Barak UpdatesHappenings

শিলচর রামকৃষ্ণ মিশন আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে, বললেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা

//হিমন্ত বিশ্ব শর্মা//

আজ শিলচর রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের শতবর্ষ এবং রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের নতুন সর্বজনীন মন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে গৌরবান্বিত বোধ করছি। অনুষ্ঠানে আমি ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। 96 বছরেও শিলচরে এসে স্বামী গৌতমানন্দ যে ভাবে আশীর্বাদ দিলেন, আমি সে জন্য তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আজকের এই শুভদিনে পবিত্র অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দ লাভ করছি। আমি আমার বক্তৃতার শুরুতেই শ্রদ্ধা জানাই ঠাকুর রামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দের পবিত্র স্মৃতির প্রতি। স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বলেছেন, জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব আমাদের শিখিয়েছেন, যত মত তত পথ। এই দুটো মহান উক্তি আমাদের জীবনের পাথেয় হয়ে উঠুক। কারণ মানবতা, সেবার মধ্যেই রয়েছে সত্যিকারের ধর্ম সাধনা। রামকৃষ্ণ মিশন শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি মানবসেবার অনন্যপ্রতীক, যার মূলমন্ত্র হলো শিবজ্ঞানে জীবসেবা। আজকের এই মন্দির উদ্বোধন শুধু ইট-পাথরের নির্মাণ নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক ঐক্য, ধর্মীয় সংহতি ও আত্মিক উন্নতির এক অমূল্য ধন। আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মের সৌন্দর্য হল এর সর্বজনীনতা এবং বিশ্বের প্রতিটি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ। আশা করি, এই মন্দিরে আসা প্রতিটি ব্যক্তির আত্মা শান্তি লাভ করবে এবং সত্য, মানবতা ও ঐক্যের আদর্শে জীবন গড়ে তুলবেন।আমাদের জন্য অতি আনন্দের কথা, গত তিনবছর কষ্টের মাধ্যমে, স্বামী গণধীশানন্দ মহারাজের প্রচেষ্টায় এমন সুন্দর এক মন্দির নির্মিত হয়েছে। আমি আজকের অনু্ষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত সন্ন্যাসী মহারাজদের প্রণাম জানাই এবং অসমে আসার জন্য ধন্যবাদ জানাই, স্বাগত জানাই। ভারতে জন্মগ্রহণ করা মনীষীদের মধ্যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ অন্যতম।নিজের জীবন ও শিক্ষায় মহান আধ্যাত্মিক চেতনায় নিজের জীবন গড়ে তিনি আমাদের সমাজের জন্য চিরস্থায়ী অবদান রেখে গেলেন। তিনি প্রাচীন আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং আধুনিক জীবনের মধ্যে সেতুবন্ধের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন প্রাচীন অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক জীবনের পরিসরেও উপলব্ধি করতে পারা যায়। যার ফলে আধ্যাত্মিকতা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাঁর সত্যনিষ্ঠা, কামলোভ পরিহারের জন্য সবিশেষ গুরুত্ব আরোপের জন্য আমাদের সমাজের জন্য এক নৈতিক মার্গ প্রদান করেছেন। ধর্মীয় আচরণ সমূহ থেকে বাহ্যিক গুরুত্ব সরিয়ে দিয়ে তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের মূল স্বরূপটি উন্মোচিত করেছেন।

ঠাকুর রামকৃষ্ণ প্রেমের ধারণাকে আবেগ অনুভবের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি সকলের মধ্যে দিব্য উপস্থিতির কথা বলে গিয়েছেন। নিজের পত্নী এবং শিষ্য সহ সমাজের উপেক্ষার পাত্র সকলের মধ্যে দিব্য উপস্থিতি টের পেয়ে সকলকে সম্মান দিয়েছেন। ইশ্বরে প্রেম তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে সকলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সমাজে গভীর রেখাপাত করে।

স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন ঠাকুরের শিষ্যদের অন্যতম। তিনি বিশ্ববার্তা দিয়ে গিয়েছেন ওঠো, জাগো। তিনি তাঁর গুরুর বার্তা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সনাতন ধর্মকে পুনরুজ্জীবিত করেন, ভারতের আত্মাকে জাগিয়ে তোলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবন ও শিক্ষা আমাদের আধ্যাত্মিক পূর্ণতা ও নৈতিক সততার দিকে পথ প্রদশর্ন করে। স্বামীজি নির্মিত রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্বজনীন আধ্যাত্মিক আন্দোলনের সূচনা করে আধ্যাত্মিক ভাবকে পুনরুজ্জীবিত করেন। এর কেন্দ্রবিন্দু হল ভারতের বেদান্ত দর্শন। আধুনিক সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ এই গভীর চিন্তাধারায় পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন। জাতি, ধর্মে কোনও ভেদাভেদ না করে ঠাকুর রামকৃষ্ণের মহান বাণী উপলব্ধ করেন। সর্বধর্ম সমন্বয়ের নীতিকে আঁকড়ে ধরে রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের কেন্দ্রসমূহে বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের নিজের ধর্মের প্রতি অটল থেকেও বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ পরস্পরের কাছ থেকে শিখতে পথের সন্ধান দেয়।

রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শে পরিচালিত শিলচর রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম নির্লোভ সেবার মাধ্যমে প্রকৃত রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে।  নারীকল্যাণ, দুর্যোগ মোকাবিলায় নিঃস্বার্থ সেবা উল্লেখযোগ্য।

১৯১৫ সালে কাছাড়ে বিধ্বংসী বন্যার সময় কামিনীকুমার চন্দের উদ্যোগে রামকৃ্ষ্ণ সেবাসমিতির প্রতিষ্ঠা হয়। তখন বেলুড় মঠ থেকে সাধুরা এসে কাছাডে এসে নিপীড়িত মানুষের মধ্যে কাজ শুরু করেন। তাঁদের নিঃস্বার্থ সেবায় স্থানীয় যুবসমাজকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯২৪ সালের মধ্যে এটি আশ্রমে পরিণত হয়। ১৯২৭ সালে এই প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ সেবাশ্রম নাম গ্রহণ করে ।  এর পরই তাদের কাজকর্মের দিকে বেলুড় মঠের নজর পড়ে।  তারা স্বামী প্রেমঘনানন্দকে এখানে পাঠান। স্বামী শিবানন্দের এই শিষ্যের কঠোর পরিশ্রমে এই সেবাশ্রম বিশেষ পরিচিতি লাভ করে।  ধর্মীয় ও কল্যাণমূলক সেবাকার্য়ে ১৯৩৫ সালে বেলুড় মঠ তাদের অনুমোদন জানায়।  এই অনুমোদন শিলচরের সেবাশ্রমকে বেলুড় মঠের শাখার মর্যাদা দেয়। এর পরই বেলুড় মঠ স্বামী পুরুষাত্মানন্দকে প্রথম সচিব নিযুক্ত করে এখানে পাঠায়।  তাঁর নেতৃত্ব, ধৈর্য, ঠাকুরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাবের ফলস্বরূপ ১৯৪৩ সালের ২২ জানুয়ারি এখানে মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়।

শিলচরের এই সেবাশ্রম নিঃস্বার্থ সেবা ও আধ্যাত্মিক জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। দুই বছর আগে শিলচরের বন্যার সময় রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের অনবদ্য মানবসেবা আমরা প্রত্যক্ষ করি। আমি বিশ্বাস করি, মানবসেবায় এই সেবাশ্রম উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে।  সেবাশ্রমের যাত্রা অবলোকনের জন্য এই সময়ে সকলের প্রতি আহ্বান জানাই।

ঠাকুর রামকৃষ্ণের প্রতি আমার প্রণাম নিবেদন করি, যাতে তিনি সকলকে পরিচালিত করেন। স্বামী গণধীশানন্দের প্রেরণা ও পরিশ্রমে মন্দির নির্মাণ হয়েছে।  তিনি জানান, উদ্বোধন হলেও এই সময়ে চার কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।  আমি কথা দিচ্ছি, এখানে যে হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে, তার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দেব এবং মন্দির নির্মাণের বকেয়া চার কোটি টাকাও আমরা মিটিয়ে দেব।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker