Barak UpdatesHappeningsBreaking News
আলোর দিশারী ‘বর্ণমালার রোদ্দুর’, লিখেছেন দীপক সেনগুপ্ত
//দীপক সেনগুপ্ত//
‘বর্ণমালার রোদ্দুর’ ১৮ বছরের সাবালকত্ব অর্জন করেছে। আঠারো মানে কবি সুকান্তের কবিতার ‘আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়/ পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,/ এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়/ আঠারো বছর বয়স জানে না কাদা।“ ‘ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি’র বার্ষিক মুখপত্র প্রত্যেক বছর উনিশে মে সকালে স্টেশন চত্বরে নির্মিত মঞ্চে উন্মোচিত হয়। ট্যাবলয়েড আকারের এই মুখপত্র একদিকে যেমন একাদশ ভাষা শহিদের আত্মবলিদানকে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে অন্যদিকে ইস্তেহারের ভাষ্য রচনা করে। শুধুমাত্র স্মৃতিচারণের সৌজন্য বিলাসিতায় নয় সংগ্রামী ভবিষ্যতের ইস্তেহারের রক্তিম ভাষ্যের সৌন্দর্যে বিকশিত এই ট্যাবলয়েড পত্রিকা। শিলচর রেল স্টেশনকে ‘ভাষা শহিদ স্টেশন’ করার দাবিকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রকাশিত ‘বর্ণমালার রোদ্দুর’এর ঝলমলে উজ্জ্বল আলো নষ্ট রাজনীতির গাঢ়তর অন্ধকারে পথ না হারিয়ে এগিয়ে চলেছে। আঠারো বছরের চলার পথে কতশত ঝড় উঠেছে তবুও ‘বর্ণমালার রোদ্দুর’কে কোনও কালো মেঘ ঢেকে দিতে পারেনি।
যৌথ নেতৃত্বের কৃতিত্বকে মেনে নিয়েও রাজীব করের সক্রিয় উদ্যোগকে বিশেষ প্রশংসা করতেই হয়। ২০০৮ সালের গণ অভিবর্তন থেকে শুরু করে শিলচর স্টেশনের নাম বদলের সংগ্রামী কর্মসূচি প্রতিস্রোতে পিছিয়ে যায়নি বা চোরাস্রোতে তলিয়ে যায়নি । এগিয়ে যাওয়ার গতি মন্থর হয়েছে বটে তবে থেমে যায়নি। ‘ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি’র সহযোদ্ধা অনেক সংগঠন পেছন থেকে চলে গেলেও মূল কমিটি কিন্তু সংগ্রামের পথ ছাড়েনি। একাদশের আত্মবলিদান কোনও সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। মেহোরোত্রা কমিটির প্রতিবেদন সরকারি অনুমোদন পায়নি এই প্রেক্ষিতে যদি স্টেশনের নাম বদল করে ভাষা শহিদ স্টেশন করা যেত তবে এক ঢিলে অনেকগুলো কাজ হত। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কোনও দলের সরকার এই দাবির প্রতি সহমর্মিতা দেখায়নি। ইউ পি এ সরকার যখন ভাষা আন্দোলনে ‘আঞ্চলিক দেশপ্রেমের’ ভূত দেখে তখন এন ডি এ সরকার ডিমাসা শহিদের নামকে সামনে এনে ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে খাটো করে দেখাতে চেষ্টা করে। আসলে যে দলের সরকারই হোক না কেন উগ্র প্রাদেশিকতাবাদ এবং একমাত্রিক জাতীয়তাবাদের যাঁতাকলে বরাকের নায্য দাবি ভূলুণ্ঠিত। শুধু নাচ গানের বিনোদনের আনন্দে উদযাপিত শহিদ দিবসের অনুষ্ঠানের বিপ্রতীপে বৌদ্ধিক সংগ্রামকে শান দিতেই ‘বর্ণমালার রোদ্দুর’-এর প্রয়োজন।
আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে একাদশ শহিদের রঙিন ছবিতে প্রচ্ছদ সাজিয়ে সংস্কৃত, ডিমাসা, অসমিয়া, মার, চাকমা, হিন্দি, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, নেপালি, খাসিয়া এবং তেলেগু ভাষায় মাকে সম্বোধন করে বহুত্ববাদী সংস্কৃতির প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করা হল আবার অসহিষ্ণু উগ্র প্রাদেশিকতাকেও খারিজ করা হল। সভাপতি বাবুল হোড় মহাশয়ের লিখিত বয়ানে পাই সংগ্রামী আহ্বান । ‘ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি’ যে শুধু মাত্র শহিদ স্মৃতি তর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজনই শুধু করে না সভাপতির বয়ানে জানতে পারি৷ কোভিড মোকাবিলায় এই সংগঠন মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে ২৫০০০ টাকা এবং পুরসভার সাফাই কর্মীদের ১০০০টি মাস্ক দান করেছিল। তাছাড়া শহিদ বীরেন্দ্র সুত্রধরের ভগ্নপ্রায় আবাসটি সংস্কার করে ‘শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধর স্মৃতি নিকেতন’ তৈরি করে দেয়। কোভিডের দুঃসময়ে সর্বমোট প্রতিদিন ৮০ জন মানুষের মুখে ভাত তুলে দেওয়া সহ পানীয় জল, স্যানিটেশন প্যাড, বাচ্চাদের দুধ বিতরণের দায়িত্ব নিয়েছিল। লাগাতার ৬৯ দিন এই কর্মসূচিকে টেনে নিয়ে যেতে কতটা মানসিক শক্তি, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন তা আন্দাজ করা খুব সহজ কাজ নয়।
সম্পাদকের কলমে ডা. রাজীব কর জনপ্রতিনিধিদের কাজে উষ্মা প্রকাশ করে লিখেছেন রাজ্য সরকারের কূটচালে কীভাবে রেল স্টেশনের নাম বদলের সংগ্রামকে পেছন থেকে ভেস্তে দেওয়া হল। কবি ও প্রাবন্ধিক বরাক উপত্যকার জাগ্রত বিবেক তপোধীর ভট্টাচার্যের লেখায় পাই সেই আন্তরিক আকুতি ‘প্রতিদিন কেন উনিশে মে হয় না, প্রতিদিন কেন বলি কৃষ্ণচূড়া ফোটে না প্রতিটি অন্তরে যারা মাতৃভাষা বাংলায় নিঃশ্বাস নেয় হাসে কাঁদে স্বপ্ন দেখে’।
‘বাংলা ভাষা আন্দোলনের রোজনামচা-১৯৬১’ শিরোনামে পাই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। সাধারণ মানুষের ইতিহাস জানা বা পড়ার বিষয়ে যে অনীহা কাজ করে সে কথা মাথায় রেখে তৈরি এই লেখায় আছে ২৩ এপ্রিল ১৯৬১ থেকে ৩১ জুলাই ১৯৬১ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের উল্লেখ। ঋষিণ মিত্রের লেখাকে এখানে তুলে ধরে সম্পাদক রাজীব কর তাঁর ঋণ শোধের চেষ্টা করেছেন। ঋষিণ মিত্র আর ইহলোকে নেই, তিনিই প্রথম ব্যক্তি অবিভক্ত কাছাড়ের ভাষা আন্দোলন নিয়ে উৎসাহ দেখান এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন । বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে অনেকেই এই দিনটিকে স্মরণ করেন যেমন নীতিশ বিশ্বাস, ইমানুল হক প্রমুখ । উনিশের কথাকে পশ্চিমবঙ্গের সারস্বত মহলে জনপ্রিয় করে গেছেন ঋষিণ মিত্র মহাশয়।
শিক্ষাবিদ লেখিকা সুমিত্রা দত্ত কোনও রাখঢাক না রেখেই উষ্মা ঝেড়ে দিয়েছেন জনপ্রতিনিদের উপর। তিনি শুধু দায়িত্বহীনের মত অন্যের কাঁধে দোষ চাপিয়ে শেষ করেননি, আত্মবিশ্লেষণও করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন ‘কেন আমরা জনপ্রতিনিধিদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি না?’
আমার ( দীপক সেনগুপ্তের) লেখায় রাজনৈতিক বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছি এবং আমি মনে করি যে শুধুমাত্র গান, নাচ, কবিতায় নয়, শহিদ স্মরণ সার্থক হোক সঠিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণে, অন্যথায় ভাবের ঘরে চুরি হবে। একই প্রশ্ন তুলেছেন লেখিকা ও কবি মহুয়া চৌধুরী ‘ মাতৃভাষার প্রতি আমাদের আবেগ এবং ভালোবাসা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে? ১৯শে মে ১৯৬১ সালের অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত সময়েও লেখিকা বিজয়া দেব মনে করেন, ভাষা আন্দোলন এক নিরন্তর বহমান সত্য যেখানে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশ্রণ ঘটে অহরহ। অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এবং নেতাজি গবেষক নীহার রঞ্জন পালের লেখায় উঠে এসেছে ‘শহিদ বীরেন্দ্র সূত্রধর স্মৃতি নিকেতন’ নির্মাণের সবিস্তার কাহিনী । মহুয়া চৌধুরী, নীলদীপ চক্রবর্তী, অঞ্জু এন্দো, শর্মিলী দেব কানুনগো, বিজয় কুমার ভট্টাচার্য, দেবেশ ঠাকুর, দেবাশিস চন্দ, দিলীপকান্তি লস্কর, সত্যজিৎ বসু (জয়), সুমনা রায়, দেবাশিস সায়ন, কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী ও শতদল আচার্যের কবিতায় ‘বর্ণমালা রোদ্দুর’ আলোয় আলোকিত । বরাক উপত্যকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম যেন এই রোদ্দুর থেকে প্রাণশক্তি খুঁজে পায় যেন এই রোদ্দুরের তীব্র আলোয় বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্বাপদেরা প্রাণ ত্যাগ করে। ইতিহাসের পথ চলায় এই আলো হোক দিশারী।