Barak UpdatesHappeningsCultureBreaking News
খাঁচাছাড়া আত্মারামঃ আরেক ঝাঁক কলাকুশলী উপহার দিল ভাবীকাল
ওয়েটুবরাক, ১৪ অক্টোবরঃ নাটকের জন্য মুখিয়ে ওঠা শহর শিলচর কি কড়া লকডাউন, টিম ভাবীকাল সবসময় তৈরি নাট্যচর্চায়। বছরভর চলতে থাকে তাদের নাটক নিয়ে নাড়়াচাড়া। কোনও এক নাটকের সফল প্রযোজনার চেয়ে ভাবীকালের ‘স্তম্ভ’ শান্তনু পাল জোর দেন অভিনেতা তৈরিতে। তাই এখন তাদের রিহার্সাল যত না হয়, কর্মশালা হয় তার চেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর আগে ভাবীকাল যখন সংগঠন থেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে, তখন থেকেই বিষয়টি লক্ষ্যণীয়। তাই ভাবীকালের নাটক নিয়ে কথা বলতে গেলে শুধু ওই একটা মঞ্চায়ন পর্যালোচনা করেই দায়িত্ব শেষ হয় না। নাটক নির্বাচন, অভিনেতা বাছাই, সমন্বয় বা টিম ওয়ার্কে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবীকাল কতটা সফল, জড়িয়ে থাকে তাও। সাধারণত নাটকে কোনও অভিনেতা তাঁর জন্য নির্ধারিত চরিত্র গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে একে যথাযথ ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব অনেকাংশে ওই অভিনেতার ওপর বর্তায়। কিন্তু কর্মশালা থেকে নাটক তুলতে গেলে সব দায়িত্বই প্রতিষ্ঠান পরিচালক বা প্রশিক্ষকের। কুশীলবেরা নাটকের অআকখ জানেন না, বা যে মাত্রার কর্মশালা, ওই মাত্রায় পৌঁছাতে পারেননি বলেই প্রশিক্ষণের জন্য নাম লিখিয়েছেন। ফলে দর্শকদের আমন্ত্রণ করে এনে নবিশদের মঞ্চে তুলতে গেলে, নাটকটিকে বের করে আনার দায়িত্ব যতটা না কলাকুশলীদের, এর চেয়ে বেশি পরিচালক-প্রশিক্ষকের।
২০০৮ সাল থেকে এই কাজ করতে করতে ভাবীকাল নাট্যজগতে বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছে। নইলে কি আর শিলচরের প্রশিক্ষার্থীদের নাটক শেখাতে গুলসন ওলিয়া, বিজয় কুমার, পঙ্কজ সাক্সেনা, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, ব্রাত্য বসু, সেলিম আরিফ, অদ্রিজা দাশগুপ্ত, অবিনাশ দেশপান্ডে, সেঁজুতি বাগচী, বিজয় দলভি, মনোজ শইকিয়ার মতো ব্যক্তিত্ব রাজি হয়ে যান! ইতালির জিয়ানি ব্রুসছিকেও অনলাইনে প্রশিক্ষক হিসেবে পাওয়া যায়!
গত দেড় দশকে প্রশিক্ষণ পর্বে কতই না পরিবর্তন এসেছে! প্রায় সব পর্বেই শান্তনুবাবুরা অংশ নিয়েছেন। ওই অভিজ্ঞতা থেকে লকডাউনের দিনগুলিকেও ভালোভাবে কাজে লাগাতে চালু করেন অনলাইন প্রশিক্ষণ। আবার সবকিছু প্রায় স্বাভাবিক হতেই অফলাইনে ফিরে যেতে সময় নেননি। এ বার নাট্য প্রশিক্ষণের পাশাপাশি চলে প্রযোজনার প্রস্তুতি। গত ৯ অক্টোবর শিলচর সঙ্গীত বিদ্যালয়ের ‘কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ও মুকুন্দদাস ভট্টাচার্য স্মৃতিমঞ্চে’ অভিনীত হল ‘খাঁচাছাড়া আত্মারাম’। এটি সংস্কৃত নাটক ‘ভগবদজ্জুকাম’ অবলম্বনে রচিত। মূল নাট্যকার বোধ্যায়ন। বাংলায় ভাবানুবাদ করেছেন শান্তনু পাল।
শক্তিশালী টিমওয়ার্ক, সফল মঞ্চায়ন, সুন্দর মেক-আপ। স্ক্রিপ্টে নাট্যশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ ইত্যাদিকে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এর পরও শান্তনুবাবুকে স্ক্রিপ্ট নিয়ে আরও কিছু ভাবতে হবে। মূল নাটকটি থেকে একটু বেরিয়ে একে কীভাবে আরও সময়োপযোগী করা যায়, তা দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে, বিদূষকের (শুভময় চন্দের কথা নয়) চরিত্রকে আরেকটু গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। শান্ডল্য (স্বাগতম রায়) ও যমদূত (বিনায়ক পাল) চরিত্র যেমন স্ত্রিপ্টে, তেমনি মঞ্চায়নে সফল। অন্য চরিত্রের মাধ্যমেও হাস্যরসকে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা, ভেবে দেখতে হবে। যেহেতু এটি ক্লাসিক ও প্রহসন নাটক, তাই প্রাচীন ও সমকালের মধ্যে সেতু তৈরি করা যেতে পারে। সখীদের সঙ্গে বসন্তসেনার খেলা, ফুল তোলা ও সাজগোজের সময়ে ভিন্ন আবহ তৈরির কথা ভাবতে হবে। এই জায়গায় আরও নাট্যমুহুর্ত চাই। একইভাবে আরও কয়েকটি নাট্যমুহুর্ত তৈরির অবকাশ রয়েছে, সেগুলিকে কাজে লাগালে ভালো হয়।
এই নাটকের পরবর্তী মঞ্চায়ন যেহেতু আর কর্মশালার পরীক্ষা থাকছে না, তাই রিহার্সালে সময় দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, কর্মশালার পরীক্ষা বলে ‘খাঁচাছাড়া আত্মারাম’ কোনওক্রমে দাঁড় করানো হয়েছে, এ কথা মোটেও বলা যাবে না। একইদিনে দুটি শো তারা করেছেন। সন্ধ্যায় ভাবীকালের সদস্য ও আমন্ত্রিত শুভাকাঙ্ক্ষীদের সামনে অভিনীত হয়েছে। এর আগে দুপুরে একেবারেই চার সাংবাদিককে নাটকটা দেখান তাঁরা। দুইবারই প্রায় প্রত্যেকে স্ক্রিপ্ট ও নির্দেশনা মেনে নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ছোট মঞ্চ, পাখা নেই, অতি মাত্রার গরম, কোনওকিছুকেই পরোয়া করেননি। তাই কোথাও নাটকটি বাধাপ্রাপ্ত হয়নি।
এবারের কর্মশালা ও মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকজন সম্ভাবনাময় কলাকুশলীকে পাওয়া গিয়েছে। ফলে ভাবীকালের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। তাদের নাট্য-লালনে ভাবীকালকেই অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে হবে। ‘সূত্রধার’ সৌম্য দাস, ‘বৈদ্য’ পল্লব ভট্টাচার্য ও ‘গুরু’ নেহাল ভট্টাচার্য আগে দুয়েকটি নাটকে অংশ নিয়েছেন, বাকিরা কেউ মঞ্চে নাটক করেননি। সেই জায়গা থেকে দেখলে খুব কম সময়ে ভাবীকালের টিমওয়ার্কের উচ্চপ্রশংসাই করতে হয়। বলা যায়, ভাবীকাল তাঁর বৈশিষ্ট্য অনুসারেই আরেক ঝাঁক অভিনেতা-অভিনেত্রী উপহার দিল।
কর্মশালা ভিত্তিক নাটকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে বিশেষ উল্লেখের অবকাশ নেই। তবু দুই-একজনের কথা আলাদা ভাবে বলতে হয়। যেমন চারুদত্তের চরিত্রে অনুপম সিনহা যে বাঙালি নন, তা নাটক দেখে বোঝার উপায় ছিল না। মনে হচ্ছিল, কে বলেন তিনি অনুপম, তিনি তো চারুদত্তই। বসন্তসেনা (বিপাশা চক্রবর্তী)-কেও মঞ্চে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ দেখা গিয়েছে। চারুদত্তের সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলতে কোনও জড়তা ছিল না। এই দুই চরিত্র বাছাইয়েও ভাবীকাল মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছে। বিপাশা সহ স্বর্ণালী দাস, সঙ্গীতা সিনহা, কল্পনা পাল, পিয়ালী সিনহা, শর্মিষ্ঠা দে ও মুক্তশ্রী সিনহার নৃত্যশৈলী নাটকটিকে উপভোগ্য করে তুলেছে। দুই সখী দীপশিখা চন্দ ও শুকতারা সংকল্পা যোগ্য সঙ্গই দিয়েছেন। মা কাবেরী রায়ও ভাল। প্রপসে উদ্ভাস দাস, সুপ্রিয়া সিনহা এবং সৌভিক পুরকায়স্থও এই ১০ সেপ্টেম্বর-৯ অক্টোবর কর্মশালার ফসল। সফল টিম ম্যানেজার আল-বাব রাজা চৌধুরী ও মিডিয়া কো-অর্ডিনেটর সুব্রত রায়।
উল্লেখ করতে হয় নির্দেশক গুলিস্তা আলিজার কথা। একজন হিন্দিভাষী হয়ে তিনি যে ভাবে একটা বাংলা নাটককে একমাসের প্রশিক্ষার্থীদের দিয়ে সম্পূর্ণ তুলে দিয়েছেন, তা অবশ্যই বিশেষ কৃতিত্বের দাবি রাখে। তাঁর সঙ্গে থেকে সহকারী নির্দেশনা ও আবহসঙ্গীত পরিচালনা করায় সায়ন্তনী পালের কাছে প্রত্যাশা বেড়ে গেল।