Barak UpdatesAnalyticsBreaking News

দেশদ্রোহী ! বরাকবাসীর সংগ্রামের অর্জিত অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার কূটকৌশল, লিখেছেন তমালকান্তি বণিক

তমালকান্তি বণিক

৪ ডিসেম্বর : বরাক উপত্যকার সংবাদকর্মী অনির্বাণ রায়চৌধুরীর উপর ভারতীয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০(ক) অর্থাৎ দেশদ্রোহীর ধারা প্রয়োগ করে তাঁকে হয়রান করার কূট চক্রান্ত করছে সরকার। অথচ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। একে খর্ব করা যে রাজ্যে তালিবানি শাসন কায়েম করা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কয়েকদিন আগে একই কায়দায় ভাষা আইন লঙ্ঘিত হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার দায়ে অসুস্থ প্রদীপ দত্তরায়কে সাংবাদিক নিগ্রহের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে  দেশদ্রোহী আইনে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পোরা হয়েছে। শুক্রবার রাতে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলেও এখনও চলছে তাঁর বন্দিজীবন।

ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্ন জনগণের আর্থিক স্থিতির সাথে সম্পৃক্ত। আর্থিক বিপর্যয়ে আম-জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর হওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেখানে কর্মসংস্থানহীন ব্যাপক যুবাদের চাই কর্মসংস্থান এবং আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত সাধারণ জনগনের আশু দাবি নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের হ্রাস, সেখানে সরকার এসব ব্যাপারে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো মানুষের প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমিয়ে দিতে যথেচ্ছ ভাবে দেশদ্রোহী আইন প্রয়োগ করে ভাষিক-সাংস্কৃতিক চোরাগোপ্তা আগ্রাসনের পথ বেছে নিচ্ছে ।

বরাকের সরকারি ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতির নিদর্শন স্বরূপ সংশোধিত ভাষা আইন, ১৯৬১ হলো বরাকবাসীর রক্ত ঝরানো সংগ্রামের ফসল। অসমিয়া ভাষা শিক্ষা আইন, ২০২০ (গেজেট নোটিফিকেশন নং: এলজি. ৫৩.53/2024/4 )-এও সংশোধিত ভাষা আইনের মান্যতা রয়েছে । বৈষম্য মূলক বিজ্ঞাপন বরাকবাসীর সংগ্রামের অর্জিত অধিকারকে ছিনিয়ে নেওয়ার কূটকৌশল হিসাবে প্রতিভাত হয়েছে।

ইচ্ছাকৃত ভাবে বিজ্ঞাপনে ভাষা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে শাসকের ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বরাকের জনগণকে দাসত্বের বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেই বিজ্ঞাপন নেহাৎ বিজ্ঞাপন নয়, হয়ে উঠেছে আধিপত্যের প্রতীক।। প্রতিবাদের চাপে প্রশাসন ভুল সংশোধন করে সেই নির্দিষ্ট সাইনবোর্ড বদলে দিয়ে দ্বিভাষিক করেছে। সাইনবোর্ড পাল্টে দেওয়ার আচরণেই আইন লঙ্ঘনের দাবি যে ন্যায়সঙ্গত ছিল তার প্রমাণ স্পষ্ট হয় । সরকারি প্রশাসন যন্ত্র কোনও এক সংগঠনের অযৌক্তিক ও মিথ্যা এফআইআরকে কেন্দ্র করে যে ভাবে অতি-সক্রিয় হয়ে উঠল, তাতে আমরা বরাকবাসী স্তম্ভিত।

সমগ্র সাংবাদিককুল সমষ্টিগত ভাবে অস্বীকার করেছেন প্রদীপ দত্ত রায়ের প্রতি আনা সাংবাদিক নিগ্রহের অভিযোগের সত্যতা৷ তার পরেও পুলিশ রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে স্বত:প্রণোদিত মামলা রুজু করেছে৷

আবার একটি মামুলি ও ভিত্তিহীন অভিযোগকে কেন্দ্র করে আরেকজন নিষ্ঠাবান সংবাদ কর্মীর উপর দেশদ্রোহের অভিযোগ আনছে। আসলে যেহেতু সরকার নিজেও জানে যে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্কটাপন্ন ও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত মানুষ হাহাকার করছেন, সরকারের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন, তখন সরকার সব জেনেবুঝেই {IPC124(A)}, দেশদ্রোহী আইনকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে। আর সেই ধারা প্রয়োগ সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির মন্তব্য স্মরণীয়।

সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতি এন. ভি রামান্না এক বার্তায় মন্তব্য করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রাথমিক প্রমাণে (prima facie) নিশ্চিত যে সেডিশন বা দেশদ্রোহ আইন জনগণের বাকস্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করতে যথেচ্ছভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি এও বলেন, ভারতীয় প্যানেল কোডের ধারা ১২৪(ক) (সেডিশন) তার সময় অতিক্রম করেছে অর্থাৎ সেই ধারার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। স্পষ্ট উচ্চারণে তিনি বলেন যে, এটি একটি ঔপনিবেশিক আইন। অনেকের মতে, এই আইন অসাংবিধানিক। সেডিশন আইন উঠিয়ে নেওয়ার আবেদন জানিয়ে এক অবসরপ্রাপ্ত আর্মি জেনারেলের দায়ের করা মামলা সুপ্রিম কোর্ট গ্রহণ করেছে এবং ১৯৬২ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, সমালোচনা করা দেশদ্রোহ নয়। আবেদনকারী ১৯৬২ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করে এই ঔপনিবেশিক আইনের ব্যবহারে “Doctrine of chilling effect”- এর কথা উল্লেখ করেন। অর্থাৎ ভয় দেখিয়ে কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার কূট কৌশল।

যে জনগণের ভোটে জিতে আসামে সরকার গঠন করেছে বিজেপি, এখন ভয় এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সেইসব জনগণকে ভীত ও সন্ত্রস্থ করে রাখার যে ঘৃণ্য রাজনীতি করছে তার তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই। অন্যায় ভাবে দেশদ্রোহী আইনে বন্দি করে রাখা প্রদীপ দত্তরায়কে মুক্ত করার ও সংবাদকর্মী অনির্বাণ রায় চৌধুরীকে অসম্মান ও হেনস্থা করার অভিপ্রায় থেকে নিবৃত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি সরকারকে৷ কারণ মানুষের ধৈর্য সীমার পরীক্ষা করতে করতে যদি মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়!

(তমালকান্তি বণিক শিলচরের প্রাক্তন পুরপ্রধান)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker