NE UpdatesBarak UpdatesHappeningsBreaking News

শিলচর বঙ্গভবনে ড. দেবব্রত শর্মার ঐতিহাসিক ভাষণ : এক ব্যক্তিগত উপলব্ধি, লিখেছেন বিবেকানন্দ মোহন্ত

///বিবেকানন্দ মোহন্ত//
তিনি এলেন, কথা বললেন এবং রেখে গেলেন হলভর্তি দর্শক-শ্রোতাদের মনে একরাশ মুগ্ধতা। শতাধিক বছর ব্যাপী বরাক-ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে থাকা মানসিক ব্যবধানের প্রেক্ষাপটটিও দ্ব্যর্থহীনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরলেন তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে। এটিও জানা গেল যে, জনমননে লালিত হয়ে থাকা ভ্রান্ত ধারণাকে নির্মূল করতে হলে সাগরপারের বুভুক্ষু বেনিয়াদের সংগ্রহশালা অবধিও পৌঁছনো দরকার, যেটা তিনি করে দেখিয়েছেন। সেই সরল সত্যটি তিনি যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করে গেছেন, আবার প্রাঞ্জলভাষ্যেও তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সেমিনারে, সভা-সমিতিতে এবং ভিড়ে ঠাসা অডিটোরিয়ামে, যে বিষয়টি উপলব্ধ হয়েছিল শিলচর বঙ্গভবনের প্রেক্ষাগৃহে।
১৪ মাঘ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ ( ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ ) তারিখে, বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন পরিচালিত দূরশিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষা সমাপন অনুষ্ঠান ২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি এবং বীজবক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক, ‘আসামে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থ প্রণেতা তথা যোরহাট কলেজের  অধ্যক্ষ ড. দেবব্রত শর্মা। শিলচর বঙ্গভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সেদিনের বীজবক্তা ড. শর্মা অকপটে বলেন, তিনি যেখানেই যান, সেখানকার মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সেই ভাষাতেই বক্তব্য রাখার চেষ্টা করেন, সেটা চা-জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা হোক কিংবা অন্যান্য জাতি-উপজাতি এলাকায়ই হোক। সেই ধারাবাহিকতাটিই বজায় রাখলেন বঙ্গভবনের এই অনুষ্ঠানে। বাংলা ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আগাগোড়াই বক্তব্য পেশ করলেন নিখাদ শুদ্ধ বাংলা ভাষায়

এদিনের সভায়, খ্রিস্টিয় সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু করে সাম্প্রতিককাল অবধি ঘটে যাওয়া বরাক-ব্রহ্মপুত্রের অনেক কথাই নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন ড. শর্মা।
ড.দেবব্রত শর্মার সেদিনের বক্তৃতা শুনতে শুনতে একসময় মনে পড়লো ‘আসাম বুরঞ্জি’ প্রণেতা হলিরাম ঢেকিয়াল ফুক্কনের কথা, যিনি কলকাতার বঙ্গভাষা-ভাষী সুহৃদ তথা জনগণের সামনে আসামের ঐতিহ্যমণ্ডিত পরিচিতি তুলে ধরতে গিয়ে সুললিত বাংলা গদ্যে লিখেছিলেন “আসাম বুরঞ্জি” ( আসামের ইতিহাস )। ( শ্রীযুত ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়েনাঙ্কিত এবং কলিকাতা সমাচার চন্দ্রিকা যন্ত্রে মুদ্রাঙ্কিত, শকাব্দ১৭৫১, বাঙ্গলা ১২৩৬ সাল ১৭ কার্তিক, ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত গ্রন্থ)। এই গ্রন্থের ভাষা নিয়ে লিখতে গিয়ে ড. সূর্যকুমার ভূঞা লিখেছেন, “পুস্তক পাঠ করিলে কেহ অনুমান করিতে পারিবেন না যে, লেখকের মাতৃভাষা অসমীয়া; বাঙ্গালা ভাষায় এবং বাঙ্গালা রচনায় ঢেকিয়াল ফুকন মহাশয়ের এত সহজ ব্যুৎপত্তি ছিল।” ( সূত্র : যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য এম এ তত্ত্বরত্নাকর সম্পাদিত, হলিরাম ঢেকিয়াল ফুক্কন বিরচিত ‘আসাম বুরঞ্জি’, মোক্ষদা পুস্তকালয়, গৌহাটী, আসাম, ১৩৬৯ বাংলা গ্রন্থের পরিশিষ্ট লেখক শ্রীসূর্যকুমার ভূঞা, পৃষ্ঠা-২১ )। শিলচর বঙ্গভবনেও এদিন ড. শর্মার ভাষণ শুনে কখনও মনে হয়নি যে, ভিড়ে ঠাসা এই মিলনায়তনে বাংলা ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা দিচ্ছেন যিনি, তিনি অবাঙালি কোনও অধ্যাপক ।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে ড. শর্মা আরও বলেন যে, ব্রিটিশরা বিভাজন নীতি নিয়ে শাসনকার্য চালিয়ে গিয়েছিলেন এই দেশে। এটি করতে গিয়ে যেখানে যে রকম পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন সেখানে সেটি প্রয়োগ করে গিয়েছিলেন। পারস্পরিক বিভেদ-দ্বন্দ্বকে হাতিয়ার করে তাঁরা এই দেশ শাসন করে গিয়েছিলেন। বাংলায় যেমন হিন্দু-মুসলিম বিভাজন নীতি চালানো হয়েছিল, ঠিক তেমনি অসমে বাঙালি ও অসমিয়াদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির জন্য ভাষা নিয়ে বিভাজন নীতি প্রয়োগ করেছিলেন। তার মানে এই নয় যে, ব্রিটিশরা অসমিয়া ভাষা সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল, বরং তাঁরা ইয়াণ্ডাবু সন্ধিচুক্তির বহু আগে থেকেই অসমিয়া ভাষার ব্যাপারে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলেন অসমিয়া ভাষা ও লিপিতে সাঁচিপাতায় লিখে রাখা একাধিক গ্রন্থ-পুঁথি। এমনকি অসমিয়া ভাষা নিয়েও রীতিমত চর্চা করতেন ব্রিটিশ পণ্ডিত-গবেষকরা। আহোম রাজদূত রত্নকন্দলী ও অর্জুনদাস বৈরাগীদের ত্রিপুর ভ্রমণের উপর সাঁচিপাতায় লিখিত “ত্রিপুর বুরঞ্জি ” পাণ্ডুলিপিটি এভাবেই ব্রিটিশের হস্তগত হয়েছিল, ৮ জানুয়ারি ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে। প্রসঙ্গত, ব্রিটিশ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ এই পাণ্ডুলিপিটি ক্রয় করেছিলেন  জে রডের কাছ থেকে এবং যথাসময়েই এটি রক্ষিত হয়েছিল লন্ডনস্থিত ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামে। এই ঘটনার ৯৪ বছর পর ১৯৩৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে ড. সূর্যকুমার ভূঞাঁ যখন গবেষণার উদ্দেশ্যে লন্ডন গিয়েছিলেন, তখন তিনি সেখানকার ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ওরিয়েন্টাল বুকস অ্যান্ড ম্যানুস্ক্রিপট-এর এর কিপার ড. লিওনেল ডি বারনেটের সৌজন্যে সাঁচিপাতায় অসমিয়াতে লেখা এই পাণ্ডুলিপিটির ফটোস্ট্যাট সংগ্রহ করেছিলেন।
উপরোক্ত কথাটি এখানে উল্লেখ করছি একারণেই যে, যোরহাট কলেজের অধ্যক্ষ তথা স্বনামধন্য গবেষক, “১৯৬০ চনর ভাষা আন্দোলন ” সহ আরও বহু গ্রন্থের প্রণেতা ড. দেবব্রত শর্মাও প্রবাদপ্রতীম গবেষক ড. সূর্য্যকুমার ভূঞার মতোই লন্ডনস্থিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা একাধিক অসমিয়া পুঁথির কপি উদ্ধার করে এনেছিলেন, এবং বহুকাল ধরে অসমিয়া জনমননে ঠাঁই নেওয়া অনেক ভ্রান্ত ধারণা পরিবর্তনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন নিরলসভাবে। বঙ্গভবনে শর্মার ভাষণ শুনতে শুনতে একসময় ড. সূর্য্যকুমার ভূঞা, বিদ্যাবিনোদের  ‘ত্রিপুর বুরঞ্জি’ উদ্ধারের কথাটি মনে পড়ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, ড. সূর্য কুমার ভূঞার সম্পাদনায় এবং ‘ বুরঞ্জী আরু পুরাতত্ত্ব বিভাগ, অসম চরকার” এর তরফ থেকে উপরোক্ত পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৮ সালে। ড. শর্মা এদিন সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করেছেন মহামহোপাধ্যায় পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদকে এবং প্রাসঙ্গিকভাবেই উঠে এসেছে তাঁর গ্রন্থিত “কামরূপ শাসনাবলী”র কথাও। মহামহোপাধ্যায়ের পাশাপাশি প্রবাদপ্রতীম ইঞ্জিনিয়ার ও প্রত্নতাত্ত্বিক রাজমোহন নাথের বাংলা, অসমিয়া ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত গবেষণাবলী নিয়েও বক্তব্য রেখেছিলেন ড. দেবব্রত শর্মা মহাশয়।
অধ্যাপক ড. শর্মার ভাষণে ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গটি উঠে এসেছিল। এই ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে যেমন পিয়ালি ফুকনের হত্যার প্রসঙ্গটি এসেছিল, তেমনি এসেছিল সুবেদার রজব আলী / রাজবুলি খানের নেতৃত্বে সংঘটিত, ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের দ্রোহতট লাতু মালেগড়ের মহাসংগ্রামের বিষয়টিও। অপরদিকে,কুড়ি শতকের প্রথমদিকে,ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছিল ১৯২১ সালের, চরগোলাভ্যালির চা-শ্রমিকদের মরণপণ মহাসংগ্রাম ” চরগোলা এক্সোডাস ” এর প্রসঙ্গটিও।
১৯৬০- ‘৬১ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন, উনিশে মে তারিখের এগারো শহিদের প্রসঙ্গটিও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে ড. শর্মা উল্লেখ করেছেন যে, এই ভাষা আন্দোলনে শুধুমাত্র এগারোজন শহিদ হননি, সমগ্র আসাম জুড়ে সংঘটিত হওয়া এই আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করেছিলেন আরও বহু বঙ্গভাষী জনগণ। তাঁদের পরিচিতিও যথাস্থানে তিনি লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। কোনো রাখঢাক না রেখে দৃপ্তকন্ঠে উচ্চারিত এই সাহসী বক্তৃতায় অসম সাহিত্য সভার প্রসঙ্গটি যেমন উঠে এসেছিল তেমনি উঠে এসেছিল রাজনৈতিক নির্লিপ্ততা ও দ্বিচারিতার প্রসঙ্গটিও।
প্রবাদপ্রতীম অধ্যাপক, গবেষক ড. সূর্য্যকুমার ভূঞার যথার্থ উত্তরসূরী ড. দেবব্রত শর্মার প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker