Barak UpdatesAnalyticsBreaking NewsFeature Story
জীবনে প্রথম কোনও সাংবাদিক দেখা, লিখেছেন সন্দীপ দে
//সন্দীপ দে//
পরিচয় সেই ছেলেবেলায়। তা ঠিক কবে থেকে, সাল কিংবা তারিখ, কিছুই মনে নেই। তিনি যে স্কুলে পাঠ নিয়েছেন, সেই স্কুলের ছাত্র আমিও। তবে আমি স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই তিনি মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। তাই হয়তো আগে কোনওদিন দেখেছি, কিন্তু ছেলেবেলার সেই স্মৃতি মুছে গেছে কবেই। তবে হ্যাঁ, এখনও মনে আছে জীবনে প্রথমবার কোনও সাংবাদিক দেখা। তিনি পীযূষকান্তি দাস।
সম্ভবত আমি তখন ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে। করিমগঞ্জ থেকে বাসে চেপে জালালপুর চা বাগানে আমাদের কোয়ার্টারে ফিরছি। কাটিগড়া চৌরঙ্গী থেকে সেই বাসেই উঠেছেন এক যুবক। গালভরা দাড়ি। পরনে নীল জিন্স আর লাল-সাদায় বাটি প্রিন্টের পাঞ্জাবি। বাঁ কাধে ঝোলানো হাঁটু পর্যন্ত এক কাপড়ের ব্যাগ। ওইসময় বিশেষ করে বামপন্থীদের এটা স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল। সঙ্গে আরও একজন ছিলেন। বাসে বসার আসন ফাঁকা না থাকায় দুজনে দাঁড়িয়েই সফর করছিলেন। আরও অনেকে সেই বাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। নজর যায় সেই যুবকের দিকেই। কারণ, যুবকটি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছিলেন। পরিচিত একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, তিনি পীযূষকান্তি দাস। সাংবাদিক। বাড়ি রাজপুরে (বর্তমানে রাজ্যেশ্বরপুর নামে পরিচিত)। পরবর্তীতে স্কুলে আয়োজিত রবীন্দ্রজয়ন্তী কিংবা অন্য অনুষ্ঠানে তাঁকে দেখেছি। কথাও হয়েছে। ওঁর ছোটভাই প্রণব আমার সহপাঠী হওয়ায় তুমি করেই বলেছি। তবে আদ্যোপান্ত গাম্ভীর্যের মোড়কে থাকা সেই ব্যক্তির সঙ্গে সেই সময় খুব একটা ঘনিষ্ঠতা হয়ে ওঠেনি।
১৯৯৫ সাল। স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা শেষে যখন অফুরন্ত সময়, তখন আমার মাথায় ভূত চাপে সাংবাদিকতার। নতুন আঙ্গিকে অত্যাধুনিক অফসেট মেশিনে শিলচর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে দৈনিক সোনার কাছাড় পত্রিকা। শুরু করি পাঠকের মতামতে লেখালেখি। শহরের শ্যামাপ্রসাদ রোডে তখন সোনার কাছাড়ের কার্যালয়। যা-ই লিখতাম ওই কার্যালয়ের পোস্টবক্সে ফেলে আসতাম। মোট পাঁচটি চিঠি প্রকাশিত হয় পত্রিকায়। এই লেখার সুবাদে ১ জুন থেকে ওই কাগজে ট্রেনি সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিই। একে তো শিক্ষানবিশ, তার ওপর কাউকেই চিনি না। সবাই নতুন। চিনতাম শুধুমাত্র পীযূষদা ও তাঁরই ছোটভাই প্রদীপদাকে। তখন বিজ্ঞাপন বিভাগ সহ ইংরেজি দৈনিক ফ্রন্টিয়ার সানে কাজ করত প্রদীপদা।
কিন্তু পীযূষদা তখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু ডাকসাইটে সাংবাদিকই নয়, বাদসা নামে এক সংগঠনের প্রথমসারির কর্মকর্তাও। কলকাতা থেকে প্রকাশিত অমৃতবাজার, যুগান্তরেও নিয়মিত লিখত। স্বাভাবিক ভাবেই আর পাঁচজনের চেয়ে একটু আলাদা মেজাজে থাকত পীযূষদা। ওইসময় দুই শিফটে কাজ হত পত্রিকা দফতরে। আমি ছিলাম দিনের শিফটে, আর পীযূষদা রাতে। কিছুদিন পর ডেক্স ছেড়ে কখনও কখনও ফিল্ডে যেতে হত নিউজ কভারে। আর রাতে এসে সেই নিউজ ফাইল করতে হত। তখন দেখা পেতাম পীযূষদার। কিন্তু সৌজন্যমূলক হাসি ছাড়া তেমন বিশেষ কথা হত না।
কাজের সময় বরাবরই কম কথা বলত পীযূষদা। পরবর্তীতে যখন রাতেও আমাদের কাজ করতে হত, তখন আমাদের লেখা বিশেষ অনুরোধে মাঝেমধ্যে এডিট করে দিত। কারণ, পীযূষদার মধ্যে বরাবরই পেশাদারিত্বের ছাপ ছিল। নিজের কাজ ছাড়া অন্যদের কাজে তেমন হাত দিত না। তবু বিশেষ করে বাইলাইনের কোনও লেখা হলে পীযূষদাকে না দেখিয়ে ডিটিপিতে সাধারণত ছাড়তাম না। আমাদের স্থির বিশ্বাস ছিল, পীযূষদা দেখলে সেই লেখা অবশ্যই ত্রুটিহীন হবে। আর হেডলাইন, তাও সেই পীকাদা-ই। তবে এসব যে সহজে হয়ে যেত, তা কিন্তু একেবারেই নয়। পীযূষদার মুড বুঝে আমাদের চলতে হত। নিউজ লেখার ধরন নিয়ে যেমন পরামর্শ দিত, তেমনি লেখা ভালো হলে প্রশংসাও করত। কিন্তু এরপরও ভয় লেগে থাকত। এমনও দেখেছি, লেখা হয়নি বলে কারও কারও কাগজ ছুঁড়ে ফেলে দিতেন। মাঝেমধ্যে হাসিঠাট্টা করত ঠিকই, কিন্তু আমাদের সেই ভীতিভাব থেকেই যেত।
পীযূষদা বেশ কিছুদিন সোনার কাছাড়ের পাশাপাশি ফ্রন্টিয়ার সানেও কাজ করেছে। বাংলা ও ইংরেজি, দুটোতেই সমান পারদর্শী ছিল। তাঁকে দেখেছি, এক কাগজে বাংলা, তো অন্য কাগজে ইংরেজি লিখতে। কখনও বাংলা এক প্যারাগ্রাফ, আবার কখনও ইংরেজি দুই প্যারাগ্রাফ। দুটো কপিই প্রায় একসঙ্গে তৈরি ডিটিপিতে পাঠানোর জন্যে। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম। যখন লিখতে শুরু করত, তখন নিমেষে শেষ করে ফেলত। কাটাকাটির কোনও বালাই ছিল না। হস্তাক্ষরও ছিল ঝকঝকে। নিউজের প্যারাও থাকত যেন মাপা। কম্পিউটারে টাইপিঙের পর না জেনেই বলে দেওয়া যেত, এটা পীযূষদার লেখা। তাছাড়া, তীর্যক কিংবা শ্লেষাত্মক লেখায় তাঁর জুড়ি ছিল না। ওইসময় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি আমলা, সবার সঙ্গে পীযূষদার সুসম্পর্ক থাকলেও সবাই যেন খানিকটা ভয়ের চোখেই দেখতেন। কারণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও পীযূষদার কলম আটকানো যেত না। তাঁর এই লেখনীর জন্যেই নয়ের দশকের শেষাংশে এক রাজনৈতিক নেতার অঙ্গুলিহেলনে তাঁর বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। এমনকি একবার তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। যদিও জনসমর্থনের চাপে বেশিক্ষণ থানায় আটকে রাখতে পারেনি পুলিশ।
পরবর্তীতে যখন সোনার কাছাড় থেকে বেরিয়ে পীযূষদা নিজে বিটিভি খোঁজখবর নামে ক্যাবল নিউজ শুরু করে, সেই থেকে প্রতিদিনকার যোগাযোগ ছিন্ন হতে থাকে। মাঝেমধ্যে কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হত, কিংবা ফোনে কথা। এরপর সময় যত গড়িয়েছে, ভয়ও অনেকটা কেটেছে। পীযূষদাও যেন পাল্টেছে। এখনও ভাবতে পারছি না, জীবনে প্রথম দেখা সেই সাংবাদিক আর আমাদের মধ্যে নেই। আজ সবই শুধু স্মৃতি। যে স্মৃতির আলোয় আলোকিত থাকবে আগামীর পথচলা।
(সন্দীপ দে বর্তমানে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত)