Barak UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking News
শহরে জল ঢোকা ঠেকানোর জন্য নদীখনন জরুরি, লিখেছেন মহীতোষ পাল
৷৷মহীতোষ পাল৷৷
শিলচরে আগে তো জমা জলের সমস্যা ছিল না। এখন কেন এই সমস্যা? এই প্রশ্নের জবাবের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সমাধানের সূত্র। আসলে বরাক নদী তার গভীরতা হারিয়েছে। অথচ শহর শিলচরের সমস্ত জল বেরিয়ে যায় বরাক নদী হয়ে। কাজেই বরাক খনন সঠিকভাবে না করে জমা জলের সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। স্মরণকালের মধ্যে ১৯৬৬, ১৯৭৬, ১৯৮৫, ১৯৮৬ এবং খুব সম্ভবত ১৯৯৩ সালে শহরে ঢুকেছিল বন্যার জল। সেটা ছিল বন্যা। নদীর পাড় ছাপিয়ে ঢুকেছিল জল। কিন্তু সে বন্যাগুলি কিছু শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল শহরবাসীকে, যা আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তা নেতারা উপলব্ধি করতে পারেননি। সেদিনও না, আজও নয়।
৬৬-তে মূলত জল ঢুকেছিল তারাপুর এলাকা দিয়ে। ফলে ডুবেছিল পশ্চিম শিলচর। ছিয়াত্তরে নদী ঢুকে যায় কনকপুর শরৎপল্লীর দিক থেকে। বানভাসি হয়েছিল মুখ্যত দক্ষিণ শিলচর। ১৯৮৫ এবং ৮৬ সালে প্রায় পুরো শহরই প্লাবিত হয়। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম, গোটা শহর এবং শহরতলি জল থৈ থৈ হয়েছিল। ফলে যাদের টপোগ্রাফির সাধারণ জ্ঞানও নেই, তারাও বুঝে গিয়েছিলেন শহরের জমির ঢাল কোনদিক থেকে কোনদিকে। বোঝেননি আমাদের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা।
মাটির ঢালের হিসেবে শিলচরকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ মালুগ্রাম। অন্নপূর্ণা ঘাট থেকে ইরাবত সরণি হয়ে জন স্মিল পর্যন্ত আমরা যদি একটি রেখা টানি, তবে তার উত্তরে যে অংশ থেকে যায়, সেই এলাকার জল বিভিন্ন ছোট ছোট নালা ও খাল হয়ে বেরিয়ে যায় সোজা বরাক নদীতে। এখানে অর্ধবৃত্তাকার বাঁধ রয়েছে, এবং সেই বাঁধে রয়েছে মোট সাতটি স্লুইস গেট। তার সব ক’টিই অকেজো এবং ভাঙা। জল বেরোনো বা উল্টে নদী থেকে ঢোকা, কোনোটা আটকানোর ক্ষমতা সেগুলির নেই। দ্বিতীয় ভাগটি বিশাল। তারাপুর, মধ্যশহর, চামড়া গুদাম, বিলপার, অম্বিকাপুর, চেংকুড়ি রোড, সোনাই রোড, শরৎপল্লী, লিংক রোড, ন্যাশনাল হাইওয়ে সহ দ্বিতীয় লিংক রোডের সীমানা পর্যন্ত জল সিঙ্গিরখাল, লঙ্গাই খাল, চার্চ রোড – অম্বিকাপট্টির খাল, সেন্ট্রাল রোড – সাঁইবাবার মন্দির – জেলা গ্রন্থাগার – ইন্ডিয়া ক্লাবের খাল ইত্যাদি ছোট নালা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রাঙ্গিরখাড়ি খাল বেয়ে ঘাগরা নদীতে। ঘাগরা গিয়ে পড়েছে বরাকে।
আর তৃতীয় অংশটি হচ্ছে, এদিকে সেকেন্ড লিংক রোড, কাঁঠাল রোড, মেহেরপুর থেকে মেডিকেল কলেজ আর নাগাটিলা থেকে সোনাবাড়িঘাট পর্যন্ত এলাকা। এই অংশের জল বেরোচ্ছে বোয়ালজুর খাল হয়ে। গিয়ে অবশ্য পড়ছে সেই ঘাগরা নদীতেই। কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এই তৃতীয় অংশ নিয়ে খুব মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি মনে করি আছে। এই অংশের জল ঘাগরাতে যাওয়ায় ঘাগরা ফুলে থাকে। তাই রাঙ্গিরখাড়ির জল নামার গতি কমে যায়। তাছাড়া এই অংশের কিছু জল এদিক ওদিক ঘুরে রাঙ্গিরখাড়িতেও আসে।
শিলচর মাস্টার ড্রেনেজ প্রকল্পের শুরু হয়েছিল যখন বীথিকা দেব পুরসভার চেয়ারপার্সন ছিলেন। এই কাজের বরাত দেওয়া হয়েছিল এনবিসিসি-কে, ড্রেনেজ প্রকল্প রূপায়ণের কোনো অভিজ্ঞতাই যাদের ছিল না। তারা বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন। কাজে হাত দিয়ে তারা সোনাই রোড, হাইলাকান্দি রোড, হাসপাতাল রোড, সেন্ট্রাল রোড, তারাপুর সহ বেশ কিছু এলাকায় ড্রেন তৈরি করেছিল। কাজের গুণমান কী ছিল, তা সবাই জানেন। সে প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না। আমার প্রশ্ন, আপনারা যখন নিজেদের বাড়ির জল বের করার জন্য নালা তৈরি করেন, তখন শুরু করেন কোন পয়েন্ট থেকে? স্বাভাবিক ভাবেই সবচেয়ে নীচু অংশ অর্থাৎ যেখানে জল আপনার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে, সেখান থেকে। কিন্তু এনবিসিসি কাজ শুরু করল সবচেয়ে উপরের অংশ থেকে। ফলে ড্রেন কাম ফুটপাথ হলো ঠিকই, কিন্তু সেই জল বেরিয়ে যাওয়ার উপায় রইল না। বিভিন্ন বড় খালের যে অংশে এইসব ড্রেনের মুখ রাখা হলো, জল সেখানে পৌছালোই না। আর সামান্য অংশ যদি বা পৌছায়, তা নামতে পারল না৷ কারণ সেই পয়েন্টে খালের আর ড্রেনের গভীরতা সমান।
তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে, এনবিসিসি ওই ড্রেনেজ প্রকল্পের কনস্ট্রাকশনের কাজ করতে মোটেই উৎসাহী ছিল না। তাদের নজর ছিল প্রাথমিক সার্ভে এবং প্রজেক্ট পেপার তৈরির জন্য যে বিশাল অঙ্কের টাকা বরাদ্দ ছিল, সেইদিকে। সেই টাকা পকেটে পুরে তারা কাজ সাব-কন্ট্রাক্ট দিয়ে দিল স্থানীয় বিভিন্ন ঠিকাদারদের মধ্যে। শিলচরবাসীর সবচেয়ে বড় দোষ হলো নেতানির্ভরতা। নেতা যা করছেন, নিশ্চয় ভালোর জন্য ভালোভাবেই করছেন। কাজেই আমাদের আর কিছুই করার নেই। ঠিকাদারেরা তাদের লাভের গুড় গুছিয়ে রেখে নিজের মত কাজ করে যেতে লাগল, আর আমরা সেদিকে নজর রাখার তেমন কোনো তাগিদই অনুভব করলাম না। যখন ড্রেন গুলো বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে পড়তে আরম্ভ করল, আমরা চেঁচালাম। যন্ত্রপাতি ক্ষুদিরাম মূর্তির সামনে ফেলে রেখে ঠিকাদার কাজে ভঙ্গ দিলো। সেই যন্ত্রপাতিও একদিন কৌশলে সরিয়ে নিয়ে গেলেন হাইলাকান্দির তৎকালীন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ মন্ত্রী। সেই সমস্ত যন্ত্রপাতি যে আবার ঠিকঠাক ঠিকাদারের বাড়িতে পৌছে গেছে, সে খবর আমরা জেনেও জানি না। এভাবেই কেটে গেল প্রাক্তন শাসকদের আমল।
ধর্মীয় জিগির তুলে আর বরাকের প্রতি সমদৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে হিটলারের মত জনপ্রিয়তা নিয়ে দিসপুরেও ক্ষমতার পালাবদল হলো। সমদৃষ্টির উদাহরণ সৃষ্টি করতে নমামি ব্রহ্মপুত্রের পর অনুষ্ঠিত হলো নমামি বরাক নামের মোচ্ছব। ঢালাও প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে গেল। পোস্টারে বরাক নদীর শুশুক। “বরাক, এক সম্ভাব্য সম্ভাবনার আকর” জাতীয় ভুল বাংলায় ছাপা পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। আমাদের যুবক যুবতীরা উৎসবস্থলে গিয়ে প্রচুর সেল্ফি তুলে ফেসবুকে হোয়াটস অ্যাপে তুফান তুলল। সুদিন এসে গেছে। বরাক নদী খনন হবে। প্রায় রোজই শুনতে পাচ্ছিলাম, খননের কাজ শুরু হয়ে গেছে। শিলচর অব্দি এসে পৌছেই যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কি দেখেছেন অন্নপূর্ণাঘাট, মধুরাঘাট বা সদরঘাটে খনন কার্য চলতে? বরাক নদী উপযুক্ত ভাবে খনন না করলে শিলচরের জমা জলের সমস্যা এক চুলও কমবে না।
এটা জেলাশাসককে মেমোরেন্ডাম দিয়ে পত্রিকাতে ছাপালেই সমাধান হবে না। বিশাল অঙ্কের টাকার ব্যাপার আছে, বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপার আছে। এগুলো কির্তি জল্লি, লায়া মাদ্দুরি, এস লক্ষ্মণন বা বিশ্বনাথনেরও ক্ষমতার বাইরে। এর পরের প্রসঙ্গ, অপরিকল্পিত শহর বৃদ্ধির। কর্ণেন্দু ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে প্রদীপ নন্দী, সন্দীপন এন্দো, পার্থ চক্রবর্তী….(আরো নাম যোগ হতে পারে) মহোদয়দের আমলে শিলচর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং পরবর্তীতে শিলচর পুরসভা যেভাবে ঢালাও বাড়ি নির্মাণের পারমিশন দিয়েছেন, তা আমাদের শহরের জল নিষ্ক্রমণের পথকে অবরুদ্ধ করেছে। অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করেই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনুমতির সীমানা না মেনে যথেচ্ছ বাড়ি বানিয়েছি আমরা।
শহরের বৃষ্টির জলের স্বাভাবিক জলাধার মালিনী বিলের অস্তিত্ব প্রায় বিলোপ হয়েছে, কর্তৃপক্ষ এবং নাগরিকেরা তা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছি। পুলিশ প্যারেড গ্রাউন্ড, ইন্ডিয়া ক্লাবের মাঠ ইট-কাঠ-সিমেন্টে “শোভিত” হয়ে উঠছে, আমরা নগরায়ণের মোহ-ঠুলি চোখে মুগ্ধ নয়নে দেখেই চলেছি। ছোট প্রাকৃতিক নালা গুলি বেদখল হয়ে দোকান বাড়ি গজিয়ে উঠে জল আটকে দিচ্ছে, নাগরিকেরা এবং কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। জমা জলের সমস্যা সৃষ্টি করেছি আমরা। আমি, আপনি, তিনি, সবাই। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে। এই দীর্ঘদিনের নাগরিক উন্নাসিকতা এবং নেতা ও প্রশাসকদের ব্যর্থতা আজকের এই সমস্যা তিলে তিলে গড়ে তুলেছে। কাজেই একদিনে বা এক মাসে বা এক বছরে এর সমাধান নেই। হাজার, লাখ বা কোটি টাকায় এর সমাধান হবেনা। যদি তেমন নাগরিক সচেতনতা, দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে মাঝপথে কেটে না পড়ে ধারাবাহিক আন্দোলনের মানসিকতা গড়ে তোলা যায়, যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা সম্পন্ন যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠিত হয়, তবে বেশ কয়েক বছরের চেষ্টায়, বেশ কয়েক শত কোটি টাকা খরচ করে এই সমস্যা দূরীভূত হতে পারে।
আরেক সমস্যা মনিপুরের জল। সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি কাঁঠালের আমসত্বের কথা। যার কোনো অস্তিত্বই নেই, তাকে দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাগর চুরি (পুকুর চুরি বললে সেই চুরির বিশালতা ধরা পড়বে না।) ঢাকার অত্যন্ত সফল কৌশল। ১৯৮০-৮১ সালে তিপাইমুখ ড্যাম প্রজেক্টের সার্ভের কাজে পুরো বরাক চষে বেড়িয়েছি। কোনো হাইডেল প্রজেক্টের সন্ধান পাইনি৷ বরাকের উপর কোত্থাও কোনো হাইডেল প্রজেক্ট, ড্যাম বা ব্যারেজ নেই। সাধারণত আমরা জিরি, সোনাই বা কাটাখাল নদীকে বরাকের সব চেয়ে বড় উপনদী বলেই মনে করি। কিন্তু না, বরাকের সবচেয়ে বড় উপনদী হচ্ছে আলং। তিপাইমুখ থেকে অনেক উপরে এসে বরাকে মিশেছে আলং। যেখানে মিশেছে, সেখানে বরাক আর আলং প্রায় সমান আকারের নদী। আলং এসেছে মধ্য মণিপুরের জল নিয়ে। বরাক আনছে উত্তর আর পশ্চিম মণিপুরের জল।
এই আলঙের এক ছোট্ট উপনদীর নাম লাইমাতাক। সেই লাইমাতাকের আরেক ছোট নাম না জানা উপনদী (আসলে রাঙ্গিরখাড়ি খালের চেয়ে সামান্য বড় ছড়া) এসেছে লোকতাক হ্রদের পশ্চিমপাড়ে অবস্থিত পাহাড় থেকে। লোকতাকের পাওয়ার হাউসটি এই ছড়ার পাশে অবস্থিত। কিন্তু কোনোভাবেই এটি লোকতাকের সঙ্গে যুক্ত নয়। এই ছড়া দিয়ে কিছু জল এসে লাইমাতাক এবং আলং হয়ে বরাকে আসে। অতএব এটা স্পষ্ট যে, কোনো ড্যাম, ব্যারেজ বা হাইডেল প্রজেক্টের জল মণিপুর থেকে বরাকে আসে না। লোকতাকের স্বাভাবিক ঢাল পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে। লোকতাকের সারপ্লাস জল খোরদাক এচিল নামের এক ছোট্ট নদী আর ইম্ফল নদী হয়ে দক্ষিণে গিয়ে মায়ান্মারের চিন্দুইন নদীতে চলে যায়। তা হলে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিক প্রজেক্টের জল এলো কোথা থেকে? আসলে শত শত কোটি টাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণের টাকা হাপিস হয়েছে। লোক দেখানো কাজ হয়েছে (সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে) আর বর্ষা এলেই বাঁধ ভেঙেছে বা বাঁধ টপকে বন্যার সৃষ্টি করেছে। তখন সাধারণ মানুষের রোষের জবাব দিতে গিয়ে “মণিপুরের জল ছাড়া”র গল্প ফাঁদা হয়েছে।