NE UpdatesBarak UpdatesIndia & World UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

টিপাইমুখে গিয়ে দেখি, বাঁধের কিছুই নেই, লিখেছেন উত্তমকুমার সাহা

//উত্তমকুমার সাহা//

বরাক ড্যাম আনল কে? এমন স্লোগান শুনেই আসলে আমার টিপাইমুখের প্রতি আকর্ষণ জন্মায়৷ তখন মনে হয়েছিল, একবার সেখানে গেলে বরাক নদীর ওপর কত উঁচু বাঁধ নির্মিত হচ্ছে, তা দেখে আসা যাবে৷ বাঁধের উচ্চতা চোখে মাপারই  ইচ্ছে ছিল তখন৷ পরবর্তী সময়ে পরিতোষ পালচৌধুরী, পীযূষকান্তি দাস, অধ্যাপক পার্থঙ্কর চৌধুরীদের বাঁধ বিরোধিতা এবং বাংলাদেশের চরম আপত্তি টিপাইমুখ যাওয়ার আগ্রহ অনেকটা বাড়িয়ে দেয়৷ বরাক উপত্যকায় একের পর এক বন্যাও আমাকে টিপাইমুখের দিকে এগিয়ে দেয়৷ তবে এ কথা সত্য, বিবিসি বাংলার অমিতাভ ভট্টশালী “চলো, টিপাইমুখটা দেখেই আসি” বলে পরিকল্পনা না করলে আমার পক্ষে হয়তো যাওয়া সম্ভব হতো না৷ কারণ শিলচর থেকে মণিপুরের টিপাইমুখে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়৷

২০০৯ সালের ২১ জুলাই৷ লক্ষীপুর মহকুমার ফুলেরতল থেকে ইঞ্জিন বোট ভাড়া করে রওয়ানা হই৷ আমি, অমিতাভ এবং ইম্ফলের সাংবাদিক রূপাচন্দ্র৷ নৌকোর মাঝি ও সহকারী মিলিয়ে মোট পাঁচজন৷ এর আগে অবশ্য ফুলেরতল বাজার থেকে কিনে নিই চাল, ডাল, ডিম, সবজি, তেল, মশলা, পাউরুটি, পানীয় জল, কাগজের থালা-গ্লাস, আরও কত কী! সকাল দশটা বেজে যায় বাজার-হাট সেরে রওয়ানা হতে৷ একটু পরেই মাঝি তার সহকারীকে বললেন, রান্না বসিয়ে দিতে৷ তারা আগেই বলেছিলেন, স্টোভ-হাড়ি-কড়াই তাদের রয়েছে৷ ওইসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই৷ কিন্তু এ যে শুধু ওই তিন জিনিসই সে আর কে জানত! ডাল-ভাত তো হল, ডিম তরকারি কীসে রান্না করা ! শেষে ভাত  কাগজের থালায় ঢেলে ওই হাড়িতে তরকারি রান্না হল৷ মূল দায়িত্বে মাঝিরা থাকলেও পিকনিকের আমেজে আমরাও হাত লাগাই৷ দুপুরে খাওয়া শেষ করেই রাতের রান্না শুরু৷ তাঁরা বললেন, সন্ধ্যা হয়ে গেলে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাবে না৷ মাঝে একবার চাও হয়ে গেল৷

গল্প করতে করতে বেলা কেটে গেল৷ পঞ্চায়েত ভোট থেকে হোয়াইট হাউসের ক্ষমতা দখল কিছুই বাদ যায়নি৷ নেতামন্ত্রীদের নিয়ে হাসিঠাট্টাও হল৷ বিকেলে নদীর পারে এসে দুই যুবক আমাদের মাঝিকে ডাকাডাকি করলেন, তিনি গুরুত্ব দিলেন না!

আমাদের টিপাইমুখ যাত্রার শুরুর দিকে এক-দুটি নৌকো পাওয়া গিয়েছিল, উল্টোদিক থেকে তারা ফুলেরতলে যাচ্ছিল৷ সজোরে মাঝিদের মধ্যে মতবিনিময়ও হয়৷ কয়েকটি ছোট নৌকোকেও দেখা গিয়েছিল মাছের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে৷ কিন্তু উজানে গিয়ে আর কারও দেখা নেই৷ নারায়ণডহর,  বড় বেকরা, ছোট বেকরা, জখরাডহর পেরিয়ে চারদিকে শুধু জলস্রোত, আর এর মাঝে পাঁচ মানুষের এক বোট৷ জলের কী আওয়াজ! বোটের ভটভট শব্দ তখন কোথায় যেন হারিয়ে যায়৷ সন্ধ্যা নামতেই বীভৎস চেহারা৷ চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ মোবাইলে নেট নেই, ফোনেও সংযোগ বিচ্ছিন্ন৷ কেমন এক গা ছমছম করা পরিবেশ৷ নিজেদের মধ্যে কথাও যেন ফুরিয়ে গিয়েছে৷ তখনই মাঝি জানালেন, ভুলে টর্চ আনা হয়নি৷ মশাল জ্বালানোরও ব্যবস্থা নেই৷ তাঁর প্রস্তাব, “রাতটা নদীতীরে কাটিয়ে দিই৷ কাল ভোরে রওয়ানা হবো৷” আমরা রাজি হইনি৷ নদীর পারে রাতে কেউ যদি আক্রমণ করে বসে! মাঝনদীতে সেই আশঙ্কা নেই৷ এ ছাড়া, রাতারাতি পৌঁছনো গেলে ভোরে কাজ সেরে কাল দুপুরে বেরিয়ে পড়া যাবে৷ নইলে কালও আবার রাতের যন্ত্রণা ভুগতে হবে৷ কিন্তু এমন অন্ধকারে এগুনো কী করে! মাঝিরা বললেন, রাস্তা চেনা আছে, সোজা যাওয়া৷ ফলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷ ভয়ে ভয়ে তাদের অভয় দিলাম, এগুনো যাক৷ সবাই একযোগে মোবাইলের চার্জে যেটুকু দেখানো যায়, দেখালাম৷ রাত নয়টা নাগাদ চিৎকার করে ওঠেন মাঝি, বিশাল এক পাথরে ধাক্কা খাচ্ছিল আমাদের মোটরবোট৷ লাগলে নির্ঘাৎ উল্টে যেত৷ সে ক্ষেত্রে আমাদের পাঁচ প্রাণী মুহূর্তে তলিয়ে যেতাম৷ নিকষকালো অন্ধকার, সঙ্গে তীব্র জলস্রোত৷ সাঁতার জানা না জানা সেখানে একই কথা৷  ভাগ্যিস, ধাক্কা লাগার ঠিক আগ মুহূর্তে মাঝির নজরে পড়ে যায়৷ ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বাঁক কাটান৷ তা করতে গিয়েও ঝুঁকি কম ছিল না৷ আমরা যখন বিষয়টি বুঝতে পারি, গা শিউড়ে ওঠে৷ সামনে আরও কি বিপদ অপেক্ষা করছে কে জানে! তখন আমাদের মনে হচ্ছিল, মাঝির কথা মেনে নিয়ে নৌকো নোঙর করে রাতটা কাটিয়ে নিলেই ভালো হতো৷ এখন কি পারে ভিড়িয়ে নেওয়া যায় না! মাঝি বললেন, আর ভয়ের কিছু নেই৷ এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব টিপাইমুখে৷ তার কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম৷ কিন্তু বোটে আর গতি বাড়ানোর সাহস হচ্ছিল না তার৷ এখনই নৌকা পাল্টি খেত, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে অনেকটা সময় লাগে৷ এর ওপর, রাত যত বাড়ছিল, অন্ধকারের ভয়াবহতা আরও বাড়ছিল৷ শেষে রাত এগারোটায় আমরা গিয়ে পৌঁছালাম টিপাইমুখে৷ নৌকো ভিড়ানোর আওয়াজ পেয়ে গ্রামের কয়েকজন নদীতীরে আসেন৷ সাংবাদিক জেনে বললেন, “এত রাতে নৌকো থেকে নামবেন না৷ নৌকোতেই ঘুমোন৷ রাত পোহালে যে ধরনের সহায়তা প্রয়োজন, করা যাবে৷” সব মারদের মধ্যে একজন বাঙালিকে পেয়ে গেলাম৷ মনে হল, তাকে ধরেই সকালে কাজ হয়ে যাবে৷ সন্ধ্যার আগে রান্না হলেও নৌকোয় কারও কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল না৷ একে বিদঘুটে অন্ধকার, এর ওপর, বেঁচে গন্তব্যে পৌঁছনো যাবে কিনা, সেই ভাবনাতেই ক্লান্ত ছিলাম৷ এ বার পৌঁছাতে পারায় রাতের খাওয়া সেরে দ্রুতই  ঘুমিয়ে যাই ৷ রাত তিনটা নাগাদ আমার ঘুম ভেঙে যায়৷ প্রচণ্ড মশা৷ প্রকৃতির ডাক বোধ করি৷ কিন্তু নৌকো থেকে নামার উপায় নেই৷ এমন ভাবেই নোঙর করা যে, নৌকো আর পারের মাঝে অন্তত পঞ্চাশ মিটার দূরত্ব৷ সামনের দিকে তাকিয়ে ঘাবড়ে যাই৷ যেন সমুদ্রে দাঁড়িয়ে৷ ও পার দেখার জু নেই৷ এখানেই মিজোরাম থেকে বরাকে এসে মিশেছে তুইভাই নদী৷ প্রবল জলরাশি৷ আতঙ্কে বুকটা কেঁপে উঠল৷ এই জলে পড়ে গেলে আর রক্ষা নেই৷ ভয়ে প্রকৃতির সব ডাক বন্ধ হয়ে যায়৷ কিন্তু অস্বস্তিটা আর কাটছে না৷ শেষে চারটা বাজলে অমিতাভ উঠলেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যে রূপাও উঠে যান৷ দ্রুত নৌকো থেকে নেমে গ্রাম দেখতে বেরিয়ে পড়ি আমরা৷ ভোর পাঁচটার মধ্যে গোটা পাড়া জেগে গিয়েছে৷ এক দোকানে চা খেতে খেতেই কাজ শুরু হয়ে যায়৷ অপরিচিত তিনজনকে দেখে অনেকে সেখানে জড়ো হন৷ সবাই মার জনগোষ্ঠীর, হিন্দিটা বোঝেন৷ অনেকে ভালোই বলতে পারেন৷ টিপাইমুখবাসী একমাত্র বাঙালি উদয় দাসও এসে আলোচনায় সামিল হলেন৷ বললেন, তিনি ব্যবসা করতে বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে টিপাইমুখে যেতেন৷ পরে গ্রামের এক মার যুবতীকে বিয়ে করে এখন সেখানেই বসবাস করেন৷

প্রাথমিক কথাবার্তার পর গ্রামের পাঁচ-সাতজন আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলেন, বাঁধ বলতে তাঁদের এলাকায় কী কী রয়েছে, সে সব দেখাতে৷ পুরো পাড়া ঘুরে ঘুরে হিল-টপে উঠি৷ অনেকটা জঙ্গলঘেরা জায়গা পেরিয়ে দুটো ‘অস্তিত্ব’ দেখালেন গ্রামবাসী৷ একটি হচ্ছে হেলিপ্যাড হিসাবে ব্যবহৃত এক টুকরো সমতল ভূমি৷ সামান্য মাটি কেটে, মাটি ফেলে একেবারে সমান করা হয়েছিল ওই জায়গা৷ আগাছায় ভরে গেলেও, সেখানে হেলিপ্যাড তৈরি হয়েছিল, তা জানার পরে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় না৷ দ্বিতীয় অস্তিত্ব হল, ফলক লাগানোর জন্য ব্যবহৃত সিমেন্ট বাঁধাই একখানা দণ্ড৷ ফলক নাকি কবেই উধাও, দণ্ডটি দণ্ডায়মান দেখে মনে পড়ে গেল, কিছুদিন আগেই তৎকালীন শক্তিমন্ত্রী সুশীলকুমার সিন্ধেকে নিয়ে সন্তোষমোহন দেব টিপাইমুখ বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বহুমুখি প্রকল্পের শিলান্যাস করেছিলেন৷ গ্রামবাসী  জানালেন, শিলান্যাস মানে হেলিকপ্টার থেকে দুই মন্ত্রী নামলেন, প্রস্তরফলকের উন্মোচন করলেন৷ আবার আধ ঘণ্টার মধ্যে উড়ে গেলেন৷ পরে এক-দুইবার এক সংস্থার অফিসার-কর্মীরা গিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, রিপোর্টও জমা পড়েছিল৷ ব্যস৷

পাহাড় চূড়ায় শিলান্যাস তো হলো, বাঁধটা কোথায় হবে? গ্রামবাসী বললেন, “এই বাঁধ কখনও হবে না৷ আমরা হতে দেব না৷ সমগ্র গ্রাম উচ্ছেদ করে বাঁধ-বিদ্যুৎ কিছুই আমাদের চাই না৷ আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় সেটা হওয়ার কথা ছিল? এতক্ষণ চুপ করে থাকা বাঙালি যুবক উদয় দাস বললেন, ফেরার সময় কয়েকশো মিটার দূরে পাথুরে পাহাড়ের গায়ে লালকালিতে ড্যাম লেখা দেখবেন৷ আমাদের মাঝি এই কথা শুনেই বললেন, “আছে তো, যাওয়ার সময় দেখাবো৷” তাঁর কাছে আমাদের এই লেখা দেখার কৌতূহলটা বোকা-বোকাই ঠেকে৷ সকাল সাড়ে দশটায় টিপাইমুখকে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা হই আমরা৷

প্রায় পাঁচশো মিটার দূরে এসে খুঁজে পাই সেই ড্যাম লেখাটা৷ মন ভরল না৷ শুধু এইটুকু লেখাতেই এত কৃতিত্ব দাবি, সঙ্গে এত বিরোধিতা! বাংলাদেশে এত হইচই! নৌকো এগিয়ে চলল৷ ভাটার টানে দ্রুতই এগোচ্ছে৷ গল্প করে সময় কাটছিল৷ নৌকো নোঙর করে বরাকের জলেই স্নান হল৷ অন্য মাঝির কাছ থেকে মাছ কিনে দুপুরের রান্না-খাওয়াও হলো৷

কিন্তু তাল কাটে দুই বন্দুকধারী মার যুবক নৌকো থামানোয়৷ যাওয়ার সময় এখানেই নৌকো দাঁড় করানোর সঙ্কেত দিয়েছিল, এড়িয়ে গিয়েছিলেন মাঝি৷ এখন আর না থেমে উপায় নেই৷ মাঝিকে ধরে পাহাড়ের উপরে নিয়ে গেল এরা৷ তাকিয়ে দেখি, পতপত করে মার পিপলস কনভেনশনের পতাকা উড়ছে৷ একেবারে সেনা ছাউনির চেহারা৷ আধ ঘণ্টা পেরিয়ে যাচ্ছে,  কিন্তু মাঝি আর আসছেন না৷ কী হল? কী হবে এখন? নানা প্রশ্ন উঁকি দিতে থাকে৷ হঠাৎ তাঁর তীব্র চিৎকার কানে আসে৷ ও মাগো..ও মাগো৷ একবার…দুইবার…বেশ কয়েক বার৷ এখন কি এসে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে? অন্য জায়গা হলে পালানোর চেষ্টা করা যেত৷ নদীপথে কোথায় পালাব! নৌকো থেকে নেমে জঙ্গল ধরে হাঁটতে থাকলে কতদিনে কোথায় যাব কে জানে! দেশ-বিদেশের গল্প রসিয়ে বলতে থাকা তিন সাংবাদিকের মুখ তখন শুকিয়ে কাষ্ঠপ্রায়৷ মণিপুরি যুবক বলে রূপাচন্দ্রকে অমিতাভ একটু কথা বলে দেখতে বলে৷ রূপা জানান, তিনজনকে ধরে নিয়ে গেলে তাঁরই বেশি বিপদ হবে৷ এরা মার জনগোষ্ঠীর, মণিপুরি নয়৷ তাদের ভাষাও রূপা বুঝতে পারেন না বলে ফিসফিস করে জানান৷ প্রতিটি সেকেন্ডে মনে হচ্ছিল কোন অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছি৷ কিছুক্ষণ পরে নেমে এলেন মাঝির সহকারী৷ দ্রুত ৫০০ টাকা দিতে বললেন৷ অমিতাভ কোনও কথা না বলে টাকা দিয়ে দিলেন৷ ৫০০ কেন, ৫০০০ বললেও দিতে তৈরি তখন৷ এর পর অবশ্য বেশি সময় লাগেনি৷ নেমে আসেন মাঝি, পেছনে তাঁর সহকারী৷ সবাই আমরা মাঝিরই মুখের দিকে তাকিয়ে৷ কিছু কি এখন জিজ্ঞাসা করা উচিত? প্রথমে কী জানতে চাওয়া যায়, ওই সব ভাবতেই ভাবতেই অমিতাভ প্রথম মুখ খুললেন৷ মিটল সব ঝামেলা? এখন যেতে অসুবিধে নেই তো?

মাঝি মুখ খুললেন না৷ কষ্ট করে বোটের ইঞ্জিন চালালেন৷ সহকারী প্রায় কানে কানে বললেন, যাওয়ার সময় ডাক না শোনায় প্রচণ্ড মারপিট করেছে ওরা৷ তাকে অবশ্য কিছু করেনি৷ বাকি পথ কেউ আর কোনও কথা বলিনি৷ নীরবেই চলে আসি ফুলেরতলে৷

(সৌজন্যঃ মানস ভট্টাচার্যের ‘শিলচরের দুঃখ– বন্যা ও জমা জল’ গ্রন্থ)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker