Barak UpdatesIndia & World UpdatesHappeningsCultureBreaking News
ভাস্কর্যে ছন্দের রূপকার সুষেন ঘোষ প্রয়াত
ওয়েটুবরাক, ১৮ এপ্রিল: বিষয়ের প্রতি নিখাদ ভালবাসা, লক্ষ্যে পৌঁছার অপরিসীম জেদ, নিষ্ঠা, অনুশীলন এবং বুকভরা সাহস কখন যে কাকে সাফল্যের শিখর চূড়ে নিয়ে যায় তা কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারেন না। বরাকের বহু মেধা এই পথে আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বভর নন্দিত বন্দিত হচ্ছেন। ভারতীয় ভাস্কর্যে এমনই এক নাম শিলচরের সুষেন ঘোষ । স্থান, কাল, পরিবেশের প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিরাট সুনাম অর্জন করেছিলেন। ভারতীয় ভাস্কর্যে ছন্দের রূপকার হিসাবে গণ্য হন তিনি। কিন্তু কালের নিয়মে থেমে গেল এবার তার জীবনের ছন্দ। প্রয়াত হলেন বিশ্বখ্যাত ভাস্কর তথা শান্তিনিকেতনের কলা ভবনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সুষেন ঘোষ। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৩। তার মৃত্যুতে গভীর শোকের ছায়া শান্তিনিকেতন সহ ভারতীয় শিল্পী মহলে।
বেশ কিছুদিন থেকেই শরীর ভালো যাচ্ছিল না তাঁর। এর মধ্যে গত বছর বোন তথা বরাকের প্রথম মহিলা ভাস্কর জয়ন্তী ঘোষের মৃত্যু হয়, যার অজ্ঞাত প্রভাব একটাও পড়েছিল সুষেনের ওপর। রবিবার হঠাৎ করে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত কারণে ভর্তি করা হয় তাকে বোলপুরের অনন্যা নার্সিংহোমে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি । মঙ্গলবার বেলা ১২.৪০ টা নাগাদ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বর্ষীয়ান শিল্পী । খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিভিন্ন মহলে শোকের ছায়া নামে । হাসপাতাল এবং বাড়িতে বিভিন্ন স্তরের শিল্পী, কলা ভবনের শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রাক্তনীদের ভিড় জমে ওঠে । বোলপুর শ্মশানে মঙ্গলবারই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সেখানেও ছিল অনুরাগীদের ভিড়। শিলচরের শিল্পী মহলেও শোকের আবহ। শোক প্রকাশ করেছে বরাকের বিভিন্ন শিল্পী ও শিল্প সংগঠন। মৃত্যুকালে শিল্পী রেখে গেছেন স্ত্রী সবিতা ঘোষ, মেয়ে মহুয়া ঘোষ, জামাতা এবং এক নাতি সহ অসংখ্য গুণমুগ্ধকে।
ষাটের দশক। শিলচরের শিল্পক্ষেত্রে তখন ছড়িয়েছিল চাপ চাপ অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারের বুক চিরে শিল্পকে ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ে তুলতে যে কজন দামাল ছেলে বাইরে ছুটে গিয়েছিল তার মধ্যে সুষেন ঘোষের নাম প্রথম সারিতে । জন্ম ১৯৪০ সালের ১ মে। বাবা গিরীন্দ্র ঘোষ ব্যবসায়ী, মা কুমুদিনী দেবী। সুষেনের ছাত্রজীবনের প্রাথমিক ভাগটা কাটে বাংলাদেশের কুলাউড়ায়। এরপর শিলচর নরসিং স্কুল থেকে জিসি কলেজ । বাড়িতে তখন শিল্পের অনুকূল পরিবেশ যে খুব ছিল এমন নয়। তবে শিলচর নরসিং স্কুলের শিল্প সহযোগী পরিবেশ, দুই শিক্ষক গিরীন্দ্র মোহন নাথ এবং লালমোহন নাথের সান্নিধ্য মনে সৃষ্টির তাগিদকে ত্বরান্বিত করল । আর বাকিটা আর্যপট্টিতে নাট্যকার সাধন দত্তের মঞ্চসজ্জা এবং তার কাজকর্ম সুষেনকে ঠেলে দিলো শিল্পপথে। তাছাড়া কলকাতা থেকে আসা বিভিন্ন ম্যাগাজিনের অলংকরণ এবং বীরেন্দ্র লাল ভৌমিকের চিত্রলেখা ড্রয়িং বই শিশু মনে ছাপ তো অবশ্যই ছেড়েছিল। গোটা জেলায় তখনই নাম ছড়িয়েছিল সুষেনের। এরই মধ্যে আসাম ট্রিবিউন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে প্রথমবার আসাম সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে প্রাণের বন্ধু শুচিব্রত দেবকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৫৯ সালে সুষেন পাড়ি জমালেন রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য কলাভবনে।
পেলেন নতুন জীবনের সন্ধান । সান্নিধ্য পেলেন ভারতের কিংবদন্তি ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বর্মন, অরুণ পালের মতো শিল্প শিক্ষকদের। অসীম ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপ দিলেন শিল্প-সাগরে। শান্তিনিকেতনের পরিবেশের সঙ্গে কোথাও যেন মিল খুঁজে পেলেন ফেলে যাওয়া শিলচরের প্রকৃতির । সেখানকার মাঠ, জল-জঙ্গল, মানুষ, সাংস্কৃতিক আবহে গুঞ্জরিত সংগীতের ছন্দে ভাস্কর্যের ছন্দের আবিষ্কার করলেন তিনি। ধীরে ধীরে রামকিঙ্কর বেইজের সবচেয়ে যোগ্য ছাত্র হিসাবে নিজেকে গড়ে তুললেন । ১৯৬৩ সালে সসম্মানে স্নাতক হলেন। ইতিমধ্যে রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে ‘যক্ষ-যক্ষী ভাস্কর্য গড়ার জন্য রামকিঙ্কর রওয়ানা দিলেন দিল্লি । বলে গেলেন, ‘আমার অবর্তমানে ভাস্কর্যের ক্লাসগুলো তুমিই দেখবে।’ সেই থেকে কলা ভবনে অধ্যাপনা শুরু সুষেনের । আর কলাভবনের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নেন ২০০২ সালে । জনক ঝংকার নার্জারি, পঙ্কজ পানোয়ার, চন্দ্রবিনোদ পান্ডের মতো জীবনে বহু ছাত্র গড়েছেন, যারা শিল্প ক্ষেত্রে সমীহ সৃষ্টিকারী নাম অর্জন করেছেন।
আজীবন নিজের সৃষ্টিতে মগ্ন থেকেছেন সুষেন। মিতভাষী, বরাবর প্রচারবিমুখ শিল্পী নিজের সৃষ্টির পসরা বাইরের জগতকে দেখানোর তাগিদও খুব একটা অনুভব করেননি। তবুও কলাভবন এবং নন্দন প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে থাকা তার বিশাল ভাস্কর্যগুলি শিল্পীর সৃষ্টির অনন্যতা বয়ান করছে। প্রদর্শনীর সংখ্যাও খুব কম । কলকাতার ‘বিড়লা অ্যকাডেমি অফ ফাইন আর্টস’র একক প্রদর্শনী, ২০০৬ সালে বিড়লা একাডেমিতে রেট্রোস্পেকটিভ তাঁর প্রদর্শনীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যদিও বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ সমাদৃত হয়েছে। মিলেছে বহু পুরস্কার। আপন জগতে ধ্যানস্থ সুষেন খুব একটা বাইরে যাননি। তবে এর মধ্যে লন্ডনের গোল্ড স্মিথ কলেজে গিয়ে এক বছরের একটা ভাস্কর্যের কোর্স করেছেন বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে ।
কিন্তু জীবনে কটা প্রদর্শনী করেছেন সেটা দিয়ে কোনদিনই সুষেন ঘোষের শিল্পী সত্বার যথার্থ মূল্যায়ন হবে না। যেমন হয় না তার গুরু রামকিঙ্করের। কিন্তু সমকালীন ভাস্কর্যে একটা নতুন দিশা এনে দিয়েছেন সুষেন, সেটা শিল্প সমালোচক মাত্রেই স্বীকার করেন।
রবীন্দ্র ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পী রবীন্দ্র স্বপ্ন সাধিত শান্তিনিকেতনে খুঁজে নিয়েছিলেন শেষ আশ্রয়। জীবনের হাতছানিতে এগিয়ে চলার পথে জন্ম ভিটের সঙ্গে বন্ধন হয়েছে শিথিল, তবু একেবারে ছিন্ন হয়নি। ২০১০ সালে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার পরীক্ষক হিসেবে এসে গিয়েছেন।
২০১৮ সালে শেষ বার এসেছিলেন শিলচর। সে সময় তাকে বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন এবং বরাক ভাস্কর সংস্থা ‘রূপকার’র তরফে সংবর্ধনা জানানো হয় । তাছাড়া শিলচরের বহু শিল্পীর সঙ্গে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক। এ অঞ্চলের প্রতিভাবান ভাস্কর বিনয় পাল সুষেনের ভাস্কর্যের উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন।