Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking NewsFeature Story

সময়ের কথকতায় ইন্দ্রসায়ন-১

গত ১৪ জুলাই ২০২৪ তারিখে বঙ্গভবনে ‘এ মাসের নাটক’-এ মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির আয়োজনে আজকের প্রজন্ম শিলচর এবং বিবর্তন থিয়েটার গ্রুপের যৌথ প্রয়াসে মঞ্চস্থ হল দুটি নাটক যথাক্রমে “অসুখের উৎসব” এবং “কাল হেমন্ত”। নাটক দুটির পর্যালোচনা করেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য। দুটি নাটকের আলোচনা স্বতন্ত্র দুটি কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে এখানে। নীচে রইল প্রথম নাটকের আলোচনা।

//দেবাশিস ভট্টাচার্য//
১৪ই জুলাই বঙ্গ ভবনে ‘এ মাসের নাটক’ এ আজকের প্রজন্ম শিলচর এবং বিবর্তন থিয়েটার গ্রুপের যৌথ প্রয়াসে মঞ্চস্থ হল দুটি নাটক। সায়ন বিশ্বাস পরিচালিত দুটি নাটকেরই রচয়িতা ড০ ইন্দ্রনীল দে। ইন্দ্রনীলের বিষয়ভাবনা আর সায়নের প্রয়োগভাবনার যুগলবন্দি ইতিমধ্যেই উপত্যকার নাট্যামোদীদের প্রত্যাশার দিগন্তকে প্রসারিত করেছে। প্রথম নাটকটির উপস্থাপন নিঃসন্দেহে ওই দিগন্তকে স্পর্শ করেছে। ‘অসুখের উৎসব’-এ বড়ো আলগোছে সময়কে রিপ্রেজেন্ট করেছেন ইন্দ্রনীল। বস্তুত সময়ই এই নাটকের প্রধান কুশীলব; নাটকের চরিত্রগুলি সময়ের দোলায় ভেসে বেড়ানো বুদ্বুদ। সোনু কিংবা নীলাভ যথাক্রমে ছেলে আর মেয়ে হলেও সমস্যা হয় না, সমস্যাটি একটি প্রজন্মের; যারা অন্তর্জাল শাসিত এই সময়ে যন্ত্রগণকের হাতে বন্দি। প্রতিদিন আমাদের মুঠোফোনে কত না অ্যাপ্লিকেশনে বিচিত্র সব নোটিফিকেশন আসে; যান্ত্রিক সম্ভাব্যতার অঙ্কে আমাদের চরিত্র ও রুচির যাবতীয় তথ্য কোথাও সংরক্ষিত হয় আমাদেরই কোনো সন্ধানের সূত্র ধরে। আপনি মোবাইল হাতে একটি জুতোর দাম জানতে চাইলেন, অমনি জুতোর বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ হবে আপনার হাতের যন্ত্রটি; ঝাঁপিয়ে পড়বে সমস্ত অনলাইন মার্কেটিং অ্যাপ। তথ্যের এই সংরক্ষণ, জ্ঞাপন, বিশ্লেষণ, বিন্যাস আর বিপণন আমাদের অজান্তেই আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে; সার্চ ইঞ্জিনে মানুষই যে কিছু খুঁজে নিচ্ছেন তা মাত্র নয়, সেও সম্ভাব্যতার বাঁধা ছকে আমাদের রচনা করে চলেছে। তথ্যকে সম্ভাব্যতার ছকে বেঁধে এই যে গণনা, যন্ত্রগণক বিজ্ঞানের ভাষায় এই প্রক্রিয়াটির নাম অ্যালগোরিদম। অন্তর্জালে আমাদের কাজকর্ম, আমাদের সন্ধান এর সমস্ত তথ্য চুরি করে আমাদের ক্রমশ রচনা করে চলেছে, চালিত করে চলেছে প্রজাপতি ব্রহ্মা ওই অ্যালগোরিদম। মানুষের আবেগ অনুভূতি সবই পণ্য হয়ে পড়েছে, ব্যক্তিগত বলে কিছু থাকছে না। এই নজরদারি প্যাগাসাস হলে খবর হয়; কিন্তু প্রাত্যহিকের নজরদারি ব্যক্তিগত পরিসরকে যে নস্যাৎ করে দিচ্ছে, এটা নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই। বরং, বিনোদন আর বিজ্ঞাপনে হাতের মুঠোয় সহজে সবকিছু পাওয়ার আনন্দে একে বরণ করে নিচ্ছে অন্তর্জালের যুগে জন্ম নেওয়া প্রজন্ম। তাই অন্তর্জাল নিয়ন্ত্রিত সময়ের নতুন রানার, খাবার পৌঁছে দেবার অ্যাপ-এর ডেলিভারি গার্ল সোনুর কাছে এই নজরদারির ইতিবাচক দিকটিই বড়ো হয়ে ওঠে, ট্রেড ইউনিয়ন করা পিতার সংশয় তার কাছে অহেতুক মনে হয়।


এই যে বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের বিপুল কর্মীবাহিনী, এদের চাকরির নিরাপত্তা বলে কিছু নেই, সন্তুষ্টির রেটিং নামিয়ে রেখে না দেখা মালিকপক্ষের নির্মম যান্ত্রিক পেষণ, আর কোম্পানির বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার চাপ ক্রমশ বাঁকিয়ে দেয় শিরদাঁড়া। স্বপ্নভঙ্গ হয় অচিরেই। ইচ্ছে হলে ছেড়ে দিতে পারি কাজ- এই স্বাধীনতা যে আসলে ছাঁটাইয়ের নামান্তর, সোনু আর রনি- এই দুই ডেলিভারি ম্যান এর আলাপচারিতায় তা স্পষ্ট হয়। নাটকের দৃশ্যান্তরে সমস্যার অন্য একটি মাত্রা ধরা পড়ে নীলাভর গল্পে। মুঠোফোনে ডুবে থাকা এক অমোঘ নিঃসঙ্গতা এই সময়েরই মুখচ্ছবি; বাস্তবের চারপাশকে প্রত্যাখ্যান করে ভার্চুয়াল জগতে বাস করা, নিজস্ব মুহূর্তগুলিকে সমাজ মাধ্যমের পণ্য করে তোলা, এ সেই নির্মাণ প্রক্রিয়ার পরিণাম, যা একটু আগে বলা হল। লাইভ রিল বানাতে গিয়ে নীলাভর মৃগীরোগে কাতরানোর দৃশ্য ভাইরাল হয়ে পড়ে অ্যালগোরিদমের কারুকাজে। এ যে ক্রীড়া নয়, অসুখ, সেকথা বোঝার অনুভূতি কোথায় যন্ত্রের; লাইক বাটনের চিন্তাহীন চাপে নীলাভর অসুখও হয়ে পড়ে পণ্য; যন্ত্রশাসিত সময় হরণ করছে মানুষের সংবেদনশীলতাকেও। ইন্দ্রনীল এই পর্যবেক্ষণকেই নাটকের দ্বান্দ্বিক আখ্যানে বাঁধেন; আর এটা করতে গিয়ে রূপকের আশ্রয় নেন, যা নাটককারের প্রিয় কৌশলও বটে। অ্যালগোরিদম তাঁর নাটকে কোরাস চরিত্র হয়ে এসেছে। রহস্যময় ছড়ায় গাঁথা এই চরিত্রগুলির সমবায়ী সংলাপ নেপথ্যের বিপুল ক্রিয়াশীলতাকে খুলে দেখিয়েছে।


নাটকের প্রয়োগের ক্ষেত্রেও, বাস্তব আর রূপকের দুইটি স্তরের সংলাপ সায়ন গড়ে তুলেছেন পোষাক, আলো, সংলাপ ক্ষেপণের সামগ্রিক পরিকল্পনায়। প্রতিটি চরিত্র, ব্যক্তি হয়েও কোনো না কোনো ভাবে সময়ের নানা স্বরের প্রতিনিধি। সোনুর সংশয়ী বাবা (শোভন দাস), অতটা তলিয়ে না দেখে নতুন সময়কে প্রশংসা করা মা (কল্পিতা দেব), মোহভঙ্গের পরে প্রজন্মগত অসহায়তার প্রতিনিধি রনি (দীপঙ্কর পাল), আর সময়ের পরিণাম অস্তিত্বে ধারণ করা ব্যাধিগ্রস্ত নিঃসঙ্গ নীলাভ (মাধুর্য চৌধুরী), এদের সংযুক্ত করেছে প্রতিটি পরিসরে উপস্থিত সোনু (সোমশিখা মজুমদার)। প্রত্যেকেই ব্যক্তিস্বভাবকে অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন, আবার সময়ের মাত্রাও ধরা পড়েছে বাচিক আর আঙ্গিকের সমবায়ে। ভয়েস মডিউলেশনে শোভন আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। স্বভাবতই কেন্দ্রীয় চরিত্রে অনুভবের একাধিক স্তর রয়েছে, সময়ের এক একটি মাত্রা তার প্রতিক্রিয়ায় মূর্তিমান করবার চেষ্টায় খামতি ছিল না সোমশিখার। শুধু নীলাভ-সোনুর কথোপকথনে নাট্যক্রিয়ার গতি খানিকটা শিথিল হয়েছিল। নীলাভর জন্মদিন উদযাপনে সঙ্গ দেবার অনুরোধ এড়াতে পারছে না সোনুর সংবেদনশীল অন্তর, অথচ তার ভাইয়ের জন্মদিনে ঘরে ফেরার তাড়া রয়েছে তার। একথা সেকথা বলে নীলাভ সময় নিচ্ছে কেক কাটতে, ফলে অস্থির হয়ে উঠছে সে। দীর্ঘ সময় ধরে এই তাড়ার আততি ধরে রাখা এমনিতেই দুরূহ, এটাকে আরও দুরূহ করে দিয়েছেন নীলাভরূপী মাধুর্য, শারীরিক অভিনয়ে প্রয়োজনের বেশি সময় নিয়েছেন, ফলে সংলাপ ক্ষেপণে বিলম্ব করছিলেন। এই বিলম্বে, সোমশিখা টেনশন ধরে রাখতে পারেন নি পুরোটা সময়। অবশ্য এই দৃশ্যগত শৈথিল্য দর্শককে খুব একটা বিব্রত করবার আগেই কোরাস এর প্রবেশ লয়ে ফিরিয়ে এনেছে নাটককে। কোরাস-এর স্মার্ট কোরিওগ্রাফিতে নাচের গতির সঙ্গে কালো পোষাক আর সংলাপের রহস্যময়তা বড়ো চমৎকার মিশেছে। বিভঙ্গ আর উচ্চারণে এই রহস্যময়তা ছিল নাটকের অনিবার্য দাবি, যা গড়ে তুলতে উপযুক্ত সঙ্গ দিয়েছে আলো আর আবহ। সপ্তদীপ বিশ্বাস অ্যালগোরিদম-এর একজন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে যে সংলাপ উচ্চারণের সুযোগ পেয়েছেন, সেখানে নিজের সেরাটা দিয়েছেন বাচিকের কারুকাজে। দল হিসাবে আজকের প্রজন্ম বা বিবর্তনের কোরাসের কাজগুলি এমনিতেই ভালো হয়; এই নাটকেও কোরাসের সবাই ভালো, হাত পা আরেকটু মিললে আরো তীক্ষ্ণ হবার সুযোগ রয়েছে। একটা কম্পোজিশনে ফুটলাইটের আলো মুখে নেবার যে আয়াস চোখে পড়েছে কোরাসের দলের সামনে থাকা মেয়েটির, এবং ফলে অন্যদেরও, সেটা না হলেও পারত। ওর আচরণে অন্তত সাত-আট সেকেন্ড আগেই বোঝা গেল, মধ্যমঞ্চে সামনের ফুটলাইট জ্বলবে এবার। সেলাইয়ের এসব সুতো যে লুকিয়ে রাখতে হয়, অভিজ্ঞতায় শিখে যাবে এরা।


সব মিলিয়ে “অসুখের উৎসব” নাটকটি এই দর্শকের বিবেচনায় একটি সফল নাটক। নাটককার ইন্দ্রনীল যে সময়কে নাটকে ধরতে চেয়েছেন, যে বিপন্নতা নিয়ে ভাবাতে চেয়েছেন দর্শকদের, নাট্যক্রিয়ায় তার যথাযথ অনুবাদের চেষ্টা করেছেন নাট্যকার সায়ন। অভিনেতা ও নেপথ্যের কারিগরদের সমবায়ী প্রয়াসে, ভার্চুয়ালে কমবেশি মজে থাকা গড়পড়তা দর্শক খুব তলিয়ে না দেখা একটি বিষয় নিয়ে নিজের সঙ্গে কথোপকথনে রত হবেন, সে যত অল্প সময়ের জন্যেই হোক না কেন। দর্শকের অন্তরে সময়ের সন্দর্ভ রচনার মধ্য দিয়েই ইন্দ্রনীল-সায়নের যুগলবন্দি সার্থক হয়ে উঠেছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker