India & World UpdatesBreaking NewsFeature Story

লকডাউনে সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে মধ্যবিত্তরাই, লিখেছেন রাহুল রায়
Middle class is in more crisis during lockdown, writes Rahul Roy

//রাহুল রায়//

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশে লকডাউনের তৃতীয় পর্ব চলছে। শুধু ভারত নয় , পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশ আজ করোনা ঝড়ে দিশেহারা৷ একদিকে যেমন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে , অন্যদিকে লকডাউনের ফলে অর্থনৈতিক সমস্যাও পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলছে । আগের দুই দফা লকডাউন মিলিয়ে দেশ দেড়মাস ধরে স্তব্ধ হয়ে আছে । পরিসংখ্যান বলছে, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ শিল্পোদ্যোগ বন্ধ। হোটেল , বাণিজ্যিক মল, রেস্তোরায় তো লকডাউন ঘোষণার আগে থেকেই তালা । আটকে পড়ে আছে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ যাত্রী পরিবাহী গাড়ী । এই সব শিল্পোদ্যোগগুলোতে জড়িত আছেন প্রায় ৬০ কোটি মানুষের জীবিকা । কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজের সমীক্ষা বলছে, প্রায় ১২ কোটি মানুষ এই পর্বে চাকরি হারাতে পারেন৷ ৫৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই লকডাউনের পর কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে । ভারতের অর্থনৈতিক বিন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হল বিশাল সংখ্যক মধ্যবিত্তের উপস্থিতি । ২০১৯ সনে লন্ডনের কিংস কলেজের প্রকাশিত সমীক্ষা অনুযায়ী দেশের প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত যার মধ্যে অর্ধেক অর্থাৎ প্রায় ১৯ কোটি মানুষ নিম্ন-মধ্যবিত্ত । করোনা পর্বে দেশের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ নিয়েছে । অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সাহায্যার্থেই মূলত নীতি গ্রহণ করা হয়েছে । সরাসরি ব্যাঙ্ক খাতায় টাকা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, রেশনে বিনামূল্যে চালের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে । তবে সরকার থেকেও এই সময়ে বেশি কাজ করে যাচ্ছে বেসরকরি প্রতিষ্ঠানগুলো । প্রতিটা দিন কোটি কোটি টাকার খাদ্যসামগ্রী তারা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের হাতে তুলে দিচ্ছেন ।

কিন্তু সমস্যাটা হল মধ্যবিত্তের । এর মধ্যে নিশ্চিত মাস মাইনের বেতনের সরকারি বা বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি খুব একটা বেশি মানুষ করছেন না । ছোটখাটো ব্যবসা, পেশা ও চাকরি করেই মূলত এই শ্রেণির মানুষ নিজের ও নিজের পরিবারের মুখে অন্ন তুলে দেন । লকডাউনের ফলে প্রায় দেড় মাস থেকে মানুষ ঘরবন্দি । নিজেদের সঞ্চিত টাকা দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন , কিন্তু সেই সঞ্চয়ই বা আর কত আছে! ব্যাঙ্কগুলো জমাকৃত টাকার ওপর সুদের হার ক্রমাগত কমিয়ে যাচ্ছে৷ অথচ এই সুদের টাকাটাই কিন্তু মধ্যবিত্তদের একটা আয়ের অন্যতম উৎস । এদিকে পরবর্তী এক বছরের জন্য কেন্দ্র সরকার মহার্ঘ ভাতা না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যার ফলে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবেন ৬৫লক্ষ ২৬ হাজার অবসরপ্রাপ্ত ও ৪৮ লক্ষ ৩৪ হাজার কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ কর্মীচারী । একই পথ নিয়েছে বিভিন্ন রাজ্যের সরকারও, স্বাভাবিকভাবেই কর্মচারী ও পেনসনভোগীদের আয় সংকোচন হবে ।

অন্যদিকে, বাজারে জিনিষপত্রের দাম বেড়েই চলছে, মধ্যবিত্তের কাছে আজ বর্ধিত ব্যয় ও সংকুচিত আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনাটা বাস্তবিক অর্থেই দুরূহ হয়ে পড়ছে । মধ্যবিত্তের সমস্যা হচ্ছে, এরা নিজেদের সীমিত আয়কে কেন্দ্র করে নিজেদের জীবনযাত্রার মান উন্নীতকরণে একটি বিচিত্র জায়গায় অবস্থান করেন । এখান থেকে সাধারণত পেছনে ফিরে যাওয়া যায় না৷ কারণ এই পথচলাটা উপরের দিকে দৃষ্টি রেখে শুরু হয়েছিল । ছেলে-মেয়েদের দামি বেতনের স্কুলে পড়ানো থেকে শুরু করে নিত্যদিনের খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার আনুষঙ্গিক প্রয়োজন, এখানে কিছু বাদ দেওয়াটা কষ্টকর। কিন্তু এবার অবস্থা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখের আত্মবিশ্বাসের হাসিটা উপরে উঠে কপালের ভাজে পরিণত হতে শুরু করেছে । আগামী দিনে যদি লকডাউন এভাবেই থাকে তাহলে কী করে সংসার চালানো, এখন এই চিন্তাও করোনার মতোই আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।

বাজারে টাকা নেই , ব্যবসা কীভাবে হবে, তারপর আছে বিরাট এক ভয় । আবার এই ছাড় দেওয়ার ফলে যদি সংক্রমণ বেড়ে যায় তাহলে তো আবার সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হবে । শিলচরের বর্তমান অবস্থা আমাদের সেই অনিশ্চয়তায় ভরা দিনগুলোর দিকেই কিন্তু ইঙ্গিত দিচ্ছে । এই অনিশ্চয়তা ব্যবসায়ের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল । দেশের প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান মেনে এখনো দেশে সেরকম কর্মীছাটাই শুরু হয়নি । কিন্তু বেতন আটকানো ও কাটা শুরু হয়ে গেছে । লকডাউন পরবর্তী সময়ে যে ব্যাপক কর্মীছাঁটাই শুরু হতে চলছে তাও সিআইআই-এর সমীক্ষা থেকে পরিষ্কার । ইতিমধ্যে ছোট ও মাঝারি মাপের সংস্থাগুলো কর্মীদের সাবধান করে দিতে শুরু করেছে, নতুন চাকরি খোঁজার কথা বলছে । বাস্তবে বাজারের পরিস্থিতি যদি অনুকূল থাকে তাহলে ব্যবসার শ্রীবৃদ্ধি যেমন হয়, কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি তেমন হয় । দেশের বাজার আগে থেকে খারাপ ছিল। এবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসে পড়ল করোনার চরম নিষ্ঠুর কুঠারাঘাত । কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডার , বিশ্ব ব্যাঙ্ক কেউই আগামী এক বছর দেশের অর্থনীতির জন্য আশাব্যঞ্জক কিছু দেখতে পারছে না । এই দেশ গত দু’বছরে বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটি ঝড় দেখেছে, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির ধারে কাছেও এর মধ্যে একটিও ছিল না ।

গত বছর অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসায় অনেকের কপালে ঘাম জমতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। আর এবার তো আরও ভয়ঙ্কর। বৃদ্ধির হার যে ১ শতাংশের বেশি যে কোনোভাবেই যাচ্ছে না! তবে এটা ঠিক, পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে সেটা নেতিবাচক হলেও কিছু করার থাকবে না । আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও গোঁদের মতো বিষফোঁড়ার কাজ করছে এবার । করোনা কাউকেই রেহাই দেয়নি। বিভিন্ন দেশে কর্মরত ভারতীয়দের সব যখন দেশে ফিরে আসবেন, তখন অবস্থা আরও মারাত্মক হয়ে উঠবে ।

বর্দ্ধিত বেকারত্ব, দারিদ্র, অনিশ্চয়তা, নিম্নগামী ক্রয় ক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাস, এর মধ্যে কোনোটাই বাজারের সুস্থ, স্বাভাবিক অগ্রগতির জন্য কাম্য নয় । আর বাজার স্বাভাবিক না হলে সাধারণ মানুষের উন্নতি কোনোভাবেই সম্ভব নয় । এই পরিস্থিতির কোপ সবার ওপরেই আসবে। আক্রান্ত বেশি হবেন কিন্তু মধ্যবিত্তই । উচ্চবিত্তের এই পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার ক্ষমতা আছে, নিম্নবিত্তের জন্য ভোটের গরজে সরকার এগিয়ে আসবেই । সর্বোপরি তাঁদের ব্যয় সীমিত, জীবনযাত্রায় নমনীয়তা অনেক বেশি ,তারা পরিস্থিতি অনুযায়ী টিকে থাকতে জানে । মধ্যবিত্তের এর মধ্যে কোনোটিই নেই। দীর্ঘদিন জীবনযাত্রার অক্ষুন্ন রাখার ক্ষমতা এদের নেই, আবার পরিস্থিতি বুঝে খরচ কমোনোটাও এদের পক্ষে দুষ্কর ।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আসাম সরকার এপ্রিল মাসে প্রাইভেট স্কুলগুলোতে ফি অর্ধেক করার কথা বলেছে৷ কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে যে সবাই একাধিক টিউশন রাখেন তাদের কী হবে, সেই ব্যয় নিশ্চয় সরকার বহন করবে না । বাড়ি ভাড়া থেকে দোকান ভাড়া, নিত্যদিনের বাজার খরচ থেকে বাইক-গাড়ির খরচ, ঘরের বিদ্যুতের বিল থেকে পরিচারিকার খরচ , কোনোটাই কিন্তু কমানো যাবে না । দীর্ঘদিন থেকে এরা নিজেদের জীবনযাত্রার মানকে সাজিয়ে তুলেছেন , এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসাটা সহজ নয় । ঘরে অভাব থাকলেও এরা মুখ খুলতে পারেন না, রাস্তায় নামতে পারেন না , পাছে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ক্ষুণ্ণ হয় ।

সরকারের হাতে এদের জন্য বিশেষ কোনো পরিকল্পনা কোনোদিনই থাকে না, এবারও অবস্থা একই । কিন্তু এঁদের করণীয় কিছুই নেই । এরা না হাত পেতে ত্রাণ নিতে পারেন, না রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে জানেন । সবেতেই অদ্ভুত এক আড়ষ্টতা কাজ করে ।

মধ্যবিত্ত সমাজের অবস্থা আজ অনেকটাই বাড়ির বড় ছেলের মতো, যে কিনা চরম দুঃখ, বেদনায়ও বুক চাপরে কাঁদতে পারে না, তাকে লুকিয়ে মুখ বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে হয়, কেউ দেখে ফেললে যে প্রতিষ্ঠা-সম্মানহানি হবে !

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker