NE UpdatesBarak UpdatesHappeningsBreaking News

শিব-পার্বতীর বিয়ে দিয়েই নতুন বছরের শুভকামনা করেন কাছাড়ের কোচ রাজবংশীরা

ওয়েটুবরাক, ১৯ এপ্রিল : নববর্ষের প্রাক-সন্ধ্যায় শিব-পার্বতীর কাছে তিন বর প্রার্থনা করেন কাছাড়ের কোচ রাজবংশীরা৷ নতুন বছরে যেন খুব ভাল ফসল হয়, প্রতিটি মানুষ যেন সারা বছর সুস্থ থাকেন৷ একই সঙ্গে গ্রামের মানুষের সার্বিক মঙ্গল কামনা করেন তাঁরা।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে কাপড় দিয়ে পুতুল বানিয়ে শিব-পার্বতীর বিয়ে দেওয়া হয়। একে ঘিরে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে লারসিংপার, হরিনগর সহ সবকটি রাজবংশী গ্রাম৷ নতুন বছরকে আবাহন জানাতে গিয়ে বিয়ের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানই পালন করেন তাঁরা।

লারসিংপারের উমানন্দ রাজবংশী, হরিনগরের ডুলেট রাজবংশী ও রাজনী রাজবংশী জানান, মূলত অবিবাহিত তরুণীরাই এই পার্বণের উদ্যোক্তা৷ ১৪-১৫ পরিবার মিলে একেকটি গোষ্ঠী তৈরি হয়৷ তরুণীরাই বসে স্থির করেন, কোন বাড়িতে বর থাকবেন, কোন বাড়িতে কনে৷ কত খরচ হবে, কারা কত চাঁদা দেবেন৷ বাজেটটাও এরাই বানান৷

অধিবাস, বরযাত্রী নিয়ে বরের আগমণ, সাত পাক, মালাবদল, সিঁদুর পরানো সবই হয় কোচ রাজবংশীদের বিয়ের বিধান মেনে৷ কেউ কেউ বাজি পোড়ায়, বাজনা বাজায়৷ লাইন ধরে সবাই গিয়ে নবদম্পতিকে উপহারও প্রদান করেন৷ এক চিলতে নতুন কাপড় এবং এক বা দুই টাকার ধাতব মুদ্রা৷

শুধু ফারাক, বর গাড়ি চড়ে যান না৷ শিবঠাকুর বলে কথা, তিনি সুসজ্জিত পাল্কিতে চেপে কনের বাড়ি আসেন৷ বিয়ে সেরে রাতেই কনেকে নিয়ে রওয়ানা হন৷ কৈলাশে পৌঁছার জন্য তাদের নদীতে নিয়ে ছাড়া হয়৷ সঙ্গে যায় সব উপহারসামগ্রী৷ গ্রামবাসী সবাই পরে নদীতে স্নান সেরে বাড়ি ফিরে আসেন৷

এ শুধু আনন্দ-স্ফূর্তি বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাস। কনের বাড়িতে রামায়ণ-মহাভারত পাঠ হয়৷ হয় হরিনাম সংকীর্তন, মেয়ে বিদায়ের গীতও৷ চলে পূজার্চনা৷ পরে প্রসাদ বিতরণ৷ চিড়া, কলা, বাতাসা, নারকেল ইত্যাদি একসঙ্গে মেখে পরিবেশন করা হয়৷ তাই পুতুল বিয়েতেও গোটা গ্রাম জড়িয়ে পড়ে। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, সকলের কাছে চৈত্র সংক্রান্তি এক পবিত্র দিন।

জগন্নাথ সিংহ কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. স্বপন দাসের গবেষণা গ্রন্থে রয়েছে, কাছাড়ের নয়টি গ্রামে কোচ রাজবংশীরা বসবাস করেন৷ কোচ দেওয়ান চিলারায় নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে করতে কাছাড় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন। যুদ্ধজয় করে ফিরে যাওয়ার সময় সৈনিকদের একাংশ এখানে থেকে যান৷ তাঁদের বংশধরদেরই প্রায় এক হাজার পরিবার এখানে বসবাস করে। দেওয়ানের বংশধর বলে আগে তাঁদের দেওয়ানি বলা হতো৷ এখনও কেউ কেউ কোচদের দেওয়ানি বা ধেয়ানি বলেন৷ তবে বর্তমানে তাঁরা রাজবংশী হিসেবেই বেশি পরিচিত৷

লোক-সংস্কৃতির গবেষক ড. অমলেন্দু ভট্টাচার্য জানান, কোচ রাজবংশীরা ষোড়শ শতকে এখানে আসেন৷ সঙ্গে নিয়ে আসেন নিজস্ব সংস্কৃতি-পরম্পরা৷ কোচবিহার বা অসমের অন্যান্য অঞ্চলে কোচ সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যান্য সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটলেও কাছাড়ের রাজবংশীরা নিজেদের পরম্পরা ধরে রেখেছেন৷ তাই অন্য কোনও এলাকায় কোচদের শিব-পার্বতীর বিয়ের আয়োজন না হলেও তাঁর বিশ্বাস, এটি বহু প্রাচীন কোচ পরম্পরা, সম্ভবত অন্যত্র হারিয়ে গিয়েছে৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker