SportsBreaking NewsFeature Story
বিশ্বকাপের প্রথম গোল্ডেন গোলের পরাজিত নায়ক শিলাভার্ট
এবারের বিশ্বকাপের মাঠে ইরানের খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মাসা আমিনীর মৃত্যুর সাহসী প্রতিবাদ সারা বিশ্বের মনে জায়গা করে নিয়েছে। সমকামিতা নিয়ে আয়োজক দেশের আপত্তির বিরুদ্ধে জার্মান ফুটবলারদের মৌন প্রতিবাদ কিংবা বিধিনিষেধের কাতার বিশ্বকাপে, পুরুষদের ম্যাচে মহিলা রেফারিদের খেলা পরিচালনা, প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবের মরোক্কোর সেমিফাইনালে পৌঁছনো – সব মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই জমজমাট হয়ে উঠেছে কাতার বিশ্বকাপ ২০২২। বিদায় নিয়েছে নেইমারের ব্রাজিল, ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পর্তুগাল। সেই সময়ে বিশ্বকাপ ফুটবলের পরাজিত নায়কদের মধ্যে ২৪ বছর আগের নায়ক শিলাভার্টকে স্মরণ করলেন শাশ্বতী ভট্টাচার্য।
এক একটা বিশ্বকাপের বিশাল মঞ্চে সৃষ্টি হয় অসংখ্য ইতিহাস। মারাদোনার চোখের জল থেকে শুরু করে রবার্তো বাজ্জিওর পেনাল্টি মিস বছরের পর বছর থেকে যায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রিয় দলের জয়ে আমরা সমর্থকদের আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে দেখি। কিন্তু কখনো কখনো পরাজিত দলের জন্যেও মন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে যায়।
১৯৯৮ সালে ফ্রান্সে আয়োজিত বিশ্বকাপের একটি ম্যাচ সেভাবেই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। সেই ম্যাচের পরাজিত নায়ক ছিলেন প্যারাগুয়ের অধিনায়ক পাগলা গোলকিপার শিলাভার্ট।
২৮ জুন-১৯৯৮। তারকাখচিত আয়োজক দেশ ফ্রান্স সেবারের ফেভারিট টিম। জিনেদান জিদানের পায়ের জাদুতে মুগ্ধ বিশ্বের ফুটবল প্রেমীরা। নকআউট পর্যায়ে সেই ফ্রান্সের মুখোমুখি প্যারাগুয়ে দল। সে দলের তারকা ফুটবলার একজনই। দলের গোলকিপার তথা অধিনায়ক – জোসে বা হোসে ল্যুই চিলাভার্ত, খবরের কাগজের সুবাদে যাকে আমরা তখন শিলাভার্ট বলেই জানতাম। বিশ্বকাপের দুই বছর আগে কোয়ালিফাইং রাউন্ডে তাঁর দেওয়া একটি গোলের সুবাদে ১-১ গোলে আর্জেন্টিনাকে রুখে দিয়ে অস্বস্তিতে ফেলেছিল শিলাভার্টের প্যারাগুয়ে। আর তার পরে, কিন্তু বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগেই কোপা আমেরিকায় তাঁর দেওয়া গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই দেয় প্যারাগুয়ে। আর তখনই সকলের নজরে আসেন তিনি।
ছয় ফুট দুই ইঞ্চির ভারী চেহারার এই গোলকিপার একটু ক্ষ্যাপাটে বলেই পরিচিতি ছিলেন। সুযোগ পেলেই গোলপোস্ট ফাঁকা রেখে সেন্টার লাইন পেরিয়ে অ্যাটাক করতে চলে যেতেন তিনি। কিক প্রাকটিস করে করে দলের অন্যতম শুটারও হয়ে উঠেছিলেন তিনি। বিশ্বকাপের গোলকিপারদের মধ্যে বিশ্বের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার রেকর্ডের অধিকারী শিলাভার্ট। বিশ্বকাপের কোয়ালিফাইং রাউন্ডে মোট সাতটি গোল দিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক ফুটবলে তাঁর আটটি এবং প্রথম শ্রেণীর ফুটবলে মোট সাতষট্টিটি গোলের রেকর্ড শিলাভার্টের। গোলকিপারদের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেকর্ড।
১৯৯৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে গ্রুপ সি থেকে সাউথ আফ্রিকাকে ৩-০ গোলে, সৌদি আরবকে ৪-০ গোলে এবং ডেনমার্ককে ২-১ গোলে পরাজিত করে নকআউটে পৌঁছেছিল ফ্রান্স।
অন্যদিকে বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায়ে গ্রুপ ডি থেকে বুলগেরিয়া ও স্পেনের সঙ্গে ড্র করে, নাইজেরিয়াকে ৩-১ গোলে হারিয়ে নকআউট পর্বে সেবারের আয়োজক দেশ ফ্রান্সের মুখোমুখি হয় প্যারাগুয়ে। মনে রাখতে হবে, স্পেন ছিল সেবারের বিশ্বকাপের ডার্ক হর্স হিসেবে পরিচিত। মাদ্রিদ বয় বলে খ্যাত রাউল গঞ্জালেসের মত তারকারা ছিলেন স্পেনের দলে।
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্যারাগুয়ের হার যে অবধারিত, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না কারোরই। লিগে সৌদি আরবের সঙ্গে খেলায় লাল কার্ড দেখায় প্যারাগুয়ের ম্যাচে ছিলেন না জিনেদান জিদান। তবু ঘরের মাঠে ফ্রান্সকে হারানো যাবে এমনটা কেউই ভাবছিলেন না।
একমাত্র শিলাভার্টই বোধহয় অন্যরকম ভেবেছিলেন।
গোলপোস্টের সামনে প্রায় একা কুম্ভ হয়ে পাহাড়ের মতোই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। নব্বই মিনিট ধরে একের পর এক ফরাসী আক্রমণের সমস্ত জারিজুড়ি এসে প্যারাগুয়ের পেনাল্টি বক্সেই শেষ হয়ে যাচ্ছিল বারবার সেই এক পাগলা গোলকিপারের খেলায়। তার মধ্যেই সমস্ত দর্শকদের উৎকণ্ঠায় ফেলে মাঝে মাঝে গোল বক্স পেনাল্টি বক্স ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে লম্বা কিক নিচ্ছিলেন তিনি। নব্বই মিনিটের খেলায় তাঁর দল যেমন একটাও গোল করতে পারেনি, তেমনি তিনিও একটা বলও তাঁর গোলপোস্টের ভেতর ঢুকতে দেননি।
১৯৯২ সাল থেকে ২০০২ পর্যন্ত ফিফার নিয়ম ছিল নব্বই মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ে কোনো দল গোল করতে পারলে সঙ্গে সঙ্গেই খেলা শেষ। সেই গোলটিকে বলা হত গোল্ডেন গোল। নব্বই মিনিটের পরে পনেরো মিনিটের দুটি অর্ধে অতিরিক্ত সময় বরাদ্দ হত, কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে প্রথম গোল হলেই খেলা শেষ। এভাবে মোট ১২০ মিনিট খেলাতেও যদি কোনো ফলাফল না আসতো, তখন হত টাই ব্রেকার, পাঁচটি করে ফ্রি কিক। তার পর একটি করে।
যাই হোক, নব্বই মিনিটের পরের প্রথম পনেরো মিনিটের সময়ও পেরিয়ে গেল এভাবেই। ফরাসীদের একটার পর একটা আক্রমণ গোলপোস্টের সামনে শিলাভার্টের হাতে পায়ে বল জমা দিয়েই শেষ হতে থাকল ।
আরো পনেরো মিনিট কাটিয়ে দিতে পারলেই টাই ব্রেকার।
শিলাভার্ট জানতেন, টাই ব্রেকার শুট আউটে গোলে দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্বের যে কোনো স্ট্রাইকারকেই আটকে দিতে পারেন। ফ্রান্সেরও আশঙ্কা ছিল শিলাভার্টকে নিয়ে। দুশ্চিন্তায় স্টেডিয়ামের ফরাসীদের মুখ শুকনো। কারণ সবাই জানে টাই ব্রেকে ফরাসীদের হার অবশ্যম্ভাবী।
কিন্তু হঠাৎই, তার আগেই, শেষ হয়ে গেল খেলা ।
১১৩ মিনিটের মাথায় ড্রিবল করতে করতে প্যারাগুয়ের ডানদিকের রক্ষণ ভেঙে ঢুকে পড়লেন রবার্ট পিরেস। চৌষট্টি মিনিটের মাথায় খেলতে নামা পিরেস সহজেই দুজন ক্লান্ত ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে গিয়ে পেনাল্টি এরিয়াতে ঢুকে পরে বল ঠেলে দিলেন ডেভিড ট্রেজেগুয়ের দিকে। লাফিয়ে উঠে ডেভিড হেড করে বল বাড়িয়ে দিলেন সেন্ট্রাল ডিফেন্স পজিশন থেকে উপরে উঠে আসা লরা ব্লাকে। সঙ্গে সঙ্গে ডান পায়ের একটি সুইপে ম্যাচের একমাত্র গোলটি করলেন ব্লা ।
তখন পাড়া প্রতিবেশীশুদ্ধ একসঙ্গে বসে খেলা দেখা হত। সেই দর্শকদের সবাই ফ্রান্সের হয়ে চেঁচিয়ে গেলেও নব্বই মিনিটের পরে অতিরিক্ত পনেরো মিনিট পেরিয়ে যাবার পর কখন যেন সবাই মনে মনে শিলাভার্টের লড়াইয়ে মানসিক ভাবে সামিল হয়ে গিয়েছিল।
খেলা শেষ হবার সাত মিনিট আগে একশো তেরো মিনিটের অসম লড়াইয়ের মাথায় ফ্রান্সের লরা ব্লার গোল্ডেন গোলে ম্যাচ জিতে গেল ফ্রান্স। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ শিলাভার্ট যখন লুটিয়ে পড়লেন গোলপোস্টের ভেতরে ঘাসের উপর দুহাতে মুখ ঢেকে, টিভির সামনে ফ্রান্সের সমর্থনে খেলা দেখতে শুরু করা দর্শকরাও তখন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল জলভরা চোখে।
কয়েক মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন। ম্যাচ শেষ হয়ে গেলেও তাঁর দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়নি। যুদ্ধ শেষে এক এক করে বিধ্বস্ত সতীর্থদের টেনে তুলে জড়িয়ে ধরেন৷ মানসিক সাপোর্ট দেবার জন্যও নিজেকে শক্ত রাখতে হবে তো ! ফ্রান্সের গোলকিপার ফেবিয়েন বার্থেজও জয়ের আনন্দ দলের সঙ্গে ভাগ করেই ছুটে এলেন কঠিনতম প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে। ফ্রান্সের অন্য ফুটবলাররাও এসে হাত মিলিয়ে গেলেন। পাথরের মত মুখেই সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার শেষে মাঠ ছাড়লেন পরাজিত সেনাপতি শিলাভার্ট।
আরো সাতমিনিট কাটিয়ে দেবার পর কী হত তা নিশ্চিত ভাবে বলা সম্ভব নয়। হয়ত সেই হেরেই যেত প্যারাগুয়ে বা শিলাভার্ট। কিন্তু ফুটবলের মহাকাব্যের সেদিনের অধ্যায়ের পরাজিত নায়কই মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন হার না মানা সেই লড়াইয়ের মাধ্যমে।
ফ্রান্স এরপর কোয়ার্টার ফাইনালে ইতালি ও সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে পরাজিত করে ব্রাজিলকে ৩ – ১ গোলে হারিয়ে ঘরের মাঠে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়। এরপর গত চব্বিশ বছরে আরো ছয়টি বিশ্বকাপ আয়োজিত হয়েছে। প্রতিবারই ফ্রান্সের খেলার দিন শিলাভার্টের বিষন্ন চেহারা মনে ভাসে।
এবারের বিশ্বকাপেও দারুণ ফর্মে ফ্রান্স। নকআউট পর্বে পোলান্ডের বিরুদ্ধে এমবাপের দুর্ধর্ষ দুটো গোল ফুটবল বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে খেলবে মরক্কোর বিরুদ্ধে। হয়ত এবারেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এই একটি ম্যাচের জন্য এখনো পর্যন্ত ফ্রান্সকে সমর্থন করতে পারি না। এই বোকা আবেগের কোনো মানে হয় না জানি। তবু নিজের দেশ না খেলা সত্ত্বেও এক একটা দলকে যে ভালোবেসে সমর্থন করে যাই আমরা, বিপক্ষ দলের সমর্থকদের সঙ্গে খুনসুটির লড়াই করে যাই, সেও তো শুধুমাত্র এই আবেগের জন্যই। পেলে, মারাদোনাকে ভালোবেসেই তো আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনাকে নিজেদের দল বানিয়ে ফেলেছি। নেইমারের বা সি আর সেভেনের চোখের জলে চোখ ভিজেছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকদেরও। এই ভালোবাসার আবেগ ছাড়া ফুটবল দেখা যায় ! শিলাভার্ট ছিলেন আমাদের ১৯৯৮ সালের সেই আবেগের সেই ভালবাসার নায়ক। গোল্ডেন গোলের নিয়মে খেলা শেষ হয়ে যাওয়ায় প্যারাগুয়ের পক্ষে ওই গোল শোধ করা আর সম্ভব ছিল না। আজকের নিয়মে কিন্তু তাঁরা আরো সাত মিনিট খেলার সুযোগ পেতেন। সেটাই ছিল বিশ্বকাপের প্রথম গোল্ডেন গোল।
গোল্ডেন গোলের শুরু হয়েছিল আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলা ফিরিয়ে আনার জন্য। দশ বছরের মধ্যেই ফিফার বোধোদয় হয় যে তার ফলে আসলে খেলা আরো রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ছে। নিয়ম আবার পাল্টে পুরো অতিরিক্ত সময় খেলা চালানোর প্রথা ফিরে আসে। এখনো তাই অতিরিক্ত সময়ে পিছিয়ে পড়ে কেউ গোল শোধ করলেই ১৯৯৮ সালের সেই প্রথম গোল্ডেন গোলে থেমে যাওয়া শিলাভার্টের ছবি মনে পড়ে। শিলাভার্টের দল সেই সুযোগ পায়নি। সুযোগ পায়নি টাইব্রেকারে যাওয়ার।