Barak UpdatesAnalyticsBreaking News
অজাত শত্রু দীপক ভট্টাচার্য, লিখছেন দুলাল মিত্রDipak Bhattacharjee: A man without Foes, writes Dulal Mitra
দীপকদাকে আমি প্রথম দেখেছি ১৯৭২ সনে । আমরা তখন সবে মাত্র ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হয়েছি । আমি নরসিং হাইয়ার সেকেন্ডারী স্কুল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নির্বাচিত জি এস ছিলাম । তখন ‘৭২ – এর ভাষা আন্দোলন চলছিলো । মাতৃ ভাষার মাধ্যমে আমাদের নেতৃত্বে একটি ছাত্র মিছিল সংগঠিত হয় । স্কুল ছাত্রদের মধ্যে আমাদের খানিকটা প্রভাব ছিল । তাই মিছিলে ভালো জমায়েত হয়ে ছিলো । এই মিছিলে দীপকদা ছিলেন । এই প্রথম দেখা । সুন্দর চেহারা । মুখে হাসি । দেখেই মনে হয়েছিল বড় আপন মানুষ । তখন দীপকদার বয়স কত হবে ? মৃত্যুকালে উনার বয়স ৭৯ হলে তখন তাঁর বয়স ছিল ৩২ ।
কমিউনিস্ট পার্টিতে আমার সক্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দীপকদার সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে । হাইলাকান্দিতে দীপকদা ছিলেন সিপিআই(এম)-এর সর্বক্ষনের কর্মী । হাইলাকান্দি করিমগঞ্জ নিয়ে তখন কাছাড় জেলা । শিলচর ছিল জেলা কেন্দ্র । দীপকদা প্রায়ই পার্টির জেলা কেন্দ্র শিলচর নাজিরপট্টি পার্টি অফিসে আসতেন । আমরা অর্থাৎ স্বদেশ দা ( স্বদেশ বিশ্বাস ), অরূপ চৌধুরী, রফিক আহমেদ, সনৎ কৈরী, বিজিত রায়,নীতিশ দে, পিন্টু ভট্টাচার্য্য, অবিনাশ ভট্টাচার্য্য প্রমুখ প্রতিদিন অনেকটা সময় নাজিরপট্টি পার্টি অফিসে কাটাতাম । নাজিরপট্টি পার্টি অফিসের মূল আকর্ষণ ছিল প্রয়াত কমরেড গোপেন রায়, দিগেন দাশগুপ্ত, রুক্মিনী আচার্য প্রমুখ । সন্ধ্যার পর নুরুল হুদা প্রতিদিনই আসতেন । আসতেন দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত সহ আরো অনেক বিশিষ্ট কমরেডরা ।দীপকদা প্রায়ই হাইলাকান্দি থেকে শিলচরের অফিসে আসতেন । আমরা যারা ছাত্র ছিলাম, তাদের অত্যন্ত আপনজন হয়ে উঠেন দীপকদা।
১৯৭৫ সনে তদানীন্তন ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন । তখন সমস্ত বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তামূলক আইনে জেলে আটক করে রাখা হয় । পার্টির নেতা নুরুল হুদা, বীরেশ মিশ্র, গোপেন রায়, রুক্মিনী আচার্য, নিশীথ দাস মৃণাল কান্তি দত্তবিশ্বাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দীপক ভট্টাচার্য্য ও বন্দি হন । ছাত্র কর্মীদের মধ্যে শিলচরের দুলাল মিত্র, অরূপ চৌধুরী, রফিক আহমদ ও সুদীপ দেব এবং করিমগঞ্জের নির্মল দে, সমীরণ আচার্য ও শ্যামাপ্রসাদ দে- কেও আটক করা হয় । সবাইকে প্রায় ১৯ মাস জেলে থাকতে হয় । শিলচর জেল থেকে দু তিন মাস পর আমাদের কয়েক জনকে নওগাঁ এবং আরো কয়েকজনকে গোয়ালপাড়া জেলে স্থানান্তরিত করা হয় । দীপকদার সঙ্গে গোয়ালপাড়া জেলে আমরাও স্থানান্তরিত হই । সেই সুবাদে উনার সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা বেড়ে যায় । প্রচন্ড শৃঙ্খলা পরায়ণ ও সংযমী মানুষ ছিলেন তিনি । কোনো দিন রাগ করতে দেখি নি । পোশাক পরিচ্ছদ কখনো অপরিস্কার থাকতে দেখি নি । প্রতিদিন সেভ করতেন । আমরা যেহেতু ছোট, তাই বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে আমাদের স্নেহ করতেন এবং মেলামেশা করতেন ।
এম এল এ হবার পরও কোনো সময় তাকে অহংকারী বলে মনে হয় নি । দীপকদা যখন পার্টির সম্পাদক ছিলেন, তখন সব সময় আমি তাঁর পাশে থাকার চেষ্টা করেছি । প্রচন্ড পরিশ্রম করতে পারতেন । মাইলের পর মাইল হাটতে পারতেন । কমরেডদের বাড়িতে গিয়ে যোগাযোগ করতেন । অনর্থক কোনো কিছু খরচ করতেন না । বিলাসিতা বলে কিছু ছিল না । তিনি দীর্ঘদিন ‘জননেতা হিজম ইরাবত সিংহ স্মৃতি রক্ষা কমিটির’ সম্পাদক ছিলেন । এই স্মৃতি রক্ষা কমিটির সঙ্গে আমরাও যুক্ত । স্মৃতি রক্ষা কমিটিতে তাঁর নিষ্ঠা ও কাজকর্ম ছিল উদাহরণ স্বরূপ । কমিটিতে মনিপুরী সদস্য যারা আছেন তারা তাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসতেন ।
দীপকদা চিরদিনই একজন সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন । দিনের অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতে হতো বলে তাঁর সাংস্কৃতিক পরিসরে ঢোকার সুযোগ ছিল না । ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিজন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ব্যাক্তিগত সংযোগ ছিল । জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবার পর সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় হয় । শিলচরে দলমত নির্বিশেষে সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ তাকে ভালোবাসতে শুরু করেন । ছেলেবেলা থেকে শ্রমজীবী মানুষের শোষণ মুক্তির লড়াই তথা সমাজ পরিবর্তনের জন্য নিজেকে সর্বক্ষনের কর্মী হিসেবে নিয়োজিত করায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি গ্রহণ করতে পারেন নি । তবে সমাজ বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে একাগ্র চিত্তে অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে নিজেকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পেরেছেন । এই জ্ঞান থেকেই পত্র পত্রিকায় বিভিন্ন সময় প্ৰবন্ধ লিখতেন ।
সত্যিকার অর্থে দীপকদা একজন ভদ্রলোক ছিলেন । তাঁর সততা নিয়ে কোনো সংশয় নেই । মার্কসবাদ লেলিননবাদের মতাদর্শের প্রতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল ছিলেন । পার্টির জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করতেন । ছিলেন সদা হাস্যময়। ব্যক্তিগত ভাবে কাউকে কোনো সময় কড়া কথা বলতেন না । অথচ বক্তৃতায় রাজনৈতিক শত্রুর বিরুদ্ধে কড়াভাষায় সমালোচনা করতেন । জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে পারতেন । তাঁর অমায়িক চারিত্রিক বৈশিষ্ঠের জন্য সবাই তাকে ভালোবাসতেন । তাইতো দীপক ভট্টাচার্যের শেষ যাত্রায় শ্মশানঘাটে প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কবিন্দ্র পুরকায়স্থ বলেন দীপক বাবু ছিলেন অজাত শত্রু ।
আজ রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বেড়ে গেছে । সর্বত্র শিষ্ঠাচারের অভাব পরিলক্ষিত হয় । তাইতো দীপক ভট্টাচার্যের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন ।