Barak UpdatesHappeningsBreaking News
কলকাতায় বরাকবঙ্গের ভাষা শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠান
ওয়েটুবরাক, ২৩ মেঃ রক্তস্নাত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসামের বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার যে অধিকার অর্জিত হয়েছিল তাকে খর্ব করার জন্য নানা কৌশলে অবিরত চেষ্টা এখনও চলছে । শুধু ভাষাই নয় , নাগরিকত্বের প্রশ্নেও নিশানা রাজ্যের বাঙালি । বিভিন্নভাবে বিপন্ন এই জনগোষ্ঠী তার আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য লড়ে যাচ্ছে। অথচ জাতীয় স্তরে এই সংগ্রামের কথা তেমনভাবে প্রচারের আলোয় আসছে না । ভাষা শহিদ দিবস উদযাপন উপলক্ষে কলকাতার নন্দন চত্বরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চারুকলা পর্ষদ পরিচালিত অবনীন্দ্র সভাগৃহে বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কলকাতা অধ্যায় আয়োজিত বৌদ্ধিক জমায়েতে বিভিন্ন বক্তা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বিশিষ্ট কবি মনোতোষ চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৌদ্ধিক জমায়েতে বিশিষ্ট অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরাক মূলের দুই প্রবীণ ব্যক্তিত্ব গল্পকার অরিজিৎ চৌধুরী ও লেখক সাংবাদিক বাহার উদ্দিন। কার্যক্রমে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস চর্চা, তার বর্তমান অবস্থা এবং সংগ্রামের আবেগ থেকে ওঠে আসা অনুভব কথা, গান ও আবৃত্তিতে তুলে ধরেন বিভিন্ন বয়সের ভাষাপ্রেমীরা।
শ্যামাপদ ভট্টাচার্যের লেখা ‘ ডাকে ঐ একাদশ শহিদেরা ভাই, আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয় ‘ জয়িতা নন্দী মজুমদারের এই উদ্বোধনী সংগীতের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
আলোচনার সূত্রপাত করেন অরিজিৎ চৌধুরী। তাঁর কথায় ভাষা সংগ্রামের সেই কালপর্বের পুরো ইতিহাস ওঠে আসে। তিনি বলেন, তখন মহকুমা শহর করিমগঞ্জ ছিল মাতৃভাষা রক্ষা আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। দলমত নির্বিশেষে সবার যোগদানের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব সংগ্রামী চেতনার জন্ম হয়েছিল। অরিজিৎবাবু বলেন, উনিশের আত্মত্যাগের পরে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। কিন্তু তার পরেও দশকে দশকে বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলছে। সাম্প্রতিক কালের এনআরসি প্রক্রিয়ার সময়ে বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয়েছেন। অনেক মিডিয়া প্রচার করে থাকে ১৯ মের আন্দোলন নাকি উদ্বাস্তুদের আন্দোলন। এর চেয়ে বড় অপপ্রচার আর কী হতে পারে। কলকাতার নামিদামি পত্রিকায় ভ্রান্ত বিষয় পরিবেশন করা হয়।
আরেক অতিথি আরম্ভ পত্রিকার সম্পাদক বাহার উদ্দিন তাঁর ভাষণে বাঙালির আত্মপরিচয় সংক্রান্ত সংশয় সংকট নিরসনে ধর্ম পরিচয়ের ঊর্দ্ধে ওঠে বাঙালি জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার ডাক দেন। তিনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অভিবাসী মুসলমানদের ভাষা পরিবর্তনের ঐতিহাসিক সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেন। এতকিছুর পরও এদের বেঁচে থাকার অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়নি। এরাই সবচেয়ে নির্যাতিত হয়েছেন। বাহার উদ্দিন বাঙালির ভাষা সংকট ও ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস লেখার কাজ অবিলম্বে শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন।
বরাকের ভাষা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতকে মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য ২০০৮ সালে উনিশে মে নামে একটি বাৎসরিক ম্যাগাজিন ছাপা হয়ে আসছে। এদিনের সভায় শান্তনু গঙ্গারিডি সম্পাদিত উনিশে মে পত্রিকা ২০২৩ (গল্প সংখ্যা) আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশ করা হয়। নরওয়ের রাজধানী অসলোতে বসে বাংলা ভাষা চর্চা করছেন কবি নির্মল ব্রহ্মচারী। অনুষ্ঠানে তাঁর লেখা ছড়া ও কবিতার বই প্রকাশ করা হয়।
পরে আলোচনায় অংশ নিয়ে গল্পকার মলয়কান্তি দে, কবি সম্পাদক বিভা বসু, কথাসাহিত্যিক শ্যামল ভট্টাচার্য, সাধন চন্দ্র প্রমুখ উনিশের ঘটনাবলির তাৎপর্য ও অভিঘাত নিয়ে বক্তব্য রাখেন। উনিশের দিনের প্রত্যক্ষদর্শী নীলিমা গঙ্গোপাধ্যায়ের লিখিত ভাষণে সেই সময়টির পটচিত্র তুলে ধরা হয়।
সুজাতা চৌধুরী, মধুমিতা গঙ্গোপাধ্যায়, প্রজ্ঞা নাথদের গান শ্রোতাদের মুগ্ধ করে।
দূরদর্শন কলকাতার আধিকারিক অনুপ সেন আশির দশকে বরাকের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করে বলেন, ১৯৬১র আন্দোলনের খবর কলকাতার প্রতিটি দৈনিকে ছাপা হয়েছিল। কিন্তু এখন আর হয় না। পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই এই কাহিনি ভুলে গেছেন। তাই আমাদের আবার মাঠে ময়দানে নামতে হচ্ছে। তিনি দুটো কবিতা পাঠ করেন।
রথীন কর, সৌমিত বসু, সাকিল আহমেদ, তন্ময় বীর, সত্যপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়, নীহার ধর, চন্দন বিশ্বাস, সুশান্ত ভট্টাচার্য প্রমুখ কবিতা পাঠ করেন।আবৃত্তিতে ছিলেন সুজাতা চৌধুরী, রুম্পা দে, শিঞ্জিনি সৌহার্দ্য। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজাতা চৌধুরী।
অবনীন্দ্র সভাগৃহ উপচে পড়া এই অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুলাল মিত্র, প্রবুদ্ধ মিত্র, আজমল হোসেন, শিবানী ভট্টাচার্য, তপন রায়বর্মন, চন্দন চট্টোপাধ্যায়, প্রশান্ত গাঙ্গুলি, পার্থ প্রতিম সেন সহ আরও অনেকে।