Barak UpdatesBreaking NewsFeature Story
তাকাও স্নিগ্ধ নয়নে, সুলক্ষণে…. লিখেছেন শাশ্বতী ভট্টাচার্য
“তাকাও স্নিগ্ধ নয়নে, সুলক্ষণে চিরদিন থাকো পতির সঙ্গে সঙ্গী জীবনে মরণে
কল্যাণী, করো পশুদের মঙ্গল,
সুন্দর রাখো মনটি তোমার, রূপে হও উজ্জ্বল ।
বীরমাতা হও, সুখদা, কোমলা, মন রাখো ভগবানে।
মানুষকে দিও শান্তি, শান্তি দিও প্রিয়ে, পশুগণে।”
– বেদ বিশেষজ্ঞ গৌরী ধর্মপালের ‘পুরোনোতুন বৈদিক বিবাহ পদ্ধতি’ গ্রন্থ থেকে ঋকবেদের অন্যতম প্রধান সূক্ত নারী ঋষি সূর্যা রচিত বিবাহ সূক্তের, শুভদৃষ্টির বাংলা অনুবাদ। সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালি মহিলা যিনি একাই দায়িত্ব নিয়ে পুরো বিবাহে পৌরোহিত্য করেন।
গৌরী ধর্মপালের নিজের বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন মহিলা পুরোহিত। ঊনিশশো সাতষট্টির চৌদ্দই ডিসেম্বরে ঘরোয়া ও অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গৌরী ধর্মপাল ও গৌতম ধর্মপালের বিবাহে যৌথভাবে পৌরোহিত্য করেন বেদ বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ এবং নারায়ণী দেবী। গৌরী ধর্মপাল বিয়ের সেই সংস্কৃত মন্ত্রগুলির ছন্দবদ্ধ বাংলা অনুবাদ করে লিপিবদ্ধ করেন, ‘পুরোনোতুন বৈদিক বিবাহ পদ্ধতি’ সংকলনে। এরপর অনেকেই এই বিবাহ পদ্ধতি অনুসারে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে আগ্রহী হন। অপর্ণা সেনের বড় মেয়ে,বাণী বসুর মেয়ের বিয়ে এই বৈদিক পদ্ধতিতে করান গৌরী ধর্মপাল ও তাঁর ছাত্রীরা। নন্দিনী ভৌমিক নামের এক ছাত্রীও গৌরী ধর্মপালের অনুমতি নিয়ে এই পদ্ধতিতে বিয়ে দেওয়া শুরু করেছিলেন। একমাত্র মেয়ের বিয়েও এভাবেই দেন গৌরী।
গৌরী ধর্মপালের মৃত্যুর পর এক সময় নন্দিনী ভৌমিক প্রথম মহিলা পুরোহিত হিসেবে পরিচিত ও বিতর্কিত হন। গৌরী ধর্মপাল বেঁচে থাকার সময় যদিও তিনি গুরুর নাম স্বীকার করতেন, পরে প্রথমা হবার প্রচেষ্টায় তাঁকে অস্বীকার করেছিলেন। গৌরীর কন্যা রোহিনী ধর্মপাল ও অন্যান্য ছাত্রীদের প্রতিবাদের পর পরবর্তীতে তিনি গুরু গৌরীর ভূমিকা স্বীকার করতে বাধ্য হন। গৌরীর সুযোগ্যা কন্যা শিক্ষাবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ও বিশিষ্ট লেখিকা রোহিণী ধর্মপাল এখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই পদ্ধতিতে বিয়ে করিয়ে চলছেন। মায়ের অনুবাদ করা বাংলা শ্লোকের পাশাপাশি গৌরীর মতোই বিবাহ আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহারও করেন তাঁরা। এই বিয়েতে কন্যাদান করা হয় না।
অরিত্র মুখার্জির নির্দেশনায়,দুহাজার কুড়িতে এই বিষয়ের উপর মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা সিনেমা ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মোটি’ বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ঋক্ বেদের দশম মণ্ডলের বিবাহ সূক্তে কন্যাদানের কোনও মন্ত্র নেই, তাই পাত্র-পাত্রী ও তাদের পরিবারের মতামত নিয়েই এই প্রথা পালন করা হয় না। বিবাহ সূক্ত নারী ঋষি সূর্যার রচিত বলে মেয়েদের পৌরোহিত্যে কোনো আপত্তির কারণ দেখতে পান না ওঁরা। বৈদিক নারীরা বিদ্যাচর্চা ও যাপনে পুরুষদের সমকক্ষ ছিলেন। ব্রহ্মবাদিনী নারীরা অনেকেই উপবীত ধারণ করে, আজীবন কুমারী থেকে, ধর্ম ও বিদ্যার চর্চা করে যেতেন। কন্যা বিবাহের উপযুক্ত হলে নিজেই নিজের পাত্র নির্বাচনের অধিকার রাখতেন। রাজকন্যারা স্বয়ম্বরা হতেন। পৌরানিক মতে ভারতবর্ষের নামকরণ হয়েছে শকুন্তলা-দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নামে। সেই শকুন্তলা আর দুষ্মন্তের বিয়েও তাঁদের দুজনের সম্মতিতে গান্ধর্ব মতে কোনো পুরোহিত ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঘোষা,অপালা,বিশ্ববারা,মৈত্রেয়ীরা প্রাচীন ভারতীয় নারীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । বৃহদারণ্যক উপনিষদে মৈত্রেয়ীর জাগতিক সম্পদের প্রতি নির্মোহ ও বলিষ্ঠ উক্তি, আজও বারবার উদাহরণ দেওয়া হয়- যেনাহং নামৃতা স্যাং কিমহং তেন কুর্যাহং? যার দ্বারা অমৃতত্ত্বের কোনো আশা নেই, সেই সম্পদের আমার কি প্রয়োজন?
ধারণা করা হয় কন্যাদান প্রথা বাল্যবিবাহ শুরু হবার সময় থেকে প্রচলিত হয়েছে। বিবাহের বিভিন্ন প্রথা অঞ্চল ভেদে আলাদা আলাদা রকমের হয়ে থাকে। বাঙালি বিভিন্ন রীতি ও আচার বিভিন্ন এলাকা ও পরিবারে ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। পশ্চিমবঙ্গের কনকাঞ্জলি যেমন আমাদের উত্তর পূর্বের বেশিরভাগ বাঙালিদের মধ্যে প্রচলিত নেই। সিলেটিদের মধ্যে যেমন বরাবরই পনপ্রথা খুব কমই চোখে পরে।
সম্পতি শিলচরেও অপরাজিতা ভট্টাচার্য রাজ্যের প্রথম মহিলা পুরোহিত হিসেবে একটি বিয়েতে পৌরোহিত্য করেছেন। কনের ইচ্ছেতে করা হয়নি সম্প্রদান। দান সামগ্রী হিসেবে উপহার দেওয়া হয় বই। নান্দনিক এই বিয়ের আসরে উপস্থিত পরিজনরা আনন্দ আর কৌতূহল নিয়ে উপভোগ করেন সংস্কৃত মন্ত্রের এই অঞ্চলের কথ্য বাংলায় ব্যখ্যা। পুরোহিত অপরাজিতা ভট্টাচার্য বর কনেকে বুঝিয়ে বলেন বিয়ের শপথের মানেগুলো। তাঁর নিজের বিয়েতেও অনেক মন্ত্রের মানে না বুঝে উচ্চারণ করে গেছিলেন বলে এই মন্ত্রগুলো অর্থ বুঝে উচ্চারণ করার গুরুত্বে তিনি জোর দেন।
শিলচরের প্রখ্যাত পন্ডিত সুধীর রঞ্জন ভট্টাচার্যের কন্যা অপরাজিতা ভট্টাচার্য স্কুল জীবনে বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। ইকোনমিক্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ছিল তাঁর। বাবার প্রভাবে ছোট থেকেই শাস্ত্র চর্চায় আগ্রহী ছিলেন তিনি। বাবার কাছ থেকে শুনে শুনে বিভিন্ন মন্ত্রপাঠ শিখেছিলেন প্রথম জীবনে। আটাত্তরে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার পর নিজের আগ্রহ থেকেই শাস্ত্রের পাঠ নেওয়া শুরু করেন তিনি। বাড়িতে বাবাকে সাহায্য করতে করতে পুজো পদ্ধতিও শিখে নেন। তবে বাইরের পুজোতে পৌরোহিত্য করার সিদ্ধান্তটা একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নেওয়া। এক বিদ্যালয়ের সরস্বতী পূজায় উপস্থিত ছিলেন তিনি। সেখানে অঞ্জলী শেষ হয়ে যাবার পর একটি বাচ্চা তার মায়ের সাথে দেরী করে পৌঁছনোয় পুরোহিত অঞ্জলী দেওয়াতে অস্বীকার করেন। মায়ের অনেক অনুরোধের পর খুব দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে রুক্ষভাবে অনুরোধ রাখতে রাজী হন। বাচ্চা মেয়েটির অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে অপরাজিতা পুরোহিতমশাইকে বলেন, তিনি চলে যেতে পারেন,অঞ্জলী তিনিই দেওয়াবেন। সবাই খুশি হয়ে রাজী হয়ে যায়। পরের বছর সেই বিদ্যালয়েই অপরাজিতা ভট্টাচার্য প্রথম পূজা করান। এরপর বিভিন্ন পূজায় পৌরোহিত্যের পাশাপাশি লোকজনের অনুরোধে তর্পণ করানোর দায়িত্বও নিতে হয় তাঁকে।
তবে বিয়ের দায়িত্ব এই প্রথম নিলেন কনের অভিভাবকদের অনুরোধে৷ তাঁর মতে, সম-মনের এবং সম-ভাবের মানুষদের সাথে নতুন কিছু করার আনন্দ পাওয়া যায়। পৌরোহিত্য করতে গিয়ে তাঁকে বিশেষ কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি পরিবারের পরিচিতি, সামাজিক অবস্থান ও তাঁর নিজের স্বীকৃত পরিচয়ের জন্য বলে জানান তিনি। তুলনামুলকভাবে অপরিচিত ও নতুন প্রজন্মের জন্য লড়াইটা একটু কঠিন হলেও শুরু করার দরজাটা খুলতে পেরেছেন বলে তৃপ্তি প্রকাশ করেন শিলচরের প্রথম মহিলা পুরোহিত অপরাজিতা ভট্টাচার্য।
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা – রোহিণী ধর্মপাল এবং অপরাজিতা ভট্টাচার্য।
(শাশ্বতী ভট্টাচার্য আকাশবাণী শিলচর কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর)