Barak UpdatesHappeningsBreaking News
চিড়িয়াখানাই কি এখন বরাকের মানুষের যন্ত্রণার উপশম? প্রশ্ন তমাল বণিকের
হাফলঙে অনুষ্ঠিত রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, বরাক উপত্যকার ধলাই বিধানসভা কেন্দ্রের রজনীখাল নামক স্থানে ২১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা হবে মুক্ত পশুউদ্যান বা ‘সাফারি’। আমাদের গলার স্বর উচ্চগ্রামে চড়িয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘আহা বেশ বেশ বেশ ‘!
বলতে ইচ্ছে করছে, কারণ মুখ্যমন্ত্রী যে রঙিন চশমা পরে রাজ্য শাসন করছেন সেই চশমা দিয়ে তিনি দেখতে পারছেন, বরাক উপত্যকার গুরুতর সমস্যাগুলোর সমাধান তিনি করে নিয়েছেন। তিনি দেখতে পারছেন, বরাকে মিনি সচিবালয় ভবনের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে৷ সেই ভবনে কাজও শুরু হয়ে গেছে৷ তিনি দেখতে পারছেন, সরকারি কাজে কাউকে গুয়াহাটিতে যেতে হচ্ছে না! তিনি দেখতে পারছেন, হারাঙ্গাজাও এলাকায় আটকে থাকা শিলচর-সৌরাষ্ট্র মহাসড়কের কাজ সমাপ্ত হয়ে গিয়েছে৷ এখন বরাকের মানুষ মহাসড়ক ধরেই বাইরে যাতায়াত করেন৷ তিনি দেখতে পারছেন, বন্ধ কাগজ কল আবার চালু হয়ে গেছে এবং কাগজ কলের বিপর্যস্ত কর্মীরা তাঁদের বকেয়া টাকাও পেয়ে গেছেন৷ তিনি ওই চশমা দিয়ে এও দেখতে পারছেন, সরকারি মদতে চলা কাছাড় জেলার একমাত্র অনুষ্ঠানস্থল তথা শিল্প-সংস্কৃতি চর্চার একমাত্র স্থান জেলা গ্রন্থাগার ভবন ও গ্রন্থাগার পুনরায় চালু হয়ে গিয়েছে, স্থানীয় ভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে, শিলচর মেডিক্যাল কলেজে পূর্ণমাত্রায় হৃদরোগ (হার্ট ডিজিজ ), কিডনির সমস্যা, স্নায়ু রোগের চিকিৎসা চলছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম একেবারে সাধারণ মানুষের নাগালের ভিতরে এসে পড়েছে, বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেও সাধারণ মানুষের জীবনে বইছে খুশির হাওয়া৷ আর তাই মানুষ হাসতে হাসতে গাড়ি চড়ে মুক্ত উদ্যানে পশু-পাখি দেখে “আহা বেশ বেশ” বলে বগল বাজাবেন৷ আর মুখ্যমন্ত্রী আনন্দে আটখানা নয়, ষোলো আনা হয়ে মাথায় বালিশ বেঁধে বোম্বেগড়ের রাজার মতো ডিগবাজি খাবেন।
মুখ্যমন্ত্রী চোখ-কান বন্ধ করে রঙিন চশমা পরে বসে আছেন বলেই মানুষের দুঃখদুর্দশা দেখতে পারছেন না৷ এর পরিবর্তে তিনি দিবাস্বপ্ন দেখছেন।
বরাক উপত্যকায় সরকারের প্রস্তাবিত ‘সাফারি’ গড়ে উঠবে ধলাই বিধানসভা কেন্দ্রের যে রজনীখালে, ২০১৮ সালে সেখান থেকেই রোহিঙ্গা তকমা সেটে উচ্ছেদ করা হয়েছিল শতাধিক গরিব পরিবারকে৷ ওই অতি দুস্থ পরিবারগুলো সেই অঞ্চলে বসবাস করছিলেন ৪৫ থেকে ৫০ বৎসর ধরে৷ তাঁদের পার্মানেন্ট ইলেকট্রিক কানেকশনের বিল, রেশন কার্ড, জব কার্ড সবই ছিল। সেখানে ছিল সরকারি দুটি স্কুল ও একটি মাদ্রাসা। জমি দখলমুক্ত করার নামে বিজেপি সরকার সরকারি সম্পত্তি সহ সেইসব গরিব মানুষের ঘরবাড়ি বুলডোজার চালিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল৷ সেই মানুষগুলোর কোনও রকমের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। সরকারি সন্ত্রাসের শিকার ওই গরিব মানুষেরা কোনও সরকারী সাহায্য ছাড়াই শুধু প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে আজও লড়াই করে চলেছেন। আর রঙিন চশমা পড়া সরকার সেখানে বিনোদনের নতুন আখড়া বানাতে চাইছে!
যে সরকার তফাৎ বোঝে না বেকার ও সাকারের, ক্ষুধা ও বিনোদনের, সে সরকার আর যা-ই হোক জনগণের সরকার নয়, সে সরকারের হাতে জনগণের ভবিষ্যৎ বিপন্ন।
তাই ঘোষিত ২১৪ কোটির প্রকল্প, সেটা বরাক উপত্যকার অপ্রতুল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সু-চিকিৎসার অভাবে ধুঁকতে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস্তব পরিস্থিতিকে উপহাসের নামান্তর৷ আর সেটা যদি বাস্তবায়িত করে, তবে তার থেকে লজ্জা ও অপমানের আর কিছুই হতে পারে না। এখানকার জনপ্রতিনিধিরা যতদিন শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কথায় ঘাড় নাড়ানোর বাইরে জনগণের কথা ভাববেন না, ততদিন যাদের ভোটে জিতে তাঁরা এমএলএ, এম পি হয়েছেন সেই সব ভোটারদের ভবিষ্যৎ গভীর অন্ধকারাচ্ছন্নই থাকবে।
আজ ২১ জানুয়ারি গুচ্ছ কর্মসূচি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী শিলচর আসছেন। বর্তমান সরকারের ঘোষণা ও বয়ানবাজির অধিকাংশই যে শুধুই ধাপ্পা, সেটা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের দৌলতে সবাই বুঝে গিয়েছেন। তাই মুখ্যমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়ে বলছি মুখ্যমন্ত্রীর আসনের সম্মান রক্ষার্থে সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলুন —
১) স্থানীয় ভাবে মিনি সচিবালয়ে কাজকর্ম কবে থেকে শুরু হবে?
২) শহরের যানজট সমস্যা নিরসনের প্রয়োজনে আপনাদের নির্বাচনী ইস্তাহারে থাকা উড়ালপুল কবে তৈরি হবে?
৩) আপনাদের প্রদান করা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শহরে চার লেনের সড়ক নির্মাণ কবে হবে ?
৪)মহাসড়কের কাজ কবে শেষ হবে?
৫) শিলচর জেলা গ্রন্থাগার ভবন প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণের কাজ কবে শেষ হবে?
৬) উচ্ছেদ হওয়া অসহায় মানুষদের পুনর্বাসনের কী ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত করেছেন?
৭) শিলচর মেডিক্যাল কলেজে কবে থেকে আধুনিক মানের নিউরো, কিডনি, হার্ট ও গ্যাস্ট্রো এন্টারোলজি বিভাগ চালু করবেন?
৮) তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে কবে থেকে স্থানীয় ভাবে নিয়োগ করবেন?
৯) পাঁচগ্রাম ও জাগিরোড কাগজকল কবে খুলবে এবং কলের কর্মীদের বকেয়া টাকা কবে পাবে?
১০) কোভিড পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে পড়া গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কি? কীভাবে গ্রামের গরিব শিশু-কিশোররা শিক্ষার সঙ্গে আবারও সম্পর্ক স্থাপন করবে ? আপনার সরকার সে ক্ষেত্রে এর জন্য কী সদর্থক ভূমিকা পালন করবে ?
পেটে ক্ষুধা, শরীরে রোগ নিয়ে মানুষ বিনোদন করতে পারেন না, মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী। তাই সাফারি ইত্যাদি আষাঢ়ে গল্প না শুনিয়ে, মানুষকে জানান, তাঁদের কাজ কীভাবে দেবেন আর তাঁদের রোজগার, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নতি কীভাবে করবেন।
মুখ্যমন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে আর্জি, রাজ্যবাসীকে সত্যের জানান দিন৷
(লেখক তমালকান্তি বণিক কংগ্রেস নেতা, শিলচরের প্রাক্তন পুরপ্রধান৷)