Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

মোবাইল অফ, হাঁক-ডাকে যতটুকু পেরেছি, সাহায্য চেয়েছি, লিখেছেন শতাক্ষী ভট্টাচার্য

বন্যার্তের ডায়েরি (নয়)

শতাক্ষী ভট্টাচার্য

প্রকৃতির কোলেই আমাদের রাত-দিন। এই প্রকৃতিই আমাদের আগলে রাখে। আবার এই প্রকৃতি যখন বিরূপ হয়ে যায়, সেটা সামাল দেওয়া কতটুকু চ্যালেঞ্জের, এবারের বন্যা অন্তত তা উপলব্ধি করিয়েছে। প্রতিকূলতা এমন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, বাঁচার লড়াইয়ের মহড়া দিতে হয়েছে প্রতি মুহূর্তে। তাও এক মাসের মাথায় দু’বার প্রবল বন্যার মুখে পড়তে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, দ্বিতীয় জলপ্লাবন যে শুধু আমাকে নিঃস্ব করেছে তা নয়। এই জলস্রোতে বিষয়-সম্পত্তি হারিয়েছেন অনেকেই। নতুন করে ঘর-বাড়ি সাজাতে হচ্ছে। আবার অনেকে হয়তো মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য সরকারের ঘোষিত অনুদানের অপেক্ষায় রয়েছেন। যাই হোক, আমি আমার কথাই বলছি।

আমি খুব ছোট ছিলাম, যখন বিবেকানন্দ রোডের এই বাড়ি বানানো হয়। মাতৃমন্দির থেকে কলেজ রোড-মুখো বিশেষ করে বাঁদিকের এই পুরো এলাকাটাই মালিনিবিল ঘেঁষা। ফলে ঘর-বাড়ি বানানোর আগে যে যাঁর মতো করে সম্ভাব্য জলপ্লাবন থেকে রক্ষা পাওয়ার রাস্তা খুঁজে বসতবাড়ি করেছেন। হয়তো গড় সুরক্ষার পরিকল্পনা কারও কম, কারও বেশি ছিল। বাবা প্রয়াত নির্মলকান্তি ভট্টাচার্যও এমন ভাবনার বাইরে ছিলেন না। তাই , এই বাড়ি নির্মাণের প্রায় চার দশক ছুঁই ছুঁই হলেও এমন বন্যা দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। ২০২২-এর পর তো আর এমনটা বলার অবকাশ নেই। এবারের মে মাসে যখন ঘরে প্রথম জল ঢোকে, তখন এটাই ইতিহাস ছিল আমার কাছে। তবে আমাদের বাড়ির বড়দের কথায়, আগেও একবার জল ঘরের ফ্লোর ছুঁয়েছিল। কিন্তু তখন দুর্ভোগের পরিমাপ ছিল একেবারেই কম। তিন যুগ কেটে গেছে। পরিবর্তন ও উন্নয়নের ধারায় আমরা গর্বিত। তারপরও এমন দুর্বিষহ অবস্থা কীভাবে অনুমান করতে পারি!


২০ জুন যখন ফের ঘরে জল ঢুকল, আমি কিন্তু কখনও ভাবিনি যে, সব অনুমানকে নস্যাৎ করে পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোরটাই জলের তলায় চলে যাবে। ফলে, কোনও সতর্কতাই শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি। একরাতেই ঘরে হাঁটু জল হয়ে যায়। তারপর তো একটু একটু করে প্রতিকূলতার দিকে। নেটওয়ার্ক গেল, বিদ্যুৎ সংযোগ চলে গেল, জলের সমস্যা, খাবার সমস্যা সবকিছু যেন গ্রাস করে নিল দেখতে দেখতে। হাতে টাকা নেই। এটিএম বন্ধ। মোবাইল অফ থাকায় অনলাইন পেমেন্টের বিকল্পও নেই। দুর্বিষহ পরিস্থিতির এমন নমুনার মোকাবিলা কী করে করব, তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। কারণ, ওই সময় বাড়ির পুরো দেখভালের দায়িত্ব আমার কাছেই ছিল। কীভাবে ঘরের সত্তরোর্ধ্ব অসুস্থ দুই বৃদ্ধা ও একটি আট বছরের শিশুর মুখে খাবার তুলে দেবো, খাবার জল জোগাড় কীভাবে হবে, সেটাই ছিল আমার কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ প্রতিবেশী সবারই প্রায় একই অবস্থা।

যদিও, অন্যদের তুলনায় প্রতিকূলতা মোকাবিলায় আমি ছিলাম অপ্রস্তুত। ম্যান পাওয়ার একেবারেই ছিল না ওইসময়। আমিই ছিলাম একমাত্র ভরসার জায়গা। নিজের পরিচিতদের সঙ্গে যেভাবে পারি, হাঁক-ডাকে যতটুকু পারি, যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। সাহায্য চেয়েছি। যখন পুরো নিরুপায় অনুভব করছিলাম, ঠিক তখনই শিলচর সহ বরাকের গ্রাম-গঞ্জের বেসরকারি সংগঠনগুলো যেন দেবদূতের মতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। অনেকে বাড়ির ঠিকানা খোঁজ করে করে ত্রাণসামগ্ৰী দিয়ে গেলেন। এমনকী আমার সহপাঠী, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত যাঁরা দিল্লি, বেঙ্গালুরুতে আছেন তাঁদের সোর্স থেকেও পর্যাপ্ত সাহায্য এসেছে। আলাদা করে বলতে হয়, মহর্ষি বিদ্যমন্দিরের আমার সহকর্মীদের কথা। তাই প্রত্যেকের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ রয়েছে আমার। আর থাকবেও। বলতে পারি, সহযোগিতার ভরসায় সময় কাটছিল। কদিন তো এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল পরস্থিতি যে, কোনওভাবে বৃদ্ধ মা ও সন্তানকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখতে হয়েছে। যাই হোক ছিল শুধু অপেক্ষা। কখন জল কতটুকু কমে, সেটা অনুমান করে মনকে শান্তি দেওয়া। রাতে ঘুম নেই, কারণ চাউর হয়েছিল চোরের উপদ্রবের কথা। তাই দোতলায় দাঁড়িয়ে বা বসে রাত জাগা ছাড়া উপায় ছিল না। সমস্যা কিন্তু এখানেই শেষ ছিল না। পাড়ার এক বাড়িতে হেলিকপ্টার থেকে সরকারি ত্রাণের প্যাকেট ফেলার সময় আমাদের জানালাটা ভেঙে চৌচির। ভাগ্যিস, কেউ তখন খোলা ছাদে ছিলেন না। না হলে হয়তো অন্য মোড় নিত পরিস্থিতি। আরও বিপজ্জনক অবস্থা হতো আমাদের।

আমরা যেহেতু গ্রাউন্ড ফ্লোরে সেটল ছিলাম, তাই আসবাব পত্র থেকে শুরু করে রান্না-বান্না, পড়াশোনা সবই ছিল ওখানে। তাই ক্ষতির অনুমানই বসে বসে করতাম। যদিও কোনও কূল পাওয়া ছিল ভার। ৭/৮ জুলাই যখন জল উঠোন থেকে নামল, গ্রাউন্ড ফ্লোরের দরজা খুলে দেখা গেল পুরনো স্মৃতি সবই শেষ। এমন-কি বাবার ছবিটা পর্যন্ত নেই।

এটা ঠিক , টানা কবছর ধরে বিপর্যয়ের মধ্যে আছি আমরা। করোনার কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছি। এবারে বন্যার কোপ। তবে আমি বলব, করোনা মানসিক ও আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে আমাদের। ঘর-বাড়ির সংরক্ষিত স্মৃতি কেড়ে নেয়নি। এই বন্যাপ্লবন তো অনেকের স্মৃতিটুকুও কেড়ে নিয়ে গেছে। আমিও এই অনেকের মধ্যে একজন। নতুন করে ঘর সাজাতে গিয়ে প্রতি মুহূর্তে এই উপলব্ধি হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রস্তুতির অভাব ও খামখেয়ালিপনার ফলাফল কী হতে পারে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, গাফিলতিটা কার? চারপাশে কান পাতলে এমন বহু প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়া যায়। তাছাড়া ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে’ গানের লাইনের সার্থকতাও যেন একশ ভাগ ফুটে উঠেছে এই জলপ্লাবন ঘিরে। এত প্রতিকূলতা ও দুর্ভোগের পরও আমার কাছে একটা সন্তোষের জায়গা এটাই।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker