Barak UpdatesAnalyticsFeature Story

করোনাতঙ্ক: উত্তরণের পথ খোঁজাই হোক আমাদের চিন্তা-চেতনা, লিখেছেন দেবযানী চৌধুরী

দেবযানী চৌধুরী

১2 এপ্রিল: মোবাইলে একটা অচেনা নম্বরের রিং, রিসিভ করতেই ইথার তরঙ্গে আমার বাড়ির ঠিকে কাজের বউটির গলার আওয়াজ,
‘দিদি, আমার এক ভাইয়ের মোবাইল থেকে ফোন করছি, হাতে টাকা নেই, ঘর চলছে না। কিছু টাকা লাগবে, কাল দিতে পারবে’?
বললাম, ‘লকডাউনের মধ্যে আসতে পারবি তো? পারিস যদি তো এসে নিয়ে যা।’
বললো, ‘আসব’।
এল না পরদিন। দুদিন পর এল, বললো, ‘আমাদের রাস্তার সামনে পুলিশ থাকে, কাউকে রাস্তায় চলতে দেয় না। আজকে অনেক ঝামেলা পেরিয়ে আসতে পারলাম’।

লকডাউনের সপ্তাহ খানেক আগেই আমি ওকে কাজ থেকে ছুটি দিয়েছিলাম, বলেছিলাম, ‘পারলে অন্য বাড়িগুলো থেকে ক’দিন ছুটি নে। তোর দুটি ছোট বাচ্চা আছে। এখন ঘরে থাকাই ভাল।’ মুখে ওর ব্যাপারে উদ্বেগ দেখালেও নিজের পরিবারকে নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত ছিলাম আমি। ওরা দিনে চার-পাঁচ বাড়ি কাজ করে। কতো রাস্তাঘাট পেরোয় রোজ, কত মানুষের সংস্পর্শে আছে। আমার ঘরে ঢোকার পর যদিও ওকে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত-পা ধোয়াতাম, তবু স্বস্তি মিলছিল না। বাইরের কাউকে ঘরে প্রবেশাধিকার দিতে চাইছিলাম না আমি। তাই ওকে ছুটি দিলাম।

Pic Credit:FB Post of Partha Seal

সাতদিন পেরোতে না পেরোতেই চিত্র বদলে গেল। লকডাউন হয়ে গেল দেশজুড়ে। ওর যেহেতু নিজস্ব কোনও ফোন নম্বর নেই, তাই যোগসূত্র হারিয়ে গেল। কখনও কখনও ভাবছিলাম ওকে নিয়ে। কি জানি কীভাবে পিতৃহীন দুটো বাচ্চার মুখে দুবেলা দুটো ভাত তুলে দিচ্ছে ? রেশন কার্ড নেই, জনধন অ্যাকাউন্টও নেই ওর। সরকারি কোনও সাহায্য পাচ্ছে কি না কে জানে। যেদিন ওকে ছুটি দিয়েছিলাম, সেদিন ওর হাতে এক হাজার টাকা তুলে দিয়ে বলেছিলাম, ‘চিন্তা করিস না, তোর বেতন কাটব না’। আসার পর বলল, ‘তোমার দেওয়া টাকা থেকে এক বস্তা চাল, কিছু ডাল আর তেল কিনেছিলাম, তাই রক্ষা। নয়তো এ ক’দিন তিনবেলা ভাত জুটতো না’ —‘ কেন রে সরকার থেকে তো ফ্রি রেশন দিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে। অনেক সংস্থা থেকে চাল, ডাল খাবার এসব দিচ্ছে, তুই পাস নি এসব’? উত্তরে বলল, ‘পেয়েছি দুদিন, তিন চার কেজি চাল, ডাল, আলু, সোয়াবিন, তেল। আমাদের ওখানে কয়েকজন মানুষ গিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ পরিমাণ চাল ডালে কি চলে গো এতজনের দুবেলা খাওয়া? পঞ্চায়েত থেকে আমার নাম নিয়ে গেল, কিন্তু কোন রেশন বা টাকা পাইনি। আমার মা’র রেশন কার্ড আছে। মা ওরা চাল পায়নি, বদলে এক হাজার টাকা পেয়েছে। আমি পাইনি। ওরা বলেছে টাকা শেষ হয়ে গেছে, আবার যদি টাকা আসে তো দেবে।’

বিষয়টা ভাল করে বুঝলাম না। কেন ওর মা রেশনের চাল পেলো না? শুধু টাকা পেলো? আর সেই বা কেন সরকারি টাকা বা ফ্রি রেশন পেলো না? কেন টাকা শেষ হয়ে গেল? যেখানে সরকারি ঘোষণায় বলা হয়েছে, যাদের রেশন কার্ড নেই, ব্যাংকের বই নেই, তারাও পাবে টাকা। ওকে বললাম, ‘আজই বাড়ি গিয়ে তোর পঞ্চায়েতের মেম্বারের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস কর, সরকার তো সবাইকে টাকা, রেশন দেবে, তুই কেন পেলি না ?’ আস্তে আস্তে বলল, ‘ওরা সুযোগ পেলেই টাকা মারে, এখনও কি সুযোগ ছাড়বে?’ সত্যতা কি জানা নেই, তাই কিছু বলার ছিল না। ওকে আরও কিছু টাকা দিয়ে বললাম –‘এখন এটা দিয়ে চালিয়ে নে কয়েকদিন, প্র‍য়োজন হলে আবার দেবো, লকডাউন খুললে আসিস। ‘

এরপরও সে যা যা বলেছিল সেদিন, তার সারার্থ এটাই ছিল, সব বাড়ির মানুষ তো সমান নয়। এক দুই বাড়ির মানুষ ওর বেতন হয়তো কাটবে না, কিন্তু এরমধ্যে কেউ গত মাসের পুরো টাকাই দেয়নি। লকডাউনের ছুটির টাকা কি সবাই দেবে? ওর বাবা অসুস্থ,শয্যাশায়ী। দুই ভাই আজ এখানে, কাল ওখানে মিস্ত্রির কাজ করে, মা বাড়ি বাড়ি কাজ করে। লকডাউনে ভাইদের কাজ বন্ধ। ওর মা হয়তো বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে কিছু টাকা পেয়ে যাবে, সদাশয় যারা তারা হয়তো বেতন কাটবে না? ভাইরা তো কাজ না করলে টাকা পাবে না? স্ট্রোকের রোগী বাবার ওষুধের জন্যও টাকা দরকার। যদি লকডাউন বাড়ে, তাহলে কিভাবে কি হবে? আর যদি লকডাউন কিছুটা খুলেও তবু অবস্থা স্বাভাবিক হতে কতদিন যাবে কে জানে? ওর ভাইরা কি সঙ্গে সঙ্গে আবার কাজ পেয়ে যাবে? এমুহূর্তে এর উত্তর জানা নেই আমার।

লকডাউন হওয়ার চার পাঁচদিন পর আমার পুরনো এক কাজের মেয়ে এসে হাজির হলো। সে আমার ঘরে দিনরাত থেকে কাজ করতো। বিয়ের পর সে আর কাজ করে না, বর করতে দেয় না, মদ খায় আর সন্দেহ করে ওকে। মাঝে মাঝেই সে আমার বাড়িতে আসে। আমার আর আমার বরের পুরনো কাপড় জামা দিয়ে ওদের চলে। ওর বর রাস্তায় দোকান দিয়ে বড়া, ঘুঘনি এসব বিক্রি করে। ঝুপড়ি ঘর একটা ভাড়া করে থাকে দুজনে। এসে বললো, গত মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। এ মাসেরটাও দিতে পারেনি। এরমধ্যে বরের দোকান বন্ধ। বাড়িওয়ালা বলেছে ভাড়ার টাকা মিটিয়ে দিতে, নয়তো ওরাই বা চলবে কি করে? হাতে যা টাকা ছিল, সে টাকা বাড়ি ভাড়া দিয়েছে, তাও বকেয়া রয়েছে ভাড়া। দিন আনে দিন খায় ওরা। তাই ঘরে মজুত তেমন চাল, ডাল ছিল না। যা ছিল, তা দিয়ে তিন চারদিন চলেছে, এখন খাবে কী?

কারা কবে ফ্রি চাল ডাল দেবে এর আশায় বসে থাকবে নাকি? এরমধ্যে ভাড়া বাড়িতে থাকলে ভাড়ার টাকা যোগ হয়ে যাবে? লকডাউন খুললে কোথা থেকে ভাড়ার টাকাই বা জোগাড় করবে? কোথা থেকেই বা জুটবে দুবেলা খাবারের টাকা? করোনা আতঙ্কে মানুষ এখন বাইরের খাবার খেতে ভয় পায়, তাই লকডাউন খুললেই যে দোকানে বিক্রি বাট্টা হবে, তার কি ঠিক আছে? হয়তো ওর বরকে তখন নতুন কোনও কাজের সন্ধান করতে হবে। তাও জিনিসপত্র বাড়ি মালিকের কাছে গচ্ছা রেখে চলে গেছে ওর বোনের ঘরে, ওখানে নাকি ওর শ্বাশুড়িও থাকেন। সে এসেছে আমার এখানে আশ্র‍য়ের জন্য। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অব্দি থাকবে, বর কিছু ব্যবস্থা করতে পারলে ওকে এসে নিয়ে যাবে। এরপর থেকে এখনও সে আমার ঘরে আছে।

সেদিন ভোরবেলা ডোরবেল বাজল। দরজা খুলতেই অবাক। সামনে দাঁড়িয়ে এক মাছওয়ালা। বাজারে সে আর ওর ছেলে মাছ বিক্রি করে। হাতে একটি ব্যাগ। বললো, ‘ভাবী, লকেল মাছ আছে, দাদাকে ডাকো। লকডাউনে বাজার বন্ধ, তাই নিয়ে এলাম ঘরে।’ বরকে ডাকলাম। মাঝবয়েসি মুসলিম এই মাছওয়ালা আক্ষেপের সুরে যা বললো, এতে এতটুকুই বুঝলাম, ছেলে আর বাবা মিলে বাজারে মাছ বিক্রি করে। লকডাউনে বাজার বন্ধ। এত বড় সংসার। একটু আধটু মাছ জোগাড় তো করতে পারে, কিন্তু বিক্রি করবে কি করে? বাজারে মাছ নিয়ে বসলে, পুলিশ এসে ফেলে দেয়, রাস্তায় বিক্রি করলেও একই অবস্থা। এরমধ্যে এখন তো হিন্দুরা অনেকে মুসলিমদের কাছ থেকে মাছ কিনতে ভয় পায়। শুধু হিন্দুরা কেন, স্ট্যান্ডার্ড অনেক মুসলিমরাও নাকি ওদের কাছ থেকে মাছ-সব্জি কিনতে চায় না। কারন কি জানতে চাইলে বললো, জামাতের অনেকে ফিরে এসে প্রথমে নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিল। যেহেতু এরা সবাই মুসলিম , আর করোনা চেনে ছড়ায়, হয়তবা কোনওভাবে যদি জামাতের কেউ এদের লিঙ্কে এসে থাকে, তাহলে যে রোগ ছড়ানোর ভয় আছে।

বলল, ‘ভাবী, হিন্দুরা তো সন্দেহের চোখে দেখছেই। আমাদের মুসলিম বাবু বিবিরাও অনেকে ভয় পাচ্ছেন মুসলিম সব্জিওয়ালা- মাছওয়ালার কাছ থেকে জিনিস কিনতে। সবাই সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখছে।’ এরজন্য সব জায়গায় মাছ নিয়ে যেতেও পারে না। আর গেলেও কিনছে না। কবে যে সব স্বাভাবিক হবে ভেবে উৎকণ্ঠায় মাছওয়ালা। জবাব ছিল না আমার কাছে। সেদিন আর দাম-দর না করে অনেকটা বেশি দামেই মাছ কিনলাম।

—-আমি- আপনি সবার মনেই এখন একই জিজ্ঞাসা লকডাউন কি বাড়বে? বাড়লে কী হবে? এভাবে কতদিন চলবে? কবে স্বাভাবিক হবে পরিস্থিতি? ওদের মতো সাধারণ যারা, তারা ওত দেশের রাজনীতি – অর্থনীতি বুঝে না। শুধু বেঁচে থাকার লড়াইটা বুঝে । করোনা থেকে বাঁচতে সামাজিক দূরত্ব বাড়াতে সরকার লকডাউন করেছে, সেটা জরুরি- সেটা ওরা বুঝলেও এই লকডাউন এদের জীবনকে অনেকটা ওলটপালট করে দিয়েছে। ওরা হয়তো সরকারি- বেসরকারি কিছুটা সাহায্য পাচ্ছে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্তদের অবস্থা আরও সঙ্কটে। অফিসের পাশের পান দোকানি, বাজারের রাস্তায় ছোট হোটেল, ফুটপাতে চপ্পল – জুতো কিংবা কাপড়ের পসরা নিয়ে বসা দোকানিরা আজ অনিশ্চিত আশংকায়। ব্যাঙ্গালোর- মুম্বাই- চেন্নাই -চন্ডীগড় ফেরত সিকিউরিটি গার্ড ইত্যাদি কাজ করা যারা বাড়ি ফিরেছেন করোনা আতংকে, তাদেরও হয়তো আর জুটবে না ওখানে চাকরি। করোনা এদের সবার জীবনপথকে আজ অনিশ্চয়তার পথে নিয়ে গেছে।

—-করোনা দেশকে একতার পথে পথচলা দেখিয়েছে। মানুষের পাশে দাঁড়ানো শিখিয়েছে। স্বচ্ছতার পাঠ দিয়েছে। নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শিখিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ দিয়েছে। বিপরীতে সেই করোনা বুঝিয়েছে, একুশ শতকের মানুষ বিজ্ঞান- প্রযুক্তির সফলতার শীর্ষ সোপানে দাঁড়িয়েও সামান্য একটা ভাইরাসের কাছে কতটা অসহায়। সভ্যতা বেঁচে না থাকলে মিলিয়ন ডলার অর্থের যারা মালিক, সেই অর্থেরও কোন দাপটও অসার, করোনা সেটা অনুভব করিয়েছে। করোনা দেখিয়েছে মন্দির – মসজিদ- গির্জা- গুরুদুয়ারায় শুধু ঈশ্বর আবদ্ধ নন। তারপরও সেই ধর্মের বিদ্বেষবিষটা ছড়িয়ে দিল।

—মানুষ বেঁচে থাকলে সভ্যতা বাঁচবে, আর সভ্যতা বেঁচে থাকলে তবেই বাঁচবে ধর্ম। করোনা শিখিয়েছে – সবার উপরে মানুষ সত্য। করোনাকে ঘিরে লকডাউন, আর এই লকডাউনকে ঘিরে মানুষের অনিশ্চিত আশংকা, অনিশ্চিত জীবন। তাই এমুহূর্তে ধর্ম নয়, প্রয়োজন মানুষকে নিয়ে ভাবার। করোনাতঙ্ক কবে কাটবে? লকডাউন কবে উঠবে ? কীভাবে কাটবে মানুষের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তার আশংকা? জীবনের পুরনো ছন্দে ফিরবে কবে – কীভাবে মানুষ? এখন এটাই হোক আমাদের চিন্তা-চেতনা। উত্তরনের পথ খোঁজাই হোক আমাদের ভাবনা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker