়া) শব্দের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে না পারলেও মুখ্যমন্ত্রীর এই বক্তব্য থেকে পরিস্কার যে, তিনি ছলে বলে কৌশলে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষী সহ সমগ্র অনসমিয়া জনগণকে স্পষ্টতই হীনবল করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ডিলিমিটেশন নিয়ে তদারকি করার জন্য রাজ্য সরকার মাননীয় মন্ত্রী অশোক সিংহলের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছিল। রাজ্যের ৩০ শতাংশেরও অধিক বঙ্গভাষী হওয়া সত্বেও একজনও বাঙালি বিধায়ককে সেই কমিটিতে রাখা হলো না কেন? এই প্রশ্নেরও কোনও জবাব পায়নি বলে অভিযোগ৷
তাঁরা বলেন, বরাক উপত্যকা থেকে নির্বাচিত কয়েকজন জনপ্রতিনিধি এ ব্যাপারে অভিযোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন। যারা গিয়েছিলেন, তারা ফিরে এসে বরাকের সাধারণ মানুষকে তাঁদের সেই সাক্ষাৎ এবং আলোচনার ফলাফল নিয়ে কিছু জানাননি। কিন্তু গুয়াহাটি থেকে প্রচারিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, মুখ্যমন্ত্রী নাকি তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। যদি তা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে মঞ্চ মনে করে, মুখ্যমন্ত্রী সমগ্র বরাকবাসীকেই অপমান করেছেন। তারা জানিয়েছে, “আমরা সেই অপমান মেনে নিতে প্রস্তুত নই। জাতি ধর্ম, দল মত নির্বিশেষে সর্বশক্তি দিয়ে আমরা তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
তাঁদের কথায়, আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট।
১) ২০২৬ সালের পর সারা দেশে যখন ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া সংঘটিত হবে, আসামেও তখনই সারা দেশের সাথে সর্বশেষ জনগণনার ভিত্তিতে ডিলিমিটেশন কমিশনের তত্বাবধানে এই কাজ করা হোক।
২) ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া তত্বাবধানের জন্য যদি কোনো রাজ্যভিত্তিক কমিটি গঠিত হয়, জনসংখ্যার অনুপাতে সেই কমিটিতে সমস্ত ভাষাভাষী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
৩) বরাক উপত্যকা থেকে দুটি বিধানসভা আসন কমিয়ে দেওয়া আমরা কোনও ভাবেই মেনে নেব না।
৪) শিলচর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র মালুগ্রাম-জানিগঞ্জ-সেন্ট্রাল রোড এলাকাকে কেটে অন্য কোনও বিধানসভা এলাকার সাথে যুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাহার করতে হবে।
৫) কমিশনের নির্দেশিত সমস্ত নিয়মাবলী উপেক্ষা করে ডিলিমিটেশনের নামে বিধানসভা এলাকাগুলির যেমন ইচ্ছা তেমন কাঁটাছেঁড়া করা মানবো না।
জনগণের উদ্দেশে তাদের আর্জি, “সমগ্র এলাকাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সব ধরণের সহযোগিতা ব্যতীত এই লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তাই দল মত নির্বিশেষে আমরা এ ব্যাপারে একমত হয়ে প্রস্তাবিত ডিলিমিটেশন প্রতিবাদী মঞ্চ গঠন করেছি।”
আন্তরিক আবেদন জানিয়ে বলেন, “আসুন, নিজেদের অধিকার, নিজেদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে, আমাদের আগামী প্রজন্ম যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, সেই স্বার্থে এই লড়াইয়ে আপনারাও শামিল হোন। আগামী দিনগুলিতে এই দাবি নিয়ে আমরা গণতান্ত্রিক ভাবে অবস্থান ধর্মঘট, মানব বন্ধন, প্রতিবাদী মিছিল, ধর্ণা, স্মারকলিপি প্রদান, সুপ্রিম কোর্টে ন্যায় বিচারের আবেদন ইত্যাদি চালিয়ে যাবো। আপনারা দলে দলে এইসব কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করুন৷”