Barak UpdatesHappeningsBreaking News
বেতুকান্দি ঘিরে আতঙ্ক, নালার গার্ডওয়ালগুলো যেন শিশুদের নির্মিত ঝুলনযাত্রার ড্রেন!
ওয়েটুবরাক, ৯ জুন : মার্চ ফর সায়েন্স, শিলচর চাপ্টারের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার বরাক নদীর ভাঙা বাঁধ, স্লুইস গেট নির্মাণ ও মেরামতি এবং রাঙ্গিরখালের গার্ড ওয়াল তৈরি ও বাংলাঘাটের স্লুইস গেট নির্মাণের যে কাজ হয়েছে তার তথ্য অনুসন্ধান করে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সংবাদ মাধ্যমের সামনে তুলে ধরা হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করে প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন আশু পাল, হিল্লোল ভট্টাচার্য, কৃষাণু ভট্টাচার্য, মধুমিতা দেব, খাদেজা বেগম লস্কর প্রমুখ। প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে গুয়াহাটিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্যের জলসম্পদ মন্ত্রী বলেছিলেন, আসন্ন বর্ষায় সম্ভাব্য বন্যা মোকাবিলায় প্রস্তুত রাজ্য সরকার। এ কথা বলার প্রেক্ষিত হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, বিগত বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সবগুলি বাঁধের উপযুক্ত মেরামতির কাজ প্রায় শেষ। সামান্য যা কিছু বাকি, সে গুলোও ১৫ দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।
তার পরের সপ্তাহে তিনি শিলচর সফরে এসে বেতুকান্দির স্লুইস গেটের কাজ পরিদর্শন করেন। সপার্ষদ সেখানে গিয়ে কাজের অগ্রগতি দেখে তিনি সন্তোষও প্রকাশ করেন। কাড়ারপাড়ে নির্মিত মহিষাবিলের জল বেরিয়ে যাওয়ার স্লুইস গেট পরিদর্শনকালে স্থানীয় সাধারণ মানুষ নিম্ন মানের কাজ হয়েছে বলে অভিযোগ করলে এর দায় সুকৌশলে তিনি ইঞ্জিনিয়ারদের উপর ঠেলে দেন।
মন্ত্রীর সফর শেষ হওয়ার পর, ‘মার্চ ফর সায়েন্স, শিলচর চাপ্টারের এক প্রতিনিধি দল কাড়ারপার, বাঘাডহর, বেরেঙ্গা, কনকপুর সহ পুরো বরাকপার অঞ্চল ঘুরে দেখে। পাশাপাশি শহরের মালুগ্রাম অঞ্চল, অন্নপূর্ণাঘাট এলাকায় নদীভাঙন রোধের কাজ এবং বাংলাঘাট এলাকায় রাঙ্গিরখালের দ্বিতীয় স্লুইস গেট নির্মাণের কাজও বিস্তারিত ভাবে খতিয়ে দেখা হয়। সেই সঙ্গে কনকপুর-ঝাপিরবন্দ এলাকায় রাঙ্গিরখালের যে যৎসামান্য কাজ হয়েছে এবং বর্তমানে অজানা কারণে বন্ধ রয়েছে, সেটাও পরিদর্শন করা হয়। রংপুরের আঙ্গারজুর এলাকা, শিমূলতলা এলাকা এবং মণিপুরিবস্তি এলাকার যে যে স্থান দিয়ে বিগত বন্যায় বরাক ও মধুরার জল ঢুকেছিল, সেই জায়গাগুলিও দেখে আসা হয়।
সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিগত ভয়াবহ বন্যায় পরিকল্পিত ভাবে যখন বলা হচ্ছিল, বেতুকান্দির বাঁধ কেটে দেওয়ায়ই শিলচর শহরের বন্যার মূল কারণ, তখন তাঁরা তথ্য সহকারে তুলে ধরেছিলেন যে, বাঘাডহর এবং বেরেঙ্গা অঞ্চলে বিগত তিন দশক ধরে বাঁধ মেরামতির কোনো কাজ না হওয়ায় বিভিন্ন জায়গার প্রায় ২০-২৫ টি স্থান দিয়ে বন্যার বিপুল জলরাশি শহরে ঢুকেছিল। স্থানে স্থানে অনুচ্চ বাঁধ টপকেও জল ঢুকেছিল। দীর্ঘদিনের এই অবহেলা এবং দুর্নীতিকে ঢাকতেই রাজনৈতিক স্বার্থে বেতুকান্দিকে টার্গেট করে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু ভয়ঙ্কর সেই বন্যার জন্য কাড়ারপাড়ের বাঁধ কাটার চেয়েও বেশি দায়ী বাঘাডহর, বেরেঙ্গা, কনকপুর এলাকার অবহেলিত বাঁধগুলি। সে সময় সংগঠনের বক্তব্যকে অনেকেই নাকচ করে দিতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। এমন কী সংবাদ মাধ্যমের একাংশও বক্তব্যকে কটাক্ষ করে বলেছিল, কাড়ারপারের বাঁধ কাটার সাথে দুষ্কৃতীদের আড়াল করতেই নাকি তা বলা হয়েছে। অথচ সেই বন্যার এক বছর পর, বন্যা প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলোই প্রমাণ করে দিয়েছে, যে সেদিনের সংগঠনের বক্তব্য ছিল ১০০% সঠিক।
সংগঠনের পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, কাড়ারপাড়ের স্লুইস গেটে যাওয়ার আগে যে দুই জায়গায় নদী ভাঙনের উল্লেখ সেদিন করা হয়েছিল, সেই জায়গায় রিং বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এখনও অন্তত তিনটি জায়গায় বাঁধ নির্মাণ হয়নি। এই না হওয়ার কারণ হিসাবে অনেক যুক্তি দেখানো হতে পারে। কিন্তু হয়নি যে, এটা সত্য। যদি গত বছরের মত নদীতে জলস্ফীতি দেখা দেয়, তবে এই জায়গাগুলো দিয়ে জল ঢুকতে পারে।
কাড়ারপারের স্লুইস গেট সম্পর্কে তারা বলেন, তাড়াহুড়ো করে ‘কাজ শেষ’ দেখাতে গিয়ে অনেক জায়গায়ই কাজের গুণগত মানের সঙ্গে আপস করা হয়েছে। স্লুইস গেটের ভিতরের দিকে, অর্থাৎ মহিষাবিলের দিকে বক্স কালভার্টের কাজ অর্ধসমাপ্ত রয়েছে। কালভার্ট নির্মাণে ব্যবহৃত লোহার রডগুলোই বলে দিচ্ছে, এদিকে কালভার্টের দৈর্ঘ্য আরো বাড়ানো হবে। স্লুইস গেট থেকে বেরিয়ে জল যখন নদীর দিকে যাবে, সেদিকে পাথর এবং তারের নেট দিয়ে নির্মিত নালার গার্ডওয়ালগুলো দেখে যেন মনে হচ্ছিল, শিশুদের নির্মিত ঝুলনযাত্রার ড্রেন। ঘটা করে স্লুইস গেটের উদ্বোধন করে জল ছাড়তেই ২৪ ঘন্টার মধ্যে তা ভেঙে নদীতে চলে যায় সেই গার্ডওয়াল। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, মহিষাবিলে জমে থাকা জলস্তরের উচ্চতার সাথে বরাক নদীতে বয়ে চলা জলস্তরের উচ্চতার ফারাক, মহিষাবিলে জমে থাকা জলের পরিমাণ যাচাই করে নিয়ে, সেই জল কী গতিতে নদীতে নামবে, তার পার্শ্বচাপ এবং তীব্রগতির ফলে কী পরিমাণ ক্ষয় করার ক্ষমতা তৈরি হবে, সে সব কী উদ্বোধনের আগে হিসেব হয়নি? যদি হয়ে থাকে, তবে সেই হিসাব অনুযায়ী গার্ডওয়াল তৈরি হয়নি কেন? আর যদি সেই ক্যালকুলেশন না হয়ে থাকে, তবে তাড়াহুড়ো করে উদ্বোধন বা তার টেস্ট ড্রাইভ করা হলো কোন চাপে পড়ে? যারা উদ্বোধন করে কৃতিত্ব নিতে চাইলেন, তারা কী এখন এই ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নেবেন?
বাঘাডহর, বেরেঙ্গা, কনকপুর এলাকায় দীর্ঘদিনের অবহেলিত বাঁধকে বন্যার অন্যতম কারণ হিসাবে তুলে ধরায় যারা সংগঠনের সমালোচনা করেছিলেন, আজ তারা যেন একবার ওই এলাকা গুলোতে নির্মিত বাঁধ গুলো দেখে আসেন। যদি বিগত বন্যার জন্য সেই বাঁধগুলো দায়ী না হতো, তা হলে সেই বাঁধগুলো এত উঁচু করে পুনর্নির্মাণ করা হল কেন? জলসম্পদ বিভাগ সেই এলাকাগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করায় সংগঠনের সেদিনের অভিযোগ সত্য বলে প্ৰমাণিত হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও নিম্নমানের কাজের অভিযোগ রয়েছে। সংগঠনের পরিদর্শন কালে দেখা গেছে, বহু স্থানে নবনির্মিত বাঁধের উচ্চতা স্বাভাবিক ভূমিস্তর থেকে ২০ থেকে ২৫ ফুট পর্যন্ত রয়েছে। অথচ এত উঁচু মাটির বাঁধ যাতে ধসে না পড়ে, তার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দীর্ঘ এলাকা জুড়ে ইতিমধ্যেই বাঁধের মাটিতে চার থেকে ছয় ইঞ্চি চওড়া ফাটল দেখা দিয়েছে। আরো দুয়ে’ক পশলা জোরে বৃষ্টি হলেই সেই সব বাঁধের অধিকাংশ মাটি ধসে পড়তে পারে। ফলে আবারও শহরে বন্যার জল ঢুকে পড়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। মার্চ ফর সায়েন্স সরকারের কাছে দাবি জানায়, জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের পয়সায় নির্মিত বাঁধের মাটি যাতে ধসে না পড়ে, সেইজন্য প্রটেকশন ওয়াল বা অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে।
মালুগ্রাম এবং অন্নপূর্ণাঘাট এলাকায় নদীর ভাঙন রোধে ‘জিও’ ব্যাগ দিয়ে প্রটেকশনের কাজের স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করা হয়। মালুগ্রামে ‘জিও’ ব্যাগের পাশাপাশি বেশ কিছু ‘পর্ক্যুপাইন’ দেওয়া হয়েছে। এই এলাকাতে নদীতীরে বসবাসকারী প্রচুর মানুষ নদীতে স্নান করেন। এইসব ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ‘পর্ক্যুপাইন’ যখন বর্ষায় জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে থাকবে, তখন স্নান করতে নামা মানুষজন, বিশেষ করে বালক-বালিকারা পর্ক্যুপাইনের মধ্যে আটকা পড়ে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। এ ব্যাপারটি সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে ভেবে দেখতে হবে। অন্নপূর্ণাঘাটে হাজার তিনেক জিও ব্যাগ দিয়ে ভাঙন প্রতিরোধের যে চেষ্টা হয়েছে, তা বছর দুয়েকের মধ্যেই সম্পূর্ণ ধসে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। রেল বিভাগের জমির তলা দিয়ে বেশ কয়েকটি জায়গায় জল চুঁইয়ে এসে ছোট ছোট জলধারা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এই জলই জিওব্যাগের তলা এবং উপর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে নদীপাড়ের মাটিকে ধসে যেতে সাহায্য করবে। এই চুঁইয়ে আসা জলের ধারা বন্ধ করতে না পারায় নিউ কলোনি এলাকায় যাওয়ার সঙ্কীর্ণ মেটে রাস্তাটি ইতোমধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আগামীদিনে রেলের জমি এবং সম্পত্তিও নদীগর্ভে বিলীন হবে, এতে কোনও সন্দেহ নেই।
রংপুরের আঙ্গারজুর এলাকায় গত বন্যার পর উল্লেখযোগ্য কোনও কাজই হয়নি। মানিকখালের পাশে বাঁধ একেবারে ঝুরঝুরে হয়ে আছে। আঙ্গারজুরের পুরোনো প্রটেকশন ওয়ার্কের শেষ মাথায় যে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছিল, সেখানেও কোনো কাজ হয়নি। আবার বন্যা হলে সেই ভাঙন নিশ্চিতরূপে রংপুরের বিস্তৃত আবাসিক এলাকায় বিপর্যয় তৈরি করবে। শিমূলতলা এবং মণিপুরিবস্তি এলাকায় বিগত বন্যার পরপর লাল মাটি এবং বাঁশের গড় দিয়ে যে কিছুটা কাজ হয়েছিল, তার পর কেউ সেই কাজে আর হাত দেয়নি। বাংলাঘাটের দ্বিতীয় স্লুইস গেট নির্মাণের কাজ যদিও এখনো চলছে, তার গতি অত্যন্ত শ্লথ। ২০২৪ সালেও এটির নির্মাণ শেষ হবে বলে মনে হয় না। ফলে আগামী বর্ষায়ও শিলচর শহরের মানুষ জমা জলে নাকাল হবেন, এটা ধরেই নেওয়া যেতে পারে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, কনকপুরের ঝাপিরবন্দ এলাকায় কনক সঙ্ঘ ক্লাবের পাশ থেকে রাঙ্গিরখালের দু’পাশে যে ওয়াল তৈরির কাজ চলছিল, তা কোনো এক অজানা কারণে দীর্ঘদিন থেকেই বন্ধ রয়েছে। কমবেশি ১০০ মিটারের মত জায়গায় যেটুকু কাজ শুরুতে হয়েছিল, আজও সেখানেই পড়ে রয়েছে। চিরুয়া খালের উপর ভেঙে যাওয়া কালভার্টটি অবশ্য নতুন ভাবে নির্মিত হয়েছে। কিন্তু রাঙ্গিরখালের পাহাড়প্রমাণ আবর্জনা যেমন ছিল, তেমনি রয়েছে। শুরু থেকেই যে ঢিমেতালা গতিতে কাজ এগোচ্ছিল, তাতে গৃহীত পরিকল্পনা অনুযায়ী রাঙ্গিরখালের কাজ শেষ করতে হলে দুই দশক লেগে যাবে। এখন মনে হচ্ছে, অর্ধ শতাব্দীতেও এই কাজ শেষ হবে না। সংগঠনের পক্ষ থেকে শিলচরের জনসাধারণের কাছে আরো একটি ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হওয়ার আগে রাঙ্গিরখাল সহ বন্যা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত কাজগুলি নিয়ে সচেতন ভাবে প্রতিবাদ মুখর হতে আহ্বান জানানো হয়। সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে কাজগুলো দ্রুত এবং সুষ্ঠুভাবে সমাপন করার দাবি তুলতে আহ্বান জানানো হয়। অন্যথায় প্রতি বর্ষায় বন্যা, নোংরা জমা জলে ভোগান্তির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে না।