Barak UpdatesAnalytics

কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে-২, লিখেছেন উত্তমকুমার সাহা

কাঁটাতারের বেড়াঃ ভিতরে ও বাহিরে-২

।।উত্তমকুমার সাহা।।

ভিতরে

গত বছরের ঘটনা। সকলের চোখের সামনে বেড়ে ওঠা সীমারানি বর্ধন ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের রায়ে বিদেশি হয়ে গেলেন। কাছাড় জেলার লক্ষ্মীপুর মহকুমার জয়পুরে বাড়ি তাঁর। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বলছিলেন, তার জন্ম, শৈশব, কৈশোর, বিয়ে, স্বামীর মৃত্যু — সবই তাঁদের দেখা। শুধু একটাই সমস্যা, তিনি যে নিরঞ্জন বর্ধনেরই মেয়ে, তা প্রমাণের মতো কোনও নথি সীমারানির হাতে ছিল না। কারণ সেই সময়ে জন্মের শংসাপত্র অনেকে তৈরি করতেন না। এর কোনও প্রয়োজনীয়তাও বোধ হতো না তখন। দ্বিতীয়ত, কোনওদিন স্কুলের বারান্দায় পা না রাখায় স্কুল সার্টিফিকেট সংগ্রহেরও ব্যাপার নেই। তৃতীয়ত, ভোটের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায় বলে বিবাহ-পূর্ব ভোটার তালিকাতে তাঁর নাম থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ফলে ছেলেমেয়েদের হাউমাউ কান্নার মধ্যেই তাঁকে এগিয়ে যেতে হয় জেলের মহিলা সেলের দিকে।

এ বার এনআরসি নবায়নের সময় দেখা গেল, বাবা-মেয়ে প্রমাণের নথি নেই অনেকের। বিশেষ করে, সীমারানির মতো কম বয়সে বিবাহিতা, নিরক্ষরদের সে সুযোগও নেই। অনেক প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা স্কুলে পড়লেও সেই সার্টিফিকেট হয়তো কোনওদিন আনার প্রয়োজন পড়েনি। আর যাঁরা স্কুল থেকে এনেছিলেন, তাঁরাই বা  কতদিন একে ধরে রাখবেন! অন্যদিকে যাঁরা আনেননি, ৪০-৫০ বছর আগের ওইসব নথি এখন স্কুলে গিয়ে খুঁজে পাচ্ছেন না। এই তিন শ্রেণি মিলিয়ে রাজ্যে ২৯ লক্ষ মহিলার একই সমস্যা। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এনআরসি-র ক্ষেত্রে বর্তমান পঞ্চায়েত সচিবের সার্টিফিকেটকে মান্যতা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত সচিব বাবা-মেয়ের কথা লিখে দিলেই হল। তাতে প্রমাণ মেলে, সব রাজ্যে, প্রতিটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে মহিলাদের নথিপত্র সংক্রান্ত সমস্যা রয়েছে। তাঁদের কারও কখনও ভোগান্তির মুখে পড়তে হয় না। অসমের বাঙালি বলে সীমারানিকে জেলের ঘানি টানতে হলো।

সীমারানির মতো জেলে যেতে হয়েছে জিরিঘাটের কাজলবালা নমঃশূদ্রকেও। তাঁর অপরাধ যে কী, কাজলবালা আজও বুঝতে পারেননি। তিনি মণিপুরের জিরিবামের কালীকুমার নমঃশূদ্র ও রেখাবালা দেবীর মেয়ে। বিয়ে হয়েছে অসমের জিরিঘাটের অনিল দেবের সঙ্গে। পুলিশ তাঁকে বিদেশি বলে সন্দেহ করলে ১৯৭১-র আগের জমির নথি দেখান। কিন্তু সেখানে কালীকুমার নমঃশূদ্রের জায়গায় লেখা রয়েছে কালীচরণ নমঃশূদ্র। অসমের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম কাজল দে, স্বামী অনিল দে। নামবিভ্রাট এখানেই শেষ হয়নি। পুলিশ যে বিদেশি সন্দেহ করে তাঁর নামে নোটিশ পাঠিয়েছে, সেখানে স্বামীর নাম আর বাবার নাম গুলিয়ে ফেলা হয়েছে। লিখে দিয়েছে, স্বামী কালীকুমার দেব। আদালত নামবিভ্রাটের বিষয়টিই বুঝতে চায়নি। এই সব ভুলভ্রান্তিতে যে তাঁর কোনও ভূমিকা ছিল না, সে কথাটা বোঝানোই যায়নি বিচারককে। কী আর করা! জেলেই যেতে হলো অসমের বাঙালি বধূকে।

সীমারানি বা কাজলবালার মতো মহিলাদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত সমস্যা তীব্রতর। কারণ বিবাহিত মহিলাদের অধিকাংশ মনে করেন, বিয়ের পর স্বামীর পরিচয়েই তিনি পরিচিত। তাই বাবার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কাগজপত্রে কেউ গুরুত্ব দেন না। দীর্ঘদিনের  ব্যবধানের দরুন বহু কাগজপত্র পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে যায়, খোয়াও যায়। অসমে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জটিলতায় তাঁরা এখন বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছেন।

তাই বলে পুরুষরা সঙ্কটমুক্ত, তা কিন্তু নয়। উধারবন্দের মানিক দাসের কথাই ধরা যাক। কলা ফেরি করেন। হাটবারে বাজারে বসেন। তেমনই এক হাটবারে পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে গেল। কী অপরাধ, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। পুলিশ জানাল, তিনি বিদেশি। ট্রাইব্যুনাল তাঁকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার নির্দেশ দিয়েছে।

কী করে হঠাত বিদেশি হয়ে গেলেন? এমন কথা-ই বা কী করে এলো? বিচারক তাঁকে না ডেকে রায় দিলেন কী করে? মানিকবাবু কোনও প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। শেষে জানতে পারেন, স্থানীয় পুলিশই তাঁকে বিদেশি সন্দেহে তাঁর নামে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করেছিল। ট্রাইব্যুনাল নোটিশ পাঠালেও তা তাঁর বাড়ি গিয়ে পৌঁছয়নি। খোঁজাখুজির পথে না গিয়ে মানিকবাবু হদিশশূন্য বলে বিচারককে জানিয়ে দিলেন। এরই জেরে একতরফা রায়। বিদেশি বলে ঘোষণা করে দেশ থেকে বহিষ্কারের রায় দেন বিচারক। এর পরেই আচমকা কলার দোকান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ তখনও তাদের দেশে পুশব্যাক বা ঠেলে পাঠানোতে আপত্তি তত তীব্র করেনি। ফলে এটা রীতিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, ট্রাইব্যুনাল বিদেশি বলে চিহ্নিত করার পরে করিমগঞ্জ জেলার মহিশাসন সীমান্ত দিয়ে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হতো। মানিক দাসকেও পুলিশ-বিএসএফ মারতে মারতে সীমান্ত পার করে দেয়। কোনওদিন দেখেনি যে দেশ, সে-ই কিনা তাঁর নিজের দেশ বলে নির্ধারিত হলো! ওখানে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, দিশেহারা মানিকবাবু। উদ্দেশ্যহীন ঘুরতে ঘুরতে পড়ে যান সে দেশের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে। তাঁরা তাঁকে ফের জঙ্গলের পথ ধরে ভারতে ঢুকতে বাধ্য করেন। জঙ্গল পেরিয়ে জনপদে এসে মানিকবাবু খুব কষ্টে বাড়ির সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। তাঁরাই তাঁকে রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। দরজাবন্ধ ঘরে দিন কাটছিল তাঁর। ও দিকে, নিজেকে ভারতীয় প্রমাণের জন্য মানিকবাবুর হাতে যথেষ্ট নথি রয়েছে। একতরফা রায়ে বিদেশি বলে চিহ্নিত হওয়ায় কেউ সে সব দেখতেই চাইলেন না। মানিকবাবু বাড়ি ফিরে আসায় এ বার সে সব দেখানোর মনস্থ করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে আপিল মামলা করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ, শুনানির পরে আদালত তাঁকে ভারতীয় বলে ঘোষণা করে।

এই ঘটনায় প্রমাণিত, সন্দেহভাজনদের অনেকের কাছে ট্রাইব্যুনালের নোটিশ পৌঁছয়ই না। ফলে ট্রাইব্যুনালে হাজিরার দিনক্ষণ তাঁদের জানা হয় না। আদালত তখন তাকে একতরফাভাবে বিদেশি বলে রায় দেয়। নাগরিকত্ব প্রমাণের পর্যাপ্ত নথি হাতে থাকলেও সে সময়ে ডিটেনশন ক্যাম্প নামের জেলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। অর্থ এবং শিক্ষায় যারা এখনও অনেকটা পিছিয়ে, তাঁদের আপিল জানানোর সুযোগ গ্রহণ আর হয় না। বিনা অপরাধে শুরু হয় তাঁর কারা-জীবন। এ ভাবে কত নিরপরাধী বাঙালি যে অসমের জেলগুলিতে শাস্তি ভোগ করছেন। পুশব্যাকের সময় কতজন যে বাংলাদেশে গিয়ে ভিক্ষুকের জীবন কাটিয়েছেন, মানিক দাসের কাহিনি থেকে তা অনুমান করা যায়। ভাগ্য ভালো, মানিকবাবুকে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী ফের ভারতে ঠেলে পাঠিয়েছিল। আদালতে আপিল করে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণে সক্ষম হয়েছিলেন মানিকবাবু। কতজনের কপালে আর কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণের সুযোগ মেলে!

(সৌজন্য স্বীকারঃ অনিমা বিশ্বাস, গাঙচিল কর্তৃক প্রকাশিত ও ঝুমুর পাণ্ডে সম্পাদিত ‘দেশভাগ এক দহন-যন্ত্রণা’)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker