Barak Updates
দেড়শো বছরের প্রথা ভেঙে বলি বন্ধ হল শিলচরের শঙ্করবাড়িতে
২৫ অক্টোবরঃ দুর্গাপুজোয় পশুবলির জন্য শিলচরের শঙ্করবাড়ির বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। দেড়শো বছরের সেই প্রথা ভেঙে গেল এ বার। পরিবারের ভেতর থেকেই বলির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠল। বছর চারেক ধরে দ্বন্দ্ব-ধন্দ চলছিল। একপক্ষের বক্তব্য, এতদিনের রীতি ভেঙে ফেলা ঠিক হবে না। তাঁরা আশঙ্কায় ছিলেন, যদি অমঙ্গল হয়! আরেক পক্ষের বক্তব্য, মায়ের নামে পশুর প্রাণ কেড়ে নিয়ে কীসের আবার মঙ্গল-অমঙ্গল! সমাধানের সন্ধানে কেউ ছুটলেন রামকৃষ্ণ মিশনে। কেউ গিয়েছেন পারিবারিক গুরুদেবের কাছে। সব মিলিয়ে এই বছরেই সিদ্ধান্ত হয়, আর বলি নয়। ছাগ তো নয়ই, হাঁস-পায়রাও নয়। এর বদলে চালু হল নিরামিষ ভোগ বিলি। হাজার মানুষ তিনদিন ভোগের প্রসাদ নিয়েছেন।
পরিবারের প্রবীণতম সদস্য তাপসশঙ্কর দত্ত জানালেন, ‘একসময় বাড়িতে মোষ বলি হতো। ঠাকুর্দা মোষের কাটা মুণ্ডু নিয়ে সাতবার মণ্ডপ প্রদক্ষিণ করতেন।’
অনেকদিন আগেই মোষ বলি বন্ধ হয়ে যায়। তবে ছাগ বলি চলছিল। সঙ্গে হাঁস, পায়রা। এলাকার মানুষও তাঁদের মানত নিয়ে আসতেন বলির জন্য। গত বছরও তিনদিনে চারটি ছাগবলি হয়।
তাপসবাবুর কথায়, ‘বলি উঠিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে কয়েক বছর ধরেই পরিবারের ভেতরে দাবি উঠছিল। আবার বলির পক্ষেও অনেকে যুক্তি দেখান, শাস্ত্রের কথা বলেন। এক পরিবারে এখন দশ ইউনিট। জনা পঞ্চাশেক সদস্য। গুয়াহাটি, কলকাতা, শিলচর— বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছেন তাঁরা। সকলের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। এর ওপর শাক্তমতে পুজো হয় আমাদের বাড়িতে। ফলে চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন ছিল।’
তাঁর স্ত্রী সুমিত্রা দত্ত বললেন, পরিবর্তন শুরু হয়ে গিয়েছিল চার বছর আগেই। আস্ত পশুমুণ্ড নিবেদন করে দেবীকে দেওয়া হতো শুধু চাল-কলা, ফল-ফসারি। বাড়ির সবাই খেতেন মাংস-ভাত। গত বছর তিনদিনের ভোগ দেওয়া শুরু হয়। সুমিত্রাদেবীর কথায়, ‘১৯৬৪ সালে বিয়ে হয়েছে আমার। একবারও বলির সময় মণ্ডপে যাইনি। এমন দৃশ্য দেখতে পারেন না আমার জা দেবযানীও। ফলে আমরা বলির বিরুদ্ধেই ছিলাম। পরে বাড়িতে রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিতের সংখ্যা বাড়তে থাকলে আমরা পাল্লায় ভারি হয়ে যাই।’
বলি বন্ধ হওয়ায় আরও এক চাপ থেকে পরিবারের সবাই মুক্ত হলেন। প্রতিবছর দুশ্চিন্তায় ভুগতে হতো, এক কোপে যদি বলি না হয়! বলি আটকে গেলে আবার নানা সমস্যা। নতুন পাঠা কিনে এনে যূপকাষ্ঠে চড়াতে হবে। না পেলে কাটা পাঠা ১০৮ টুকরো করে যজ্ঞের আগুনে দেওয়া আবশ্যিক। বেশ কয়েকবার এমনটা ঘটেছে। ফলে বলি মানেই পরিবারের সকলের মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার হতো। সবাই দিনভর ভাবতেন, সমস্ত বলি ঠিকঠাক হবে তো!
এ বার তা থেকে রক্ষা মিলেছে। সবাই সারাদিন শুধু ভেবেছেন, কখন মায়ের ভোগ লাগবে। আর কখন নরনারায়ণের মধ্যে তা বিলি করা হবে।
ঐতিহাসিক দেবব্রত দত্ত ১৯৬৬ সালে তাঁর ‘কাছাড়ে দুর্গোতসব’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ঠিক শহরের মধ্যে সম্ভবত সর্বপ্রথম দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাশঙ্কর দত্ত মহাশয়ের বাড়িতে। …তাঁহার পিতা গৌরীশঙ্কর দত্ত মহাশয় শতাধিক বতসর পূর্বে মূলবাড়ি অষ্টগ্রামে যে পূজার সূচনা করিয়াছিলেন, তাহা নিজ কর্মস্থলে বর্ষে বর্ষে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করিয়াছিলেন।’
এই বাড়িরই সন্তান (বর্তমানে প্রয়াত) অলকশঙ্কর দত্ত ‘দেড়শো বছরের পুরনো শংকর বাড়ির পুজো’ নিবন্ধে লিখেছেন, ‘পুজোর জন্য আমাদের ঠাকুরদাদার পৈতৃক এলাকা ময়মনসিংহ থেকে পুরোহিত নিয়ে আসা হত। মহালয়ার বেশ আগেই পুরোহিত এসে পৌঁছতেন। মহালয়ার দিন ঘট স্থাপন করা হত আর সেইসঙ্গে শুরু হত চণ্ডীপাঠ।…আমরা শাক্ত বলে আমাদের বাড়ির পুজোয় বলি দেওয়া হত। ঠাকুরদাদার আমল থেকে প্রতি বছরই মহিষ বলি হত। সেই আমাদের এবং অন্যদের পাঠা, হাঁস, কবুতর, কুমড়ো ইত্যাদি বলি দেওয়া হত। এই বলি দেখার দৃশ্যদর্শন এবং রক্তগ্রহণের ভিড় ছিল দেখার মত। নবমীর দিন দুপুরে জনতার জায়গা হত না বাড়িতে।’
বিজয়া দত্ত, মিত্রা দত্ত এবং আল্পনা দত্তের প্রকাশিত ‘দুর্গাশঙ্কর দত্ত স্মরণে’ বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সূচনাপর্বে এই পূজা এতদঞ্চলের একমাত্র পূজা হওয়ায় দূরদূরান্ত গ্রামবাগান এমনকি বদরপুর, করিমগঞ্জ থেকেও যেমন দলে দলে আসতেন অজস্র ভক্তবৃন্দ, তেমনি স্তূপীকৃত হত নানা প্রান্ত থেকে আসা ভক্তদের মানসা বলি। লাউ কুমড়ো থেকে পায়রা, হাঁস, পাঠা ছিল সেই বলির উপচার।’
আজ সেখানে থাকে পুজোর ফলমূল আর ভোগের সামগ্রী। সুমিত্রাদেবীর কথায়, ‘পাঠার মা-মা আওয়াজ নেই বলে আনন্দ এ বার বরং বেশিই হয়েছে। ওই আনন্দের জন্যই শঙ্করবাড়ির কালীপূজাতেও এ বার থেকে আর বলি হবে না।’