Barak UpdatesHappeningsBreaking NewsFeature Story

চাঁদে অবতরণ ছিল গতি নিয়ন্ত্রণের খেলা, লিখেছেন ড. হিমাদ্রি শেখর দাস

// ড. হিমাদ্রি শেখর দাস//
বিক্রম ল্যান্ডারের সফল অবতরণ আমাদের চোখে আবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে জীবনে সাফল্য পেতে হলে গতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়। চন্দ্রযান-২ -এ সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু ল্যান্ডার অবতরণের সময় শেষ মুহূর্তে যানের গতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়৷ তাই সেটি চাঁদের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। সফট ল্যান্ডিং ব্যর্থ হয়। রাশিয়ার লুনা-২৫ চন্দ্র অভিযানেও ঠিক তেমনটাই হয়েছিল। গতির রাশ নিয়ন্ত্রণে না রাখার জন্য রাশিয়ার মহাকাশ সংস্থা রসকসমসের মিশনও গত ১৯ আগস্ট অসফল হয়। চন্দ্রযান-২ থেকে শিক্ষা নিলে হয়তো সেই অঘটন ঘটতো না।
সাফল্যের স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হলে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়। চন্দ্রযান-২-এর ল্যান্ডারের অসফল অবতরণের কারণ অনুসন্ধান করে কীভাবে নিজেদের ডিজাইনে সংশোধন আনা যায় এ নিয়ে অনেক খেঁটেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কারিগরি আর ডিজাইন নিখুঁত করেই চন্দ্রযান-৩ মিশন উৎক্ষেপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা বাজেটের চন্দ্রযান-৩ মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল নিরাপদে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করা। এই মিশনের জন্য উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করেছে ইসরো। বিক্রম ল্যান্ডারে বেশ কিছু পরিবর্তনও আনা হয়েছিল। চাঁদের মাটিতে সফলভাবে অবতরণের জন্য ল্যান্ডারটিতে দু’টি বিপত্তি শনাক্তকরণ এবং এড়িয়ে চলা ক্যামেরা (হ্যাজার্ড ডিটেকশন অ্যান্ড অ্যাভয়েডেন্স) ব্যবহার করা হয়েছে।


‘প্রজ্ঞান’ রোভার আর কয়েক ঘণ্টা পর বিক্রম ল্যান্ডারের পেট থেকে একাধিক বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে আসবে। রোভারে রয়েছে ছয়টি চাকা যা চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘুরে ফিরে বেড়াবে আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাবে। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাঁদের ভূমিরূপ কী ভাবে তৈরি হয়েছে, কোন কোন উপাদান দিয়ে চাঁদের মাটি তৈরি, তা খতিয়ে দেখে ইসরোর কন্ট্রোল রুমে বার্তা পাঠাবে প্রজ্ঞান। মাত্র দুই সপ্তাহের জন্য সক্রিয় থাকবে প্রজ্ঞান রোভার। কারণ এক চান্দ্র দিনে (পৃথিবীর হিসেবে ১৪ দিন) সৌর প্যানেল কাজ করবে, তারপর অন্ধকার নেমে আসবে সেই অঞ্চলে। রোভারের যন্ত্রপাতি তখন কাজ করবে না। রোভারটি বিপদ শনাক্তকরণ এবং তা এড়িয়ে চলার ব্যবস্থা দিয়ে সজ্জিত।
চাঁদের বিপদসংকুল অঞ্চল দক্ষিণ মেরুতেই কেন চন্দ্রযান মিশনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল? আসলে চাঁদের দক্ষিণ মেরু নিয়ে বিজ্ঞানীদের তথ্যের ভাণ্ডার সীমিত। ওই অঞ্চলের রহস্য উন্মোচন করার জন্যই ইসরোর এই চন্দ্র অভিযান। চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধ পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান নয়, আর অনেকটা অংশই চির অন্ধকারে ঢাকা থাকে। কারণ সূর্যের আলো সেখানে পৌঁছাতে পারে না। তাপমাত্রা নেমে যায় প্রায় শূন্যের ২৩০ ডিগ্রি নীচে। এই অসম্ভব ঠাণ্ডার জন্য ল্যান্ডারের যন্ত্রপাতি চালনা করাও বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া সেই অঞ্চলে যত্রতত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় গহ্বর। সবকিছু মিলিয়ে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযান করা বেশ চ্যালেঞ্জিং টাস্ক! তবে ভারত প্রথম দেশ হিসাবে এই অসাধ্য সাধন করতে পেরেছে।
মহাকাশ বিজ্ঞান যত উন্নত হচ্ছে বহির্বিশ্বের দিকে যাবার আগ্রহ মানুষের তত বাড়ছে। পৃথিবীর সব থেকে কাছে রয়েছে চাঁদ। তো সেখানে মানব কলোনি গড়তে হলে প্রস্তুতি এখন থেকেই শুরু করতে হবে। যদি চাঁদের দক্ষিণ গোলার্ধে পর্যাপ্ত পরিমাণে বরফের সন্ধান পাওয়া যায়, তবে আগামীতে চাঁদের কলোনিতে মানুষ যখন থাকবে তখন জলের অভাব হবে না। পাশাপাশি জলের অণুকে ভেঙ্গে হাইড্রোজেন গ্যাস এবং অক্সিজেন গ্যাস তৈরি করা যেতে পারে। হাইড্রোজেন গ্যাস কাজে লাগবে রকেটের ইন্ধন হিসেবে, আর অক্সিজেন মহাকাশচারীদের শ্বাস প্রশ্বাসের কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে আগামীতে অন্য নিকটবর্তী গ্রহে মহাকাশচারীদের যেতে সুবিধে হবে। চাঁদের কলোনি থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ইন্ধন আর জল নিয়ে মঙ্গল বা অন্য গ্রহ ভ্রমণের পরিকল্পনা করা যেতে পারে। আপাতত ইসরোর বিজ্ঞানীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের গহবরে জমাট অবস্থায় থাকা জল তথা অন্যান্য খনিজ পদার্থ অধ্যয়ন করে চাঁদের আগ্নেয়গিরি, সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কে নিত্যনতুন তথ্য জানতে পারবেন।
অবশেষে বলতে হয়, গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরো নতুন গতিশক্তি পেয়েছে যা আগামীতে ভারতকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসাতে সাহায্য করবে।
(লেখক আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker