India & World UpdatesHappenings
ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য ভয়াবহ ২০২০: পিইসি
গুয়াহাটি, ৪ জানুয়ারি: : ভারতীয় সাংবাদিকদের জন্য মহামারির ২০২০ সালটি ভয়াবহ। সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের দিক দিয়ে এ বছর তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে ভারতের নাম। জনবহুল এই দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৫০ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত দেশটিতে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। বছরজুড়ে পৃথিবীর ৩১টি দেশে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৯২টি। এই তথ্য উঠে এসেছে জেনেভাভিত্তিক মিডিয়া ওয়াচডগ প্রেস এমব্লেম ক্যাম্পেইন (পিইসি)-এর প্রতিবেদনে।
তাদের তথ্য মতে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত এবং মেক্সিকো সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক। বেশ কয়েক বছর ধরেই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছে মেক্সিকো। এ বছর দেশটিতে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১২টি। পাকিস্তানে ৮টি, আফগানিস্তানে ৭টি, ইরাক এবং ইরানে ৫টি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফিলিপাইন্স এবং সিরিয়া চারটি করে হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়েছে। এছাড়া ব্রাজিল, কলম্বিয়া, গুয়াতেমালা, লাইবেরিয়া, সোমালিয়াতে দুটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরস্ক, সৌদি আরব, ইয়েমেন, রাশিয়া, আর্জেন্টিনা, ক্যামেরুন, ইকুয়েডর, মোজাম্বিক, প্যারাগুয়ে, সুইডেন এবং বার্বাডোসে ঘটেছে একটি করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা।
কয়েকজন সাংবাদিক সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার করেছেন। তবে বেশিরভাগ সাংবাদিকই টার্গেটে পরিণত হয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন’, এমনটাই বলেছেন, পিইসি’র জেনারেল সেক্রেটারি ব্লেইজ লেম্পেন। এসব হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে আইন অনুযায়ী বিচারের দাবি করে পিইসির অবস্থান স্পষ্ট করেছেন তিনি।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জটিলতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মোট ৫৮০ জন সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পেরুতে ৯৩ জন, ভারতে ৫৩ জন, ব্রাজিলে ৫১ জন, মেক্সিকোতে ৪২ জন, ইকুয়েডর এবং বাংলাদেশে ৪১ জন করে, ইতালিতে ৩৪ জন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ জন, পাকিস্তানে ২২ জন , তুরস্কে ১৭ জন এবং যুক্তরাজ্যে ১২ জন মারা গেছেন। ব্লেইজ লেম্পেন বলেন, মহামারি এবং সহিংসতার শিকার হয়ে এ বছর ছয়শো’রও বেশি সাংবাদিকের মৃত্যু হয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ পরিসংখ্যান।
সম্প্রতি ভারতের রাজস্থানে ঘটে যায় ভিডিও জার্নালিস্ট অভিষেক সোনি হত্যাকাণ্ড। তিনজন আততায়ী ২৭ বছর বয়সী এই তরুণকে মারাত্মক জখম করে। স্থানীয় একটি সংবাদ চ্যানেলে কাজ করতেন সোনি। ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মহিলা-সহকর্মীকে নিয়ে রাস্তার পাশের একটি খাবারের দোকানে আসেন তিনি। সেখানে আততায়ীরা ওই মহিলাকে বিরক্ত করতে শুরু করে। সোনি তাদের বাধা দিতে চান। বিতর্কের চরম পর্যায়ে আততায়ীরা তার শরীরে আঘাত করে। শেষ পর্যন্ত ২৩ ডিসেম্বর জয়পুরের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি।
গত ১৪ ডিসেম্বর তিরুবনন্তপুরম শহরে এক দুর্ঘটনায় মারা যান একজন মালায়ালাম সাংবাদিক, নাম এসভি প্রদীপ। কমিউনিস্ট শাসিত কেরল রাজ্যে ইসলামি মৌলবাদ উত্থানের বিপক্ষে ৪৩ বছর বয়সী এই সাংবাদিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। নিউজ ১৮, জয় হিন্দ, মিডিয়াওয়ান, মঙ্গলম, কৈরালি ইত্যাদি গণমাধ্যমের হয়ে তিনি কাজ করতেন।
নভেম্বরের শেষের দিকে উত্তরপ্রদেশে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। সেখানে রাকেশ সিং নির্ভীক নামক ৩৫ বছর বয়সী এক সাংবাদিক মারা যান। ২৮ নভেম্বর বলরামপুরে তাঁর বাড়িতে হঠাৎ এক বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের সময় বাড়িতে তিনি এবং তার বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। পরে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। নির্ভীকের পরিবারের দাবি, এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। স্থানীয় কয়েকজনের বিরুদ্ধে তিনি ‘রাষ্ট্রীয় স্বরূপ’-এ প্রতিবেদন ছাপিয়েছিলেন। এর জেরে তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নির্ভীক।
৪৫ বছর বয়সী অন্ধ্রপ্রদেশের সাংবাদিক জি নাগারাজ। মাসখানেক আগে তামিলনাডু সীমান্তে হনুমান্থা অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের হাতে মারা যান তিনি। ২২ নভেম্বর দিনে-দুপুরে জনসম্মুখে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তেলেগু এই সাংবাদিকের ওপর হামলা চালানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। তামিল গণমাধ্যম ভিল্লানগাম এর জন্য স্থানীয় রিয়েল-এস্টেট মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সিরিজ রিপোর্ট লিখেছিলেন নাগারাজ।
উত্তর প্রদেশের সনভদ্রা এলাকায় সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের আরও একটি ঘটনা ঘটে। গত ১৬ নভেম্বর স্থানীয় সাংবাদিক উদয় পাশ্বান এবং তার স্ত্রী মারা যান। লখনউভিত্তিক একটি হিন্দি দৈনিকে তিনি কাজ করতেন। একদল সন্ত্রাসী তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রীকে আক্রমণ করে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান পাশ্বান। পরদিন হাসপাতালে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়। এর আগে ১২ নভেম্বর সুরাজ পাণ্ডে নামে ২৫ বছর বয়সী এক তরুণ সাংবাদিকের মরদেহ পাওয়া যায় সদর কোতোয়াল এলাকার রেললাইনে। তার পরিবার উন্নাও জেলায় বাস করে। পরিবারের দাবি তাঁকে খুন করা হয়েছে।
ভূপালভিত্তিক টিভি সাংবাদিক সায়েদ আদিল ওয়াহাবকে গত ৮ নভেম্বর একটি জঙ্গলে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। ৩৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিক একটি হিন্দি নিউজ চ্যানেলে কাজ করতেন। মরদেহ পাওয়ার কয়েকদিন আগেই তিনি নিখোঁজ হন। পুলিশ তার ক্ষত-বিক্ষত দেহ উদ্ধার করে। একইদিন ২৭ বছর বয়সী তামিল টিভি সাংবাদিক ইস্রাভেল মোসেস সমাজবিরোধী একটি দল কর্তৃক কাঞ্চিপুরমে খুন হন।
৫৫ বছর বয়সী আসামের কাকোপাথার ভিত্তিক টিভি সাংবাদিক পরাগ ভূঁইয়া গত ১১ নভেম্বর রাতে রহস্যজনক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সরকার বিষয়টি তদন্তের ভার সিআইডির হাতে অর্পণ করেছে। যে গাড়িটি ওই সাংবাদিককে ধাক্কা দেয়, পুলিশ সেটি আটক করেছে। গাড়ির ড্রাইভার এবং আরও একজনকে আটক করেছে পুলিশ। গত ২৪ আগস্ট বাল্লিয়া অঞ্চলে রতন সিং নামক আরও একজন উত্তর প্রদেশের সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ৪৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিক কাজ করতেন ‘সাহারা সময়’ স্যাটেলাইট চ্যানেলে। তিনসুকিয়া ভিত্তিক একটি আসমিয়া টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক বিজেনদীপ তাঁতীকে (৩২) তার ভাড়া অফিসেই মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
জুলাইয়ের ২২ তারিখ মধ্যপ্রদেশের সাংবাদিক সুনীল তিওয়ারি মারা যান। ৩৫ বছর বয়সী এই সাংবাদিক গোয়ালিয়রভিত্তিক হিন্দি সংবাদপত্রে কাজ করতেন। নিওয়ারি অঞ্চলে তিনি মারধর এবং ছুরিকাঘাতের শিকার হন। একই দিনে উত্তর প্রদেশে ৪৫ বছর বয়সী বিক্রম যোশি নামক এক সাংবাদিক হাসপাতালে মারা যান। এর দুইদিন আগে অর্থাৎ ২০ জুলাই স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী তার ওপর হামলা করে। জুনের ২৯ তারিখে নন্দীগামা এলাকায় নিহত হন অন্ধ্র প্রদেশের সাংবাদিক গান্তা নবীন। ২৭ বছর বয়সী এই ডিজিটাল চ্যানেল সাংবাদিক নিজ এলাকায় প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
উত্তর প্রদেশের সাহসী সাংবাদিক শুভম মনি ত্রিপাঠি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তার মৃত্যুর সংবাদ মিডিয়াকে বেশ নাড়া দেয়। ২৫ বছর বয়সী এই তরুণ কানপুরভিত্তিক হিন্দি দৈনিক ‘কামপু মেইল’-এ কাজ করতেন। মৃত্যুর হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও অবৈধ বালু উত্তোলকদের বিরুদ্ধে একের পর এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন তিনি। ১৯ জুন উন্নাও অঞ্চলে দুইজন বন্দুকধারী তাকে গুলি করে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বাঙ্কি অঞ্চলে মারা যান ৪০ বছর বয়সী এক পোর্টাল সাংবাদিক। তার নাম আদিত্য কুমার রানসিং।
গত বছর ভারতে সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের ৯টি ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে মাত্র একটি ঘটনাই টার্গেট কিলিং হিসেবে সামনে আসে। এটি হচ্ছে অন্ধ্র জ্যোতির সাংবাদিক কে সত্যনারায়াণ হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ১৫ অক্টোবর নিহত হন ৪৫ বছর বয়সী সাংবাদিক। স্থানীয় সংবাদকর্মীরা বলছেন সত্যনারায়ানা টার্গেটে পরিণত হয়েছিলেন। গত বছর আরও নিহত হন, জোবানপ্রিত সিং, বিজয় গুপ্ত, রাধেশ্যাম শর্মা, আশিস ধীমান, চক্রেশ জৈন, আনন্দ নারায়ণ, নিত্যানন্দ পাণ্ডে। গাড়ির নিচে পড়ে মারা যান কেরালার সাংবাদিক কে মুহাম্মদ বশির।
ভারতের স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় সাংবাদিক সংগঠন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অধিকার সংগঠন পিইসির পাশাপাশি কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস, রিপোর্টার স্যানস/উইদাওট বর্ডারস, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে ক্ষতিগ্ৰস্ত পরিবারকে ন্যায় বিচার পাইয়ে দিতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে সংগঠনগুলো।
(লেখক নব ঠাকুরিয়া পিইসির কান্ট্রি কন্ট্রিবিউটর)