Barak UpdatesIndia & World UpdatesHappeningsBreaking News

আমাদের আর আসামের সঙ্গে থাকার কোনও অর্থ হয় না, কলকাতা প্রেস ক্লাবে প্রদীপ দত্তরায়

ওয়েটুবরাক, ২৭ সেপ্টেম্বর : স্বাধীনতার পর থেকেই বাঙালিরা আসামে উগ্র অসমিয়া জাতিয়তাবাদীদের বিদ্বেষ,নিগ্রহ এবং বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। আসামে বাঙালি মানেই বাংলাদেশি, বাঙালি মানেই ‘ঘুষপেটিয়া’ বাঙালি মানেই ‘ উইপোকা ‘ – এরকম একটি ধারণা রাজনৈতিক স্বার্থে দল নির্বিশেষে দিসপুরের শাসকরা সাধারণ জনতার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। আসাম ভারতের একমাত্র রাজ্য যেখানে বাঙালিদের ‘ ডাউটফুল ভোটার’ বা ‘ডি ভোটার’ নোটিশ দেওয়া হয়, সন্দেহজনক বিদেশি বলে তাদের ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নামক জেলখানায় আটকে রাখা হয়।  গত ৭ বছরের বিজেপি শাসনে ‘ডি নোটিশ ‘ দেওয়া হয়েছে ৭১ হাজার বাঙালিকে, বিদেশি ঘোষণা করা হয়েছে ৩৭ হাজারকে আর বহিস্কার করা হয়েছে একজনকে।

বুধবার কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কথাগুলি বলেন বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ৷ মুখ্য আহ্বায়ক প্রদীপ দত্তরায় বলেন, আসলে এরা কেউই বিদেশি নন৷ দরিদ্র , প্রান্তিক ও অধিকাংশ অশিক্ষিত শ্রেণির এসব বাঙালির কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের যথার্থ নথিপত্র নেই। তাই এদের আটকে রাখা হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্পে।

ডিটেনশন ক্যাম্পের নরক যন্ত্রনা ভোগের ভয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন বরাক উপত্যকার অর্জুন নমঃশূদ্র। এই পরিপ্রেক্ষিতে নরেন্দ্র মোদি শিলচরের জনসভায় ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের সরকার ক্ষমতায় এলে আসামের সব ডিটেনশন ক্যাম্প ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। সেই আশায় ভোট দিয়ে তাদের ক্ষমতায়ও বসিয়েছিলেন আসাম তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দুরা। কিন্তু ডিটেনশন ক্যাম্প ভাঙা তো দূর, সেই নির্বাচিত সরকারের কার্যকালের পাঁচ বছরের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকারের অনুদানে আসামের গোয়ালপাড়ায় তৈরি হয়েছে এশিয়ার বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্প,যেখানে নির্বিচারে আটকে রাখা হচ্ছে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে রাজ্যের বাঙালিদেরকে।

তাঁর কথায়, আসামে বিদেশি শনাক্তকরণের জন্য ২০১৩ সালে শুরু হল ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন সংক্ষেপে এন আর সি প্রক্রিয়া। রাজ্যের বাঙালিরা প্রচুর কষ্ট করে, আর্থিক মানসিক ক্ষতি স্বীকার করে সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নিলেন বিদেশি তকমা ঘোচানোর জন্য। কিন্তু চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশের পর শনাক্ত বিদেশির সংখ্যা নগণ্য হওয়ায় সেই প্রক্রিয়াকে মাঝপথে আটকে দেওয়া হল। সরকারি কোষাগারের ব্যয় হল ১৬০০ কোটি, যার অর্ধেক তৎকালীন এন আর সি সমন্বয়কর্তা প্রতীক হাজেলা নয়ছয় করে মধ্যপ্রদেশে বদলি নিয়ে চলে গেছেন বলে অভিযোগ। এখন ১৯ লক্ষ বাঙালির নাগরিকত্ব ঝুলন্ত। এদের আধার কার্ড আটকে রাখা হয়েছে৷ সে জন্য সরকারি কোনও অনুদান, সরকারি চাকরি ইত্যাদি থেকে তারা বঞ্চিত৷ আগামীতে ভোট দিতে পারবেন কিনা তাও অনিশ্চিত।

দত্তরায় বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের গাজর দেখিয়ে আবার আসামের নিপীড়িত বাঙালি হিন্দুদের ভোট হাসিল করল বিজেপি সরকার। কিন্তু সংসদের উভয় কক্ষে মান্যতা সহ রাষ্ট্রপতির অনুমোদন এবং প্রধানমন্ত্রীর বারবার প্রতিশ্রুতির পরও সেই বিলের বাস্তবায়ন হল না । দেশভাগের শিকার ডি সমস্যায় জর্জরিত আসামের বাঙালির শেষ ভরসা এভাবেই তামাদি হল।

আসামে সরকারি চাকরিতে বাঙালিরা অপাংক্তেয় বলে উল্লেখ করে তিনি আক্ষেপ ব্যক্ত করেন, নিম্নবর্গের পদে শেষ এক লক্ষ নিয়োগে জনসংখ্যার অনুপাতে যেখানে অন্তত ১৫০০০ বাঙালির চাকরি হওয়ার কথা, সরকারি পক্ষপাতের শিকার হয়ে সেখানে একহাজার বাঙালিরও চাকরি জোটেনি।

তাঁর কথায়, প্রায় ৪২ লক্ষ জনসংখ্যার বরাক উপত্যকার ৮৫ শতাংশই বঙ্গভাষী। তাই ‘কাছাড় ইজ এ ক্যান্সার অফ আসাম’ এই কথাটি বারবার ব্যক্ত হয়েছে অসমিয়া বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয়তাবাদীদের বয়ানে। গুয়াহাটিতে উড়ালসেতুর সংখ্যা ২২ হলেও আজ অব্দি শিলচরের ভাগ্যে একখানাও জোটেনি, ফলে সীমাহীন যানজটই নিত্যসঙ্গী। নালা নর্দমা মান্ধাতা আমলের। গত বছরের ভয়াবহ বন্যায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ। বরাক উপত্যকায় পাচঁগ্রাম কাগজকল, চিনিকল সহ যেসব বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল সরকারি অবহেলায় সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সংস্কার ও সরকারি উদ্যোগের অভাবে এখানকার চা শিল্প ধুঁকছে। নেই কোনও স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ। এখানে রেজিস্ট্রিকৃত বেকারের সংখ্যা পাঁচ লক্ষের কাছাকাছি। শিক্ষিতের মধ্যে যাদের সঙ্গতি রয়েছে তাঁরা জীবিকার খোঁজে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে, যাদের তা নেই তাঁরা মাস্টার্স করেও ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে ই-রিকশা কিনে দিন‌ কাটাচ্ছে। নীতি আয়োগ দ্বারা প্রকাশিত ২০২৩ এর বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক অনুযায়ী বরাক উপত্যকার স্থান আসামের মধ্যে সর্বনিম্ন ৩১.৪২ শতাংশ বলে জানিয়েছেন প্রদীপবাবু।

নির্বাচনী কেন্দ্র পুনর্বিন্যাস বা ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়া নিয়েও তিনি ক্ষোভ ব্যক্ত করেন৷ বলেন,  ২০০৮ সালে সারা দেশে ডিলিমিটেশন হয় ‘ডিলিমিটেশন কমিশনে’র মাধ্যমে। যেহেতু তখন আসামে এন আর সি প্রক্রিয়া শুরু হবার কথা ছিল, তাই আসামকে এই প্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখা হয়। হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে গত জুন মাসে আসামে নির্বাচন আয়োগের অধীনে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ডিলিমিটেশন কমিশনের মতো পরিকাঠামো না থাকায় নির্বাচন আয়োগকে এই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সমীক্ষা ও পরামর্শের উপর ভিত্তি করতে হয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সমষ্টিগুলিকে যথেচ্ছ কাটাছেঁড়া করে চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয় এবং তাঁতে রাষ্ট্রপতির শিলমোহরও নিয়ে নেওয়া হয়। আসাম চুক্তি বা এন আর সি যা করতে পারেনি ডিলিমিটেশনের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামের ভূমিপুত্রদের সেই অধিকার সুরক্ষিত হবে – এটা ছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য। বলা বাহুল্য এই ভুমিপুত্রের সংজ্ঞায় বাঙালিদের স্থান নেই। ডিলিমিটেশন করে ৪২ লক্ষ জনসংখ্যার বরাক উপত্যকার বিধানসভা আসন সংখ্যা ১৫ থেকে কমিয়ে ১৩ করা হল, ২৪ লক্ষ জনসংখ্যার বড়োল্যান্ডের আসন ১২ থেকে বাড়িয়ে ১৫ করা হল। শিলচর লোকসভা আসন সংরক্ষিত হল। বরাক বাসী তথা বাঙালিদের সীমিত রাজনৈতিক কন্ঠকে রোধ করার জন্যই এই চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেন বিডিএফ নেতা।

এর পরই তাঁর সোজাসাপ্টা বক্তব্য, “আমরা মনে করি, এই পরিস্থিতিতে আমাদের আর আসামের সঙ্গে থাকার কোনও অর্থ হয় না। তাই ডিলিমিটেশন করে যে অপমান করা হয়েছে বরাকবাসীকে, তাঁর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বরাক পৃথকীকরণের ডাক দিয়েছি। বরাকের ৪২ লক্ষ জনগণের জন্য ১৩ নয়, আমাদের ৬০ আসন বিশিষ্ট স্বতন্ত্র বিধানসভা চাই। বরাকের সমস্ত জনগোষ্ঠী থেকে আমরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি।”

দত্তরায় কলকাতার সাংবাদিকদের এও স্পষ্ট করে দেন যে, “বরাক উপত্যকা পৃথকীকরণের  দাবি কোনও অর্থেই বাঙালি রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি নয়। বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও এখানে রয়েছেন চা জনজাতি, ডিমাসা, মণিপুরি, বিষ্ণুপ্রিয়া,খাসি, কুকি সহ বহু জনগোষ্ঠী৷ তাদের প্রত্যেকেই আর্থ-সামাজিক ভাবে বঞ্চনার শিকার। আমাদের এই প্রস্তাবিত রাজ্য হবে প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকার সহ কৃষ্টি সংস্কৃতি ও সমউন্নয়ন সুনিশ্চিত করার অন্যতম উদ্যোগ।”

তিনি দাবি করেন, বরাক উপত্যকায় প্রাকৃতিক এবং মানবসম্পদের অভাব নেই। রয়েছে ১২৫টি চা বাগান। কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী সাম্প্রতিক সফরে বলে গিয়েছেন, বরাক উপত্যকা প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর ভাসছে। এই অফুরন্ত ভাণ্ডারের সদব্যবহার হলে স্থানীয় শিল্প ও কর্মসংস্থানে যেমন জোয়ার আসবে, তেমনি পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ, মায়ানমার ইত্যাদি দেশে রফতানির পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির প্রয়োগের জন্য অন্যতম সুবিধাজনক ভৌগলিক অবস্থানে রয়েছে এই ভূখণ্ড। যথাযথ সরকারি উদ্যোগ থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে উত্তর পূর্বের কেন্দ্রস্থল হবে বরাক উপত্যকা। এ সবের পরিপূর্ণ বিকাশ একমাত্র আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের মাধ্যমেই সম্ভব হতে পারে।

বরাক ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জয়দীপ ভট্টাচার্য, হৃষীকেশ দে, কল্পার্ণব গুপ্ত প্রমুখ৷

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker