Barak UpdatesHappeningsBreaking News
শিক্ষক দিবসে তাঁরাও যে ছাত্র!
ওয়েটুবরাক, ৫ সেপ্টেম্বর: শিক্ষক দিবস বললেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠেন ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ৷ তিনিই চেয়েছিলেন, তাঁর জন্মদিন পালনের পরিবর্তে এই দিনটিকে দেশবাসী সমস্ত শিক্ষকের দিন হিসাবে পালন করুক৷ আর তাই এমন দিনে আমাদের মনে পড়ে প্রিয় শিক্ষকদের কথা৷ কিন্তু শিক্ষকরা কী ভাবেন শিক্ষক দিবসে? এ নিয়েই বরাক উপত্যকার চার বিশিষ্ট শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টিম ওয়েটুবরাক৷ এরও নেতৃত্বে ছিলেন দুই শিক্ষক৷ সাক্ষাৎকার গ্রহণ, লেআউট সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আমন্ত্রিত প্রতিনিধি’ রাধামাধব কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রধান সুদর্শন গুপ্ত এবং মহর্ষি বিদ্যামন্দিরের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষিকা শতাক্ষী ভট্টাচার্য৷
আমার মা শিক্ষক ছিলেন। প্রায় ৩৯ বছর শিক্ষকতা করেছেন লামডিংয়ের ন্যাশনাল হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। ১৯৫৯-১৯৯৮ এই ছিল কার্যকাল। মাকে আমি নিজেও শিক্ষকের ভূমিকায় স্কুলে পেয়েছি যখন চতুর্থ থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছি। তখন হাইস্কুলের সীমানা ছিল পঞ্চম শ্রেণি থেকেই। আমার জন্য প্রথম যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল সেটা হল মা’কে ক্লাসে কী বলে ডাকব। সেটা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সমস্যা। সমাধান কী, সেটা জানি না। তখন ‘মিস’ সম্বোধন ছিল না। শিক্ষিকাদের ‘দিদিমণি’ ও মাস্টার মশাইদের ‘স্যার’ সম্বোধন করা হতো। তো এবার আমি কী করব! মা’কে দিদিমণি কীভাবে ডাকি, আবার স্কুলে মা-ই বা ডাকি কেমন করে। সেটা ছিল একটা জটিল সমস্যা। সেই সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে আসেনি। এমনকী মা-ও না।
আজকের দিনেও যদি কেউ আমার কাছে বলেন, কী করা উচিত, আমি সঠিক উত্তর দিতে পারব না। ফলে, সকলের চিনু দিদিমণি (চিন্ময়ী বিশ্বাস) ক্লাসে এলেই আমার অস্বস্তি হতো। এদিকে মা শিক্ষক হিসেবে প্রশাসনিকভাবে খুব কঠোর ছিলেন। শিক্ষক সত্তাটাই বেশি ছিল তাঁর। এমনকি শ্রেণিকক্ষের বাইরেও মা কম, শিক্ষক বেশি ছিলেন। ফলে স্কুলে কিছু ভুল হলে ভয় থাকতো শিক্ষকরূপী মা কী শাস্তি দেবেন৷ আর বাড়িতে কিছু সমস্যা হলে মনে হতো মায়ের রূপে একজন শিক্ষিকা কী করবেন। যদিও দুই ভূমিকায়ই প্রচণ্ড স্নেহপ্রবণ ছিলেন, কিন্তু তার মধ্যেও ছিল একটা কঠোরতা। কখনও কখনও মাকে অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘অনধিকার প্রবেশ’ গল্পের জয়কালী দেবী মনে হতো। বাইরে যতটা কাঠিন্যের বর্ম ছিল, ভেতরটা ততটাই নরম ছিল। আমার চোখে দেখা মা দিয়ে নয়, এরকম একজন জনপ্রিয় ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা শিক্ষিকা পাওয়া ভার।
১৯৫৯ সালে তৎকালীন সময়ে করিমগঞ্জের কায়স্থগ্রামের মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে লামডিঙে গিয়ে শিক্ষকতা করা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। ওই সময় রেলশহরে মা একা গিয়েছিলেন। ওখানে আমার এক মামা থাকতেন। প্রায় চারদশক শিক্ষকতা করেছেন। কীভাবে একজন স্কুলশিক্ষক হয়ে গোটা সমাজে শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা ও সম্মান পাওয়া যায়, তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত ছিলেন আমার মা। এই তো গত ২৬ আগস্ট আমার মা মারা গেছেন, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার ২২ বছর পর। কিন্তু মায়ের মৃত্যু ঘিরে এই রেলশহরে আজও জীবিত সহকর্মী, পরিচিত মহল সহ তাঁর ছাত্রছাত্রীর মধ্যে যে শোকের আবহ দেখলাম, হয়তো মায়ের মতো শিক্ষাগুরু হলে তবেই এমন শ্রদ্ধার্ঘ্য পাওয়া সম্ভব।
এখন যে প্রসঙ্গ আসে, সেটা হল আমার আদর্শ শিক্ষক কে? ঠিক জানি না, আদর্শ শিক্ষকের কী কী গুণ থাকা উচিত। তবে আদর্শ শিক্ষক হতে গেলে স্বাভাবিকভাবে কিছু গুণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, নিয়মানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তিতা— এ সব নিয়ে প্রচণ্ড সচেতন থাকতে হবে। এদিক থেকে গর্ব করে বলতে পারি, মা ছিলেন অসাধারণ। ৩৯ বছর চাকরি করেছেন। কোনও দিন দেরি করে ক্লাসে যাননি। সবচেয়ে বড় কথা, ৩৯ বছরই ক্লাসটিচার ছিলেন মা। স্বাভাবিকভাবেই প্রথম পিরিয়ড নিতে হতো। ফলে দেরি করার জায়গাও ছিল না তাঁর। ক্লাশটিচার থাকতে মা নিজেও খুব পছন্দ করতেন। অনেকে দুবছর ক্লাসটিচার থাকার পর ভাবেন, এবারে না হলে ভাল, একটু দেরিতে যাওয়া যাবে। কিন্তু মা এমন সুবিধা কোনওদিন চাননি। বরং সবসময় বলতেন, “ক্লাসটিচার না হলে কাজ করে আরাম নেই।” অদ্ভুত একটা যুক্তি ছিল মায়ের। তাছাড়া, ছুটি প্রায় নিতেন না। নিজেকে পড়ুয়াদের কাছ থেকে যেন আলাদা করতেই চাইতেন না। একটা স্নেহময় ভাবনা কাজ করত তাঁর মধ্যে।
আমাদের স্কুলে একটা ‘দুস্থ তহবিল’ ছিল। সব ছাত্রদের এতে বাধ্যতামূলক অনুদান দিতে হতো। গরিবদের বাছাই করে সাহায্য করা হতো। মা বরাবরই ওই তহবিলের সম্পাদক ছিলেন। সবার বিশ্বাস ছিল, মা সঠিক দুস্থ পড়ুয়াকে ঠিক বাছাই করতে পারবেন। কারণ তিনি স্কুলের একহাজারটি ছাত্রছাত্রীর প্রত্যেককে বাবা-ঠাকুর্দার নাম সহ চিনতেন। কাজেই মিথ্যা আবেদন করে তার কাছে পার পাওয়া যেত না। যেখানে দরিদ্রতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে অর্থনীতিবিদদরা বরাবরই সমস্যায় থাকেন, সেখানে মায়ের দক্ষতা ও বিচার-বিবেচনার ওপরে এমন বিশ্বাস সত্যিই আমার কাছে গর্বের।
আরেকটা বিষয়৷ একজন গৃহবধূ, মা হিসেবে মহিলাদের অনেক ঝামেলা থাকে ঘরে। আর আমাদের মতো অতি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে তো এসব একটু বেশিই। এরকম থাকলে সাধারণত বাড়ির ঝামেলা বলে স্কুলে দেরি করে যান বা ছুটি নিয়ে থাকেন অনেকে। কিন্তু এক্ষেত্রেও মা ছিলেন ব্যতিক্রম। কোনওদিন ঘরের বাহানা দিয়ে ছুটি কাটাননি। বা স্কুলে বাড়ির ঝামেলা, সমস্যা এসব কিছু বুঝতে দেননি। এটাই ছিল তাঁর নিজস্বতা। আমি জানি না, এসব গুণ থাকলে আদর্শ শিক্ষক হওয়া যায় কি না৷ তবে মা’কে গোটা সমাজ খুব কদর করতো, নিশ্চয়ই তাঁর মধ্যে এমন গুণ ছিল। তাই তো দুই দশকের বেশি সময় ধরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কর্মভূমির অনেকে এই মানুষটার ভালবাসার অভাববোধ করছেন।
এখন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে অনেক শিক্ষক প্রতিবছর পুরস্কার পান। তাঁদের কী গুণের জন্য এই সম্মান দেওয়া হয় জানি না। না জেনেই বলছি, আমার মনে হয়, একজন আদর্শ শিক্ষক হতে গেলে আগে ছেলেমেয়েদের ভালবাসতে লাগে। এ ক্ষেত্রে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোনও পার্থক্য হতে পারে না। শিক্ষক-পড়ুয়ার মধ্যে যদি আন্তরিকতা ও ভালবাসার সম্পর্ক না থাকে, তাহলে একজন বিদ্যের জাহাজ কি না, বা কে কতটুকু বই পড়েছেন সবই মিথ্যে। এটা আমার অভিমত। শিক্ষক ভাল মানুষ না হলে, ভাল ছাত্র তৈরি করতে পারবেন না। যত বড় চিকিৎসক হোন না কেন, ভাল মানুষ যদি না হন, রোগীকে যদি আপন করতে না পারেন তাহলে মনে হয় রোগীর কাজে আসবেন না। এটা খুব জরুরি। এসব কথাকে যদি সঠিক বলে মেনে নিই, তাহলে আমার মা সত্যিই আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মতো কাউকে এভাবে মানুষকে ভালোবাসতে দেখিনি। একই সঙ্গে পড়ুয়াদের কীভাবে পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলা যায়, এদিকেও খুব দক্ষ ছিলেন মা। যা ভালবাসার সঙ্গে নিতান্তই দরকারী। এককথায়, এফেক্টিভ শিক্ষক ছিলেন মা। আমার জীবনে বানান, অঙ্ক, চিত্রাঙ্কন থেকে শুরু করে প্রতিটি মুহূর্তের আদর্শ শিক্ষক ছিলেন মা-ই।
মায়ের মৃত্যুর পর শুভদা মানে শুভপ্রসাদ নন্দীমজুমদার হোয়াটস অ্যাপে লিখেছিল, ‘মাসিমা তো শুধু তোর মা-ই ছিলেন না। মায়েরও বেশি ছিলেন।’ ওই বেশি অংশটুকুই ছিলেন একজন শিক্ষিকা। আমার এখনও দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে, আমার ওপর মায়ের কোন সত্তাটা প্রবল ছিল, মা না শিক্ষক। তিনি মারা গেছেন ২৬ আগস্ট। আর দেখুন কি সমাপতন, মায়ের শ্রাদ্ধের দিনই কিন্তু শিক্ষক দিবস। তবে সমস্যা তো মেটেনি, মা’কে কী ডাকবো, মা না দিদিমণি। এই প্রশ্ন তো থেকেই গেল!
প্রথমেই আমার শিক্ষকদের শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমি জীবনের যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, তার ভিত শিক্ষকরাই তৈরি করে দিয়েছেন। তাঁরাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন, ভালভাবে চল, সৎ ভাবনা রেখো, জীবনে সমস্যার মোকাবিলা করো। প্রতিকূলতা তো আসবেই, সমাধানেরও পথ রয়েছে। ধর্য রেখে এগিয়ে যাও। একদিনের জন্য যাঁর কাছে শিক্ষা পেয়েছি, তিনিও আমার জীবনে সমান গুরুত্ব রাখেন।
আমি যখন কাছাড় হাইস্কুলে পড়ি, তখন তারাপদ ভট্টাচার্য স্যারকে পেয়েছি। তিনি একদিন লাইব্রেরিতে নিয়ে গেলেন। বললেন চল সোনার খনি দেখিয়ে দিই। দেখলাম কতশত বই। পরামর্শ দিলেন বই পড়ার। বইও দিয়েছিলেন।তখন তো ততটা বুঝিনি। পরে বুঝতে পেরেছি পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান আহরণের মধ্যেই অসীম আনন্দ লুকিয়ে আছে। তিনি যদি এই পথ না দেখাতেন, হয়তো বইয়ের মর্ম বুঝতাম না। তাছাড়া, আরেকটা ব্যাপার তখন ছিল শিক্ষকরা বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। বাড়িতে চলে আসতেন খোঁজ-খবর নিতে। ঠিকভাবে পড়াশোনা চলছে কি না। ফলে পড়ুয়াদের তাগিদ তো থাকতোই, সচেতন থাকতেন অভিভাবকরাও। স্কুলের বাইরেও ছাত্রছাত্রীর মেধার বিকাশের জন্য পরিশ্রম করেছেন আমাদের শিক্ষকরা। বিনিময়ে পারিশ্রমিক পর্যন্ত নেননি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই ছেলেমেয়েরা যাতে উপযুক্ত শিক্ষা পেয়ে সঠিক মানুষ হতে পারে। এতে তাদের কোনও স্বার্থ জড়িত ছিল না। যা আজকের দিনে ভাবনার বাইরে।
শিক্ষক তো অনেকেই আছেন আমার । তবে আরও বদুজন শিক্ষক প্রসঙ্গে অনুভব ভাগ করে নিতে চাই। প্রথমত, দীনেশ দত্ত স্যার। তিনি যখন পড়াতে আসতেন তখন বুঝে নিতেন আজ ছাত্র ছাত্রীদের মুড কেমন। আগ্রহের জায়গাটা কম দেখলে কৌতুক করতেন। সবাই যখন হাসিখুশি হয়ে যেত তখন ক্লাস নিতেন।এর মানে পড়ুয়াদের পড়াশোনায় আগ্রহ বাড়াতেও ভূমিকা থাকা দরকার একজন শিক্ষকের। আরেকজন কেশব চক্রবর্তী। আমার শিক্ষক ছিলেন। কাছাড় কলেজে যখন আমি শিক্ষকতায় যোগ দিলাম, কেশব স্যার তখন অধ্যক্ষ। তখন যুবক ছিলাম
আর সিনেমা দেখার একটা ঝোঁক প্রবল ছিল। যেহেতু আমার রাতে ক্লাস ছিল, ভাল সিনেমা মিস হয়ে যেতো। তাই মাঝে-মধ্যে অসুবিধে বলে ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যেতাম। কোনও না কোনওভাবে কেশব স্যারের কানে বিষয়টি যায়। তিনি একদিন আমাকে ডেকে পাঠান। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেন, ‘দেখো ছুটি তোমার প্রাপ্য,এটা তুমি নিতেই পার। কিন্তু ছুটি নিয়ে যদি এভাবে সিনেমা দেখতে যাও, তাহলে তোমার সম্পর্কে পড়ুয়াদের মধ্যে একটা খারাপ বার্তা যাবে। তোমার ইমেজ নষ্ট হবে তোমারই ছাত্রছাত্রীর মাঝে। ফলে নিজেকে সংযত কর।’
হ্যাঁ, আজকে আবারও বলতে পারি সেই ভাল-মন্দের শিক্ষা যদি পেতাম না, তাহলে হয়তো আজকের দিনে এই প্রতিষ্ঠা আমার জীবনে আসত না। পেতাম না পড়ুয়াদের অফুরান ভালবাসা। এটাই তো আমার মতো শিক্ষকদের আনন্দে থাকার খোরাক। তবে, সবকিছুর কৃতিত্ব তো সেই আমার শিক্ষকদেরই।
শিক্ষক দিবস আসলেই আমার মনে পড়ে যায় ছোটবেলার দু-একটি ঘটনা। আমার মনে পড়ে প্রাথমিক স্কুলের কথা। আমার একজন শিক্ষককে নিয়ে জীবনের কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। যা আমাকে অনুপ্রেরণা জোগায় প্রতিনিয়ত। শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাভাবের জায়গাটা যেন গভীর থেকে গভীরতর হয়। ভাবুক করে তোলে আমাকে। এই শিক্ষকের কথা আমি সারা জীবন বলে গেছি। যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনও বিভিন্ন আলোচনায় তাঁর প্রসঙ্গে কিছু বললে এক তৃপ্তি অনুভব করতাম। তাই আজও বলছি।
একজন শিক্ষক ছিলেন আমার পাঠশালা জীবনের। ঠাকুরবাড়ির আবু ঠাকুর বলে সবাই চিনতেন তাঁকে। আমরা বাড়ির পাশেই থাকতেন। তাঁর সম্পর্কে দুটি ঘটনা ভাগ করছি । তখন বাংলাদেশের ৭১-এর যুদ্ধ চলছিল। প্রায়ই একটা আতঙ্ক থাকতো সবার মনে। তবে, আবু ঠাকুর গুরুজির বেশি চিন্তা ছিল তাঁর খুদে ছাত্রছাত্রীর জন্য। গুলির আওয়াজ শুনলেই সবাইকে আগলে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়তেন। যেভাবে একজন মা তাঁর শিশুকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন, ঠিক সেই মন- মানসিকতা ছিল আবু ঠাকুর গুরুজির। তখন আমি খুব ছোট, কিন্তু স্মৃতিতে রাখার মতো বয়স ছিল। সেদিনের ঘটনা ভাবলে আজও গা শিহরণ দিয়ে ওঠে। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি আমি। মাঠে ছিলাম। হঠাৎ করে গুলির আওয়াজ। আবু ঠাকুর গুরুজি প্রাণপণে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আবার একটু পর পর আমার দিকে চেয়ে দেখছিলেন, আমি ঠিক আছি কি না। একজন শিক্ষকের প্রকৃত ভাবনা আসলে কী, ওই ঘটনা থেকে আজও আমি শেখার চেষ্টা করি। পাশাপাশি অসীম শ্রদ্ধা জেগে ওঠে শিক্ষকের প্রতি।
এবারে দ্বিতীয় ঘটনা। আমি মুসলিম, আর তিনি ছিলেন ঠাকুর। সাধারণভাবে এখানে একটা দূরত্বের ভাবনা যেন থাকে লোকাচারে। কিন্তু আবু ঠাকুর ছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। একদিন লুকোচুরি খেলতে আমি তাঁর ঠাকুরঘরে ঢুকে পড়ি। তখন পরিবারের বাকি মানুষের কিছুটা বিরূপ ভাবনা প্রকাশ পেলেও গুরুজির ভাবভঙ্গি ছিল আলাদা। তাঁর প্রয়াস ছিল কোনওভাবেই যাতে আমি মনে দুঃখ না পাই। বিভেদমূলক কিছু যাতে আমার মনের ভেতরে ঠাঁই না পায়। তাই খুব কায়দা করেই ইশারায় আমাকে ঠাকুরঘর থেকে বের করে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেদিন হয়তো ঘটনার ভাবার্থ সঠিক বোধগম্য হয়নি। পরে উপলব্ধি করছি যে শিক্ষক ও মানুষ হিসেবে আবু ঠাকুর কত উচ্চমানের ছিলেন।
তাছাড়া বিমান বসু, হিরন্ময় পাল, তপন চক্রবর্তী সহ আমার বাকি শিক্ষকদের প্রণাম জানাচ্ছি আজকের দিনে। মনে পড়ে, আমি যখন ছাত্র আন্দোলনের জড়িত ছিলাম, তখন একদিন আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। সালটা ১৯৮৭। ওই সময়ে আমার পরীক্ষাও ছিল। তৎকালীন নবীনচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ হিরন্ময় পাল স্যার আমাকে জামিনে ছড়িয়ে আনেন। রাত একটা-দেড়টা নাগাদ নিয়ে যান তাঁর বাড়িতে। ওখানেই রাখেন। খাবারের ব্যবস্থা করেন। পরদিন আবারও খাইয়ে-দাইয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী আমাকে পরীক্ষায় পাঠান। এসব ঘটনা নিয়ত দাগ কাটে আমার মনে। ফলে এসব শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়ে আমি যা বুঝেছি, তাঁদের অনুপ্রেরণা, উৎসাহ ও পাঠদান থেকে আমি যা শিখেছি, সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, একজন শিক্ষকের শিক্ষাদানের পরিসর যে দুই মলাটের ভেতর সীমাবদ্ধ নয়, তার বাইরেও অনেক কিছু! জাতি, ধর্ম, বর্ণের বেড়াজাল তাঁর ভাবনাকে কলুষিত করতে পারে না। একজন পড়ুয়ার চেতনার বিকাশের কারিগর কিন্তু সেই শিক্ষকই। আবু ঠাকুর গুরুজি তা হাতে-কলমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমি মনে করি, শিক্ষকের ভূমিকা পিরিয়ডের কয়েকঘন্টায় সীমিত নয়। ২৪ ঘন্টা। অন্যান্য চাকরিতে এলোটেড টাইম ও ডিউটি থাকে। এটা সম্পূর্ণ করলেই শেষ। কিন্তু শিক্ষকের আসল কাজ শুরু হয় তাঁর এলোটেড ডিউটি শেষ হওয়ার পর। একজন শিক্ষকের আসল পরিচয় লুকিয়ে থাকে তাঁর ভাবনার মধ্যেই। যে ভাবনার প্রতিফলনেই আমরা খুঁজে পাই শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য।
চার দশকের বেশি সময়ের এই জীবনে চলার পথে বহু মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করেছি৷ এখানে শিক্ষা মানে আমি পুথিগত শিক্ষার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চাইছি না৷ বরং সামগ্রিক শিক্ষার ব্যাপারেই বলতে চাইছি৷ তবে এই স্বল্প পরিসরে হয়তো ভুলবশত কারও কথা আলোচিত না হতেও পারে৷ সে জন্য আমি অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি৷ প্রত্যেকের মত আমার সর্বোচ্চ শিক্ষাগুরু হচ্ছেন আমার মা৷ আমার বাবা অমিতকুমার নাগের পেশা সাংবাদিকতা হওয়ার দরুন তিনি সবসময় ব্যস্ত থাকতেন৷ এর পরও রাতে অন্তত আধঘণ্টা সময় আমার জন্য বরাদ্দ রাখতেন৷ ওই সময় পাঠ্যপুস্তকের বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতেন ও আমার জ্ঞানপিপাসা নিবারণের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন৷
আমার মা পূরবী নাগের অবদান আমার জীবনে অপরিসীম৷ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আমি গুয়াহাটিতে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় নিকলস স্কুলে পড়েছি৷ সেখানে বাংলা পড়ার কোনও সুযোগ ছিল না৷ আমার মা নিজে উদ্যোগী হয়ে প্রত্যেক বছর আমি যে শ্রেণিতে পড়তাম, সেই শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই আমার জন্য কিনে আনতেন৷ নিজে আমাকে সেটি পড়াতেন ও নিয়মিত পরীক্ষা নিতেন৷ আজ আমি যতটুকু বাংলা লিখতে ও পড়তে পারি, তার জন্য মায়ের অবদান অনস্বীকার্য৷
আমি যখন ছোট, তখন আমাদের বাড়িতে ঘরোয়া কাজে সহায়তা করার জন্য হোজাই সংলগ্ন যোগীজানের আশা শীল নামের একটি মেয়ে ছিল৷ আমি তাকে ‘আচার’ বলে ডাকতাম৷ সেও আমাকে নিজের ছোটভাইয়ের মত স্নেহ করত৷ শৈশবে আমার চরিত্রগঠনে ওর অবদানও আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি৷ যখন আমি ভাল-খারাপ, সত্য-মিথ্যা নিজে বুঝতে পারতাম না, তখন সে আমাকে বিভিন্ন গল্পের মাধ্যমে সব বুঝিয়ে দিত৷ যতদিন সে আমাদের বাড়িতে ছিল, আমার মা-বাবাও তাকে নিজের মেয়ের মত আদর করতেন৷
আমার পুরো স্কুলজীবন নিকলস স্কুলে কেটেছে৷ এই বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছে আমি ঋণী৷ তবে এর মধ্যেও বিশেষভাবে আমি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করব৷ আমাদের ক্লাশটিচার ছিলেন বন্টি রাভা ম্যাডাম৷ উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং তাঁর জীবনশৈলীও আমার শিশুমনকে অনুপ্রাণিত করত৷ দীপালি ম্যাডাম, রানা স্যার, অনিল স্যারও আমাকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন৷
আরও একজনের প্রভাব আমার জীবনে যে কীভাবে পড়েছে, তা আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না৷ আমরা গুয়াহাটির রিহাবাড়ি এলাকায় যে ভাড়াবাড়িতে প্রায় ১৯ বছর ছিলাম, সেই বাড়ির মালিকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন গুয়াহাটির পুরনো স্বর্ণশিল্পের প্রতিষ্ঠান গিনি হাউসের স্বত্বাধিকারী বাবুল ধর, যাকে আমি বাবুলদাদা বলে সম্বোধন করতাম৷ পিতার অসুস্থতার জন্য বাবুলদাদাকে ছাত্রজীবন থেকে ব্যবসায় মনোনিবেশ করতে হয়৷ তবে পড়াশোনার প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা ছিল৷ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও পরিবার প্রতিপালনের জন্য বিএসসি পড়ার সময়েই তাঁকে পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে হয়৷ বাবুলদাদা দোকানের কাজ শেষ করে আমাকে অঙ্ক করানোর জন্য নিয়ে বসতেন৷ আমি তখন তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি৷ লসাগু, গসাগু, গড় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের প্রাথমিক শিক্ষা আমি বাবুলদাদার কাছ থেকেই পেয়েছি৷ পরে মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাধারণ গণিতে আমি যে আসামের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলাম, তার বীজ কিন্তু অঙ্কুরিত হয়েছিল বাবুলদাদার হাত ধরেই৷ পরবর্তীতে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পরীক্ষা পর্যন্ত বাবুলদাদা আমার পড়াশোনায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করে গিয়েছেন৷ যেদিন এমএসসি পরীক্ষার ফল বেরোয় ও আমি স্বর্ণপদক পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করি, বাবুলদাদার চোখ আনন্দাশ্রুতে ছলছল করছিল৷ সে বলেছিল, ”মানু, আমার অপূর্ণ বাঞ্ছা তোমার মধ্য দিয়ে পূর্ণ করলাম৷”
দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার দুজন গৃহশিক্ষক অমিতাভ চৌধুরী স্যার এবং অঞ্জন ভৌমিক স্যারের অবদানও আমার জীবনে প্রচুর৷ ইংরাজি গদ্য লেখার শিক্ষা আমি অমিতাভ স্যারের কাছ থেকে পেয়েছি৷ অঞ্জন স্যার আমাকে শুধু অঙ্ক শেখানোর কথা থাকলেও উনি আমাকে বিজ্ঞান এবং ভূগোলেরও বিভিন্ন বিষয় বুঝিয়ে দিতেন৷ ভারতের মানচিত্র আঁকার একটি কৌশল উনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, যা আমার মাধ্যমিক পরীক্ষায় খুব কাজে লাগে৷ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশ করার পর উচ্চ মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত আমি কটন কলেজে পড়েছি৷ সে কলেজের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার কাছেই আমি বিভিন্নভাবে ঋণী৷
পরবর্তী জীবনে গুরুচরণ কলেজে শিক্ষকতা করার সুযোগ পাওয়ায় অগণিত ছাত্রছাত্রীর সান্নিধ্য লাভ করেছি৷ আমার স্বীকার করতে একফোঁটাও দ্বিধা নেই যে, আমি ছাত্রজীবনে শিক্ষাগুরুদের কাছে যা শিক্ষালাভ করেছি, তার চেয়ে হয়তো বেশি শিখেছি আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে৷ এখানে সবার নাম উল্লেখ সম্ভব না হলেও দুয়েকজনের কথা আমাকে বলতেই হবে৷
আমার পিএইচডির গবেষণার কাজ চলাকালে আমার দুই প্রাক্তন ছাত্র দেবাশিস শর্মা ও অলক চক্রবর্তীর সহায়তা আমি নতমস্তকে স্মরণ করি৷ দেবাশিস আমাকে পাতার পর পাতা অঙ্ক কষে দিয়েছে এবং অলক আমাকে বিভিন্ন সমীকরণ সমাধান করার জন্য কমপিউটার প্রোগ্রাম শিখিয়েছে৷ বর্তমানে ড. দেবাশিস শর্মা গুরুচরণ কলেজে আমার সহকর্মী এবং ড. অলক চক্রবর্তী এনআইটি মেঘালয়ের শিক্ষক৷
আমার আরেক ছাত্র যার কাছ থেকে আমি প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয় শিক্ষালাভ করেই যাচ্ছি, তার কথা বলেই এই নিবন্ধের ইতি টানব৷ ওর নাম শুভঙ্কর চক্রবর্তী৷ উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গুরুচরণ কলেজে পড়ার সময় তাকে ছাত্র হিসাবে পেয়েছি ও তার সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে৷ পরে সে শিলচর পলিটেকনিক থেকে পাশ করে বর্তমানে পশ্চিমবাংলার শালবনি টাঁকশালে চাকরি করে৷ গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ব্যাপারে আমি তার কাছ থেকে শিক্ষালাভ করেছি৷ সে নিজস্ব উদ্যোগে নানা বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করেছে এবং তার সুফল অন্য অনেকের সঙ্গে আমিও লাভ করেছি৷ কলেজের ক্লাশ নিতে গিয়ে অসুবিধা হলে আমি শুভঙ্করকে ফোন করি এবং সে অত্যন্ত সহজভাবে আমাকে বুঝিয়ে দেয়৷ অনেকদিন রাত জেগে সে আমার জন্য পড়াশোনা করে আমাকে সারমর্মটা বোঝায়৷ আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, শুভঙ্কর আমার দেখা সেরা শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম৷ আমি মনে করি, যখন একজন ছাত্র তার শিক্ষকে রূপান্তরিত হয়, সেটাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের শিক্ষকজীবনের সার্থকতা৷