Barak UpdatesHappeningsBreaking News
দ্বিজেন্দ্র-ডলি মেমোরিয়েল ট্রাস্টের সেমিনার আর আমার অভিজ্ঞতা, লিখেছেন গৌরী দত্তবিশ্বাস
//গৌরী দত্তবিশ্বাস//
পড়াশোনার জগৎ আমাকে সব সময় টানে । তাই সেমিনার- বিতর্কসভা -সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করা আমার কাছে নিছক সময় কাটানো নয়, আমাকে সুস্থভাবে বাঁচার রসদ জোগায়। আমার প্রাণভোমরা এসব — সবারই সত্তাগুলো লুকিয়ে থাকে। সময় সুযোগ মতো প্রকাশ পায়। তাইতো আমি প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ ফেব্রুয়ারি বলেছিলাম— “বই ? সে তো শ্রেষ্ঠ আত্মীয়, যার সঙ্গে কোনদিন ঝগড়া হয় না– মনোমালিন্য হয় না”! লেখিকা প্রতিভা বসু বলেছেন, বই একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গী৷ সমরেশ বসুকে সাংঘাতিকভাবে জানতাম, অনেক পড়েছি তা একেবারেই নয়। কলেজ জীবনে পড়েছিলাম, তারপর ছোট গল্প পড়েছি এতটুকুই।
এই সেমিনারের শ্রোতা হবার সৌভাগ্য হওয়ায় একরাশ আলো যেন আমার মনের সব দরজা খুলে দিল । তাঁকে জানার পথ খুলে দেওয়ায় মুগ্ধ হলাম, ঋদ্ধ হলাম। ১০ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় দ্বিজেন্দ্র ডলি মেমোরিয়েল ট্রাস্টের আর্কাইভের যাত্রা শুরু হয়। সংগ্রহ ও সংরক্ষণ উদ্বোধন করলেন বিশিষ্ট লোকসংস্কৃতি গবেষক অধ্যাপক অমলেন্দু ভট্টাচার্য।
সেখানে পেলাম বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গল্পকার প্রয়াত সমরেশ বসুর ছেলে নবকুমার বসু, যিনি বিদেশে থাকেন, বিশিষ্ট ডাক্তার, সার্জন। তাঁর স্ত্রীও ডাক্তার। অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন নবকুমার বসু। তাছাড়া আমরা পেয়েছি পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ, গুয়াহাটি থেকে আমন্ত্রিত গুণীজনদের।
এবার আসল প্রসঙ্গে আসি। শিলচর শহরের প্রেমতলায় ‘জগৎ কুটিরে’ দ্বিজেন্দ্র-ডলি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এ মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় রবিবার অর্থাৎ ১১ ফেব্রুয়ারি। বিষয়: ‘সমরেশ বসু ও সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্য’ ৷ দু’দিনের আন্তর্জাতিক সেমিনার, সঙ্গে আসাম ইউনিভার্সিটির ফ্রেন্স ডিপার্টমেন্ট। আমার ছাত্রী দুর্বা আমাকে ভীষণ আন্তরিকভাবে নিমন্ত্রণ করেছিল যাবার জন্য৷ বলেছিল, দু’দিনই যেন অতি অবশ্যই লাঞ্চ ওখানে করি। অসুবিধে থাকলে আলাদা কথা ইত্যাদি। এত আন্তরিক ভরা কথাগুলো ছিল এই সুযোগটি কি ছাড়া যায়? উপভোগ করলাম, সঙ্গে ছিলেন আমার প্রিয় মানুষ সুমিত্রা দত্ত। দুর্বা দেব ও শ্যামানন্দ চৌধুরী সব কিছুর কারিগর। দু’জনে কি অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে নিরলস ভাবে চমৎকার করে প্রায় তিনটা দিন আমাদের উপহার দিল। অথচ কম কথা কাজ বেশি ভাবনায় রেখে।
শনিবারের অনুষ্ঠানের ভাগীদার আমি হতে পেরেছি, তার স্বাদ গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়েছে, লেখক কালকূটের আত্মজকে আমি দেখতে পেয়েছি, এ আমার পরম পাওনা। তার মধ্যে আবার সাহস করে তাঁদের সামনে দু’ চার কথা বলেওছি ! সাংঘাতিক ব্যাপার । পরের দিন রবিবার সাড়ে দশটায় সেমিনার আরম্ভের সময় ছিল। অনিবার্য কারণবশত ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায় বহু গবেষকরা। অনুকুল ঠাকুরের শোভাযাত্রা ছিল। ১১ টায় শুরু হলো সেমিনার। সংগৃহীত লেখা- পড়া থেকে আলোচনা পর্ব, একসাথে খাওয়া-কথা শোনা, সব মিলিয়ে আমি পুলকিত ছিলাম। কথা বলেছি ঢাকা ইউনিভারসিটির অধ্যাপক মোহম্মদ গোলাম মওলা ও সুখেন বিশ্বাসের সঙ্গেও৷ চমৎকার মানুষ তাঁরা।
সমরেশ বসুর নানা গল্পের আধারকে নিয়ে স্ক্রিপ্ট নিজে লিখে নৃত্য প্রদর্শন করল শুভব্রতা দাস নামে এক ছাত্রী । করিমগঞ্জের মেয়ে। অসাধারণ অভাবনীয় চিন্তার ফসল দেখে মুগ্ধ হলাম সবাই।
সাহিত্যক নবকুমার বসুর কাছ থেকে জানতে পারি নানান রকমের তথ্যাদি। সমরেশ বসু মধ্যবিত্তের দুঃখকষ্টকে আড়াল করতে চাননি। ভীষণ সংবেদনশীল- সহনশীল, মানবতার মূর্ত প্রতীক যেন ছিলেন। মানবতাহীন মানুষ দেখলে খুব কষ্ট পেতেন। সমরেশ বা কালকূটের জীবনকে জানার কি অদম্য কৌতূহল ছিল শিশু বয়স থেকে! দশ বছর বয়স থেকে কি আকুলতা, সবকিছু জানতে চান। বস্তিতে থাকতেন অভাব অনটনের মধ্যে। প্রথম জীবনে ডিম বিক্রিও করেছেন। দুস্থ-পীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষদের সুখ- দুঃখে কাতর ছিলেন। কট্টর বামপন্থী ছিলেন, তাই মেহনতি মানুষের সংগ্রামেও জড়িত ছিলেন। লেখাপড়ায় ততটা মন ছিল না৷ আগ্রহ ছিল বাঁশি বাজানোতে, সাঁতার কাটায় এবং নাটক করা ইত্যাদিতে। বাউন্ডুলে স্বভাবের ছিলেন ছোটবেলায়। মা ছিলেন নিপুণ কথা শিল্পী, গানও জানতেন। কিছুটা সাংস্কৃতিক পরিবেশও ছিল৷ এইভাবে মায়ের কাছ থেকে জীবন বোধ গড়ে ওঠে। নিজেকে জীবনশিল্পী তৈরি করেন যাপিত জীবনে এবং কালকূট হয়ে ওঠেন। একদিকে সর্বনাশা অভাব- বীভৎসতা, আর একদিকে বৈভব ও বৈচিত্র সব দেখেছেন। সর্বনাশী ক্ষুধার্ত মুখগুলো দেখে তাঁর মানবপ্রেম উদ্বেল হতো।
বাংলাদেশ থেকে আগত অধ্যাপক মওলা ভীষণ জ্ঞানী মানুষ৷ বিস্তারিত ভাবে কালকূটকে বর্ণনা করেন । আমি তখন মন্ত্রমুগ্ধ। একদম শেষে সমাপ্তি অধিবেশনে সুমিত্রা দত্তকে সভাপতি করা হয়। সেখানে আমাকেও ডাকা হয়৷ উত্তরীয় পরিয়ে আমাদের সম্মাননা জানানো হয়। সম্মাননা পেয়েছি আগে আরও, কিন্তু এ পাওয়া একেবারেই অন্যরকম। রোমাঞ্চিত বোধ করি কারণ এত সব গুণীজনের পাশে বসে আছি আমি! অনুভূতি ব্যক্ত করতে অনুরোধ করলে বললাম —- “এ দু’দিন এখানে সেমিনার ও আলোচনাগুলোকে নানান ভাবে পরিবেশন করায় আমি ঋদ্ধ হলাম । এভাবে গুণীজনদেরকে পেয়ে প্রচুর অক্সিজেন নিয়ে বাড়ি ফিরব। অসাধারণ ভাবে কাটলো, মনে রাখার মত। দ্বিজেন্দ্র ডলি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট দীর্ঘদিন থাকুক । এখানে যা দেখে গেলাম মনে গেঁথে থাকবে। বুকভরা আবেগ আবেশ সবকিছু নিয়ে বাড়ি ফিরব।”
আগাগোড়া আমার এই অনুষ্ঠানের গভীরে মন ছিল, তাই উপলব্ধিগুলো নেশাগ্রস্ত করে রাখবে অনেক দিন। সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায় জীবনের অভিজ্ঞতা । গবেষকদের খণ্ড খণ্ড লিখা বিশেষ করে দশ মিনিটের মধ্যেই শেষ করা কম কথা নয়। এটা আমাকে অবাক করেছে। কি প্রচণ্ড পরিশ্রমে তথ্যগুলো সংগ্রহ করতে হয়েছে বুঝতে পেরেছি !
সময়কাল ৬০-এর দশক । পড়াশোনা করার সময় গবেষণা করেছিলাম৷ তখন আমাদের একটাই বিষয় দেওয়া হতো পিএইচডির জন্য। সে বিষয়েই পরিপূর্ণ ভাবে লিখতে হতো, পাঁচ-ছয় বছরেও শেষ হতো না। প্রচণ্ড পরিশ্রমের ব্যাপার ছিল, আর এখন সময়ের সঙ্গে কত পরিবর্তন হয়েছে। এটাও আমার একটা ভালো অভিজ্ঞতা হল। একদিকে বিভিন্ন ভাবে সংগ্রহ করা তথ্য এক জায়গায় এনে জোট করে তাকে বিশ্লেষণ করা কম বাহাদুরি নয়!
সবার নিষ্ঠা, ভালবাসা, একাগ্রতা ও শৃঙ্খলাবোধ আমাকে করেছে ভীষণ অবাক এবং মুগ্ধ তো বটেই। এর পর বলতেই হয় কি নিখুঁত পরিচালনায় পরিচালিত হল তিনদিনের এই অনুষ্ঠান ! পর্দার পিছনে মা দুর্গার মত দুর্বার গতিতে চলা দুর্বার মাথা, হাত তো আছেই। প্রত্যেকটি মেয়ে (গবেষক) যাদের সেখানে পেয়েছি, অনবরত খবর রাখছে। চা খাবার দিচ্ছে, কি শান্ত স্নিগ্ধ আন্তরিক! সবার জন্য রইল আমার অফুরন্ত ভালবাসা৷ সাংঘাতিকভাবে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য এরা ।
লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার শুধুমাত্র বই সংগ্রহ করাই নয় বা এসে বই পড়াই নয়। কি নেই সেখানে! এই সংস্থা নানাভাবে সারা বছর কাজ করে যায় ।পিঠেপুলি বানানো, সন্দেশ, বিভিন্ন স্বাদে রান্না পরিবেশন ও প্রতিযোগিতা থেকে সাহিত্য আসর, সম্মাননা জানানো, মেধাবী ছাত্রীদের টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল জীবন তৈরি করে দেওয়া এবং নানাবিধ কাজ নানাভাবে করে যাচ্ছে। কলেজের সেরা স্নাতকদের পুরস্কৃত করেছে, সঙ্গে ৫০০০/ টাকা। আজীবন লাইব্রেরি সদস্য করে দেওয়া –এমন কি করোনা কালে পর্যন্ত এদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম । কোনও লোকদেখানো ঠাট নেই, আড়ম্বর নেই, অথচ আন্তরিকতায় ভরা। সরকারি অনুদান একেবারেই নেই, অথচ নিরলস ভাবে নীরবে প্রচারবিমুখ হয়ে এরা সমাজে কত যে উপকার করছে বারবার বললেও শেষ হবে না।
এসব দেখা আমার জীবনে একটা বিরাট পাওনা।যদিও আমি আরও অনেক কিছুতে গেছি এই সংস্থার ডাকে। আমি ছড়িয়ে দিতে চাই সবার মাঝে এমন দৃষ্টান্ত মূলক অনুপ্রেরণার গল্প ।প্রাণিত হবার উৎস হিসেবে শিখুক, জানুক, আসুক বই পড়তে । আবারও বলি, দুর্বা-শ্যামানন্দ-বরুণ আরও অনেকে এরা দীর্ঘদিন সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকুক । তোমরা সত্যিই সমাজের এক উদাহরণ ও অনুপ্রেরণার উৎস।