Barak UpdatesHappeningsAnalytics
পাঁচগ্রাম কাগজ কল ও আত্মনির্ভর ভারত, লিখেছেন রাহুল রায়
। । রাহুল রায়। ।
আরও একটি মৃত্যু। এটি নিয়ে সরকারি তথ্য অনুযায়ী কাগজকলে বেতনহীন কর্মচারীর আত্মঘাতের সংখ্যা এখন ৬৭। এই সংখ্যাটি শুধুমাত্র মৃত মানুষের। যারা এখনও মরেননি, কিন্তু দারিদ্রের জ্বালায় তিলে তিলে মরছেন তাঁদের কথা এখানে বলা হয় নি। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মী হয়েও নিজেদের তথা পরিবার পরিজনের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে পারেন না। ছেলেমেয়েরা ঠিক মতো পড়াশোনা করাতে পারেন না। লকডাউনের সময় চরম নিরুপায় হয়ে অন্যের হাত থেকে ত্রাণ নিতে হয়। তাদের এই অবস্থা কেন কেউ জানে না। তবে কি শুধু এরাই আক্রান্ত? না, প্রায় লক্ষাধিক মানুষ যাঁরা কোনও না কোনওভাবেই এই কাগজকলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন।
বলতে বাধা নেই সরকারি নীতিতে গণ্ডগোলের ফলেই একরকম মৃত্যুমিছিল। দেশের বৃহত্তম কাগজকলটির লালবাতি জ্বালানো হয়েছে। কর্মচারীদের বকেয়া টাকা তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে আটকানো রয়েছে। এমনকী ভবিষ্যতনিধিতে জমানো নিজেদের টাকা পর্যন্ত সরকার তাঁদের এই অতি দুঃসময়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। তবে এই নীতির ফলে কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট দুঃখ-দুর্দশায় এই মানুষগুলোর চোখের জল শুকিয়ে গেলেও নিশ্চয়ই দেশের ভালো হবে! এই টাকা দিয়ে বোধহয় দেশের কোথাও না কোথাও আরও একটি বিরাট মূর্তি তৈরি করা হবে, নতুবা কোনও শহরের নাম পরিবর্তন করা হবে!
একদম প্রাসঙ্গিক ইস্যুই ধরা যাক। লাদাখ সীমানায় চিনের আস্ফালনের ফলে দেশজুড়ে বিদেশি বর্জনের পক্ষে বিপুল জনমত সৃষ্টি হচ্ছে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে তার আগে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখে আমরা ‘আত্মনির্ভর ভারতের’ কথা শুনেছি। আমরা জানি যে পৃথিবীতে কোনোকালেই কোনো দেশই একশ শতাংশ স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না, তবে পরনির্ভরতা যতটুকু কমানো যায় ততই দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ হয়। সেইহেতু আমরা বিদেশি বর্জনের ডাক দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তুলছি, জায়গায় জায়গায় পোস্টার লাগাচ্ছি। এটা অবশ্যই গঠনমূলক। কিন্তু সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কেন আমরা বরাক উপত্যকায় থাকা একসময়ের দেশের বৃহত্তম কাগজ কল নিয়ে চিন্তা করব না ? এখানে প্রশ্ন উঠবে, কেন আমরা একটি বন্ধ হয়ে থাকা শিল্প প্রতিষ্ঠান নিয়ে চিন্তা করব। প্রশ্নের উত্তরে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরা দরকার। দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।অফিস,স্কুল-কলেজ-বিশ্ববি
কিন্তু সমস্যা হল এই চাহিদা মেটাতে আমরা বিদেশের ওপর দিনের পর দিন আরো বেশি করে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। আমদানি–রপ্তানি বিষয়ক সরকারি তথ্য বলছে গত ৮ বছরে দেশের কাগজ আমদানি প্রায় তিনগুণ বেড়ে গেছে। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে কাগজের আমদানি ছিল ৩৪১১ কোটি টাকার। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তা দাঁড়িয়েছে ৯১৩৪ কোটি। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরেও এই বৃদ্ধির হার অব্যাহত। এখানে বলা প্রয়োজন, সেই আমদানি তালিকায় সবচেয়ে উপরের নাম চিনের। তারপর আসে আমেরিকার নাম।
ইণ্ডিয়ান পেপার মেনুফেকচারিং এসোসিয়েশন বলছে, যে দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নীতি অনুযায়ী কাগজ আমদানির ওপর কর ক্রমশ কমানো হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ , ইণ্ডিয়া-এশিয়ান ফ্রি ট্রেড ও ভারত-কোরিয়া চুক্তিতে কাগজ আমদানিকে যোগ করা হয়েছে। যার ফলে এই দেশগুলো থেকে কাগজ আমাদানি কর শূন্য রাখা হয়েছে। এমনকী চিনসহ অন্যান্য বড় দেশের ক্ষেত্রেও কর ১০ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে। সেন্টার ফোর পাল্প এণ্ড পেপার রিসার্চ ইনস্টিটিউট বলছে, দেশের ৮৬১ টি কাগজ কলের মধ্যে ৪৯৭ টি মাত্র কাজ করছে। তাও নিজেদের সামর্থের মাত্র ৮৫ শতাংশ। এখানে সুস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে যে যদি দেশিয় কাগজ কলগুলো নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে শুরু করে তাহলে কাগজ আমদানি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব। ২০১৯ সনের এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে দেশে ৮.৮৭ লক্ষ টন কাগজ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে।
বছরে ১ লক্ষ টন কাগজ উৎপাদনে সক্ষম পাঁচগ্রামের হিন্দুস্থান পেপার মিল এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারতো। সরকার কাগজ কলের মরতে বসা কর্মচারী তথা অন্যান্যদের কথা চিন্তা নাই বা করুক, কিন্তু যদি নিজের বহুল প্রচারিত ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পের কথাও গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করে তাহলেও বলা যায় পাঁচগ্রাম কাগজ কলকে পুনরাজ্জীবিত করার ব্যাপারে সরকারের জরুরি ভিত্তিতে ভাবা উচিত। আজকের দিনে দেশ ও সমাজের স্বার্থে এটা সময়ের দাবি বললেও ভুল হবে না।