India & World UpdatesHappeningsAnalyticsBreaking News

এশিয়ায় সরকারগুলোর উপর সেনা নিয়ন্ত্রণ জোরদার করবে করোনাভাইরাস, লিখেছেন সুবীর ভৌমিক

Subir Bhowmik
এশিয়ার অনেক দেশে সামরিক শাসন প্রত্যাবর্তন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সময় সম্ভবত এখনো আসেনি। কিন্তু বাকি দুনিয়ার মতো এশিয়াও করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় হিমশিম খেতে থাকায় মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড বা ফিলিপাইনের মতো দেশের সেনাবাহিনী ভাইরাসটির বিস্তার ঠেকাতে আরো কিছু করার দাবি জানাতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কোভিড সামাল দিতে সেনাবাহিনীকে তলব করায় এবং পাকিস্তানে সরকারি কার্যক্রমে সামরিক বাহিনী নেতৃত্ব দেওয়ায় স্পষ্ট হচ্ছে যে এশিয়ার অনেক দেশে সামরিক বাহিনীর প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়বে।

এসব দেশে দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব, দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও জনসাধারণের উচ্চ মাত্রার অবিশ্বাস সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব প্রকাশে সহায়ক হয়। এসব কারণে গত তিন দশক ধরে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রূপান্তরের কাজ বিলম্বিত হয়েছে বা রুদ্ধ হয়েছে।

কোভিড-১৯ সামাল দেওয়ার মাত্র কয়েক মাসের লড়াইতেই সরাসরি সামরিক শাসন বা বারবার সামরিক হস্তক্ষেপপূর্ণ এসব দেশ মহামারীটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতে সামরিক বাহিনীর কাছেই ফিরে গেছে।

তবে আরো বিপজ্জনক প্রবণতা স্পষ্ট। গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর স্থলাভিষিক্ত হতে যাওয়া বিপুল কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার প্রশ্নে কোনো ধরনের আপস ছাড়াই বিকেন্দ্রীকরণের কিছু পদক্ষেপকে অনুমোদনকারী সামরিক জান্তাগুলো নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাওয়ার মুখে পড়েছে৷ ভাইরাসে আক্রান্ত সম্প্রদায়গুলো স্থানীয়ভাবে থাকা প্রতিকার ও সুরক্ষা পরিকল্পনাগুলোকে অবলম্বন করার দিকে যাচ্ছে।

এতে করে এসব সরকার সম্প্রদায়গুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার লাভের প্রয়াসে বিকেন্দ্রীকরণ গুটিয়ে আনতে প্রলুব্ধ হতে পারে। এর একটি বিশেষ কারণ হলো, এসব দেশের বেশির ভাগেরই উপনিবেশ-পরবর্তী জাতি-রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ জ্ঞাপনকারী বিবদমান জাতিগোষ্ঠীর মোকাবিলা করার ইতিহাস রয়েছে।

আর সামরিক-পরবর্তী কিছু সরকার একই ধরনের নির্যাতনকারী ও কর্তৃত্ববাদী এবং এর ফলে বৈধতার অভাবে আরো বেশি সামরিক নিয়ন্ত্রণ ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।

বাংলাদেশের উদাহরণই দেওয়া যাক। শেখ হাসিনার সরকারের শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী ঐতিহ্য রয়েছে এই কারণে যে তার দল (যা তার বাবা মুজিবুর রহমানেরও), ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধে জাতির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে।

২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুলভাবে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে এসে হাসিনা অর্থনীতির পরিভাষায় বাংলাদেশের সোনালি দশকে নেতৃত্ব দেন। দেশটি এখন তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে এশিয়ার অন্যতম বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। হাসিনা বাজারমুখী সংস্কার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি (যা প্রতিবেশী ভারত বা মায়ানমারে দেখা যায় না) ধরে রাখার কাজে নেতৃত্ব দিয়ে কৃতিত্বের অধিকারী।

কিন্তু রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ হোঁচট খেয়েছে, এর গণতন্ত্রের মারাত্মক পতন ঘটেছে। তিনি সামরিক বাহিনীকে সবসময় খোশমেজাজে রেখেছেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের ভূমিকা অনেকাংশে বাড়িয়েছেন, যার ফলে অফিসার ও সৈনিকেরা আর্থিকভাবে পুরস্কৃত হচ্ছেন, তাদেরকে ঢাকার হাতিরঝিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক নির্মাণ প্রকল্পগুলো দিচ্ছেন, পাকিস্তানি মডেলে তাদের ব্যবসায়িক পরিধি সম্প্রসারণ করছেন। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হাসিনার কোভিড দমনে সেনাবাহিনীকে তলব করার মধ্যে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ তিনি বিচক্ষণভাবে তার প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকার কারণে যথেচ্ছ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি একসময়ের এই অঞ্চলের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক সংগঠনটিকে মারাত্মক রকমের দুর্বল করে ফেলেছে।

জেনারেলরা বিচক্ষণ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বদান জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুগুলোর বাইরেও তাদের প্রভাব বাড়বেই।

পাকিস্তানে কোভিড বিশাল সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। ফলে ভাইরাসটি দমনে ব্যাপক সামরিক ভূমিকা ছিল অনিবার্য। ভুট্টোদের পিপিপি বা শরিফের মুসলিম লীগের মতো প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দলের তৃণমূল পর্যায়ের ভিত্তি নেই। ফলে সর্ব শক্তিমান সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল হওয়াটা অনিবার্য ছিল।

ভারতের অবস্থাও খুব ভালো নয়। মহামারী দমনে ভারতীয় সেনাবাহিনী জোরালো সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। তবে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় পর্যায়েই রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্রের হাতেই রয়েছে নেতৃত্ব। আর যদিও প্রধানমন্ত্রী মোদি করোনার ব্যাপারে সাড়া দিতে দেরি করেছিলেন এবং তাড়াহুড়া করে লকডাউন করার ফলে দেশের গরিবদের জন্য ভয়াবহ দুর্দশা সৃষ্টি করেছেন, তার অপ্রয়োজনীয় নাটুকেপনা অদ্ভুত ঠেকেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি, দিল্লির অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে কেরালার কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী পি বিজায়ন ও মহারাষ্ট্রের উদ্ধব ঠাকরে মহামারীটি মোকাবিলায় দৃশ্যমান নেতার ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছেন। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মূলত নেতৃত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসাকর্মী ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র।

ভারতের বিপরীত ইন্দোনেশিয়া। মোদির মতো প্রেসিডেন্ট জোকো ইউদোদো কোভিড-১৯ প্রতিরোধে জোরালোভাবে সাড়া দিতে দেরি করেছিলেন। কারণ তার ভয় ছিল চলাচলের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হবে। তারপর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে উইদোদো সাবেক বিশেষ বাহিনীর প্রধানকে সরকারের টাস্ক ফোর্সের প্রধান পদে নিয়োগ করেন। অথচ লে. জেনারেল দোনি মনোরডোকে আরো আগেই দেশের জাতীয় দুর্যোগ সংস্থার প্রধান করেছিলেন। এই দুই তারকা জেনারেলের সাথে সামরিক বাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা প্রেসিডেন্টের ইনার সার্কেলের অন্যান্য সদস্যদের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

জাকার্তার সামরিক কমান্ডার মেজর জেনারেল ইকো মারজিয়োনোকে রাজধানীতে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। রাজধানীতে সংক্রমণ মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। কয়েক ডজন চিকিৎসকও মারা গেছেন। দুর্বল, বিবদমান বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ঘাটতি মেটানোর জন্য উইদোদা প্রায়ই সামরিক বাহিনীর ওপর নির্ভর করেন। তাছাড়া দেশের কিছু সমস্যা তার অভিজ্ঞতা ও সামর্থের বাইরে।

ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনীর তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছার সক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাসঙ্গিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হতে পারে। কারণ অনেক স্থানীয় গভর্নর, মেয়র ও সম্প্রদায় নেতা ভাইরাসটি মোকাবিলায় নিজ নিজ লকডাউন আরোপ করতে শুরু করেছেন।

ফিলিপাইনে ম্যানিলা ও লুজন এলাকার লকডাউন বাস্তবায়ন করছে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ। ফিলিপাইনের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল গিলবার্ট আই গ্যাপে ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকারি পরিষেবার কিছু অংশ বিকল হয়ে যাবে মনে করে ফিলিপাইনের সেনাবাহিনী তার প্রধান দায়িত্বের বাইরেও কিছু কাজ করার পরিকল্পনা করছে।

অনেকে মনে করছে যে ফিলিপাইনের বর্তমান পরিস্থিতি কার্যত সামরিক শাসনের মতোই। তবে প্রেসিডেন্টের অফিস অনেকবার বলেছে, কোয়ারেন্টিন মানে সামরিক আইন জারির পথ নয়। কিন্তু তবুও দেশটির অনেকে দ্বিধায় রয়েছেন যখন প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুদার্তে বলেন যে তিনি লকডাউন লঙ্ঘনকারী লোককে গুলি করতে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন।

থাইল্যান্ড ২০১৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বিরতিহীনভাবে সামরিক শাসন দেখে আসছে। গত বছরের নির্বাচনে পার্লামেন্টারি সরকার আংশিকভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেও ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া জেনারেল প্রিয়ুথ চানওচা এখনো প্রধানমন্ত্রী আছেন। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে তার ভূমিকার বিপুল সমালোচনা হয়েছে। তবে প্রাথমিক ব্যর্থতা আড়াল করার জন্য তিনি এখন জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সঙ্কট মোকাবিলায় যে প্যানেল গঠন করা হয়েছে, তাদের চিকিৎসাগত কোনোই অভিজ্ঞতা নেই, প্রায় সবাই সামরিক কর্মকর্তা।

মায়ানমারের কাহিনীও একই ধরনের। দেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ক্ষমতাসীন এনডিএলের প্রয়াস সম্প্রতি সামরিক বাহিনী ভণ্ডুল করে দিয়েছে। তিক্ত পার্লামেন্টারি যুদ্ধে উর্দিধারী আইনপ্রণেতারা আইন পরিষদে বেশ কিছু প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে আং সান সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক নেতৃত্বাধীন সরকারের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরিয়ে দিয়েছে। মার্চের শেষ দিকে কোভিড-১৯ হুমকি টের পেয়ে যে ইমার্জেন্সি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, তাকে প্রধানত সামরিক কর্মকর্তারাই আছেন।

আর এর রেশ ধরে মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর হয়েছে। এতে করে মায়ানমারের নানা সঙ্ঘাত এলাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সম্ভাব্য সমালোচনা প্রতিরোধ করতে মিডিয়ার ওপর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করতে সহায়ক হবে। শত শত ওয়েবসাইট ও মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে, মিডিয়া কোম্পানিগুলো গুটিয়ে দেয়া হয়েছে ‘ভুয়া খবর’ প্রচার করার জন্য। সঙ্ঘাত-জর্জরিত রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তার প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে।

এশিয়াজুড়ে একসময় অথর্ব ও নৃশং স শাসনের জন্য অনেক বছর ধরে নিন্দিত শক্তিশালী সামরিক বাহিনীগুলো ক্ষমতা দখলে তাদের থাবা বিস্তার করার মতো অবস্থায় ফিরে আসছে। তারা আবার রাজা হবে না, তবে নিশ্চিতভাবেই হবে কিংমেকার এবং সরকারের নিয়ন্ত্রক। ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দরকার একটি শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা, যা দীর্ঘ দিন সামরিক শাসনে থাকা দেশগুলোতে কেবল সেনাবাহিনীই যোগান দিতে সক্ষম। আর ক্ষমতায় থাকতে দীর্ঘ দিনের অভ্যস্ততা ও গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনে বিরক্ত হওয়া উর্দিধারী লোকজন সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাইবে না।

সুবীর ভৌমিক  বিবিসির সাবেক সংবাদদাতা এবং প্রখ্যাত লেখক )

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker