Barak UpdatesBreaking News
একটু এদিক-সেদিক হলে মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়াত, লিখেছেন প্রত্যক্ষদর্শী সজল দাসHorrid description of the ‘killer truck’ in action, writes an eyewitness Sajal Das
১ নভেম্বরঃ আমাদের পুজো হাইলাকান্দি রোড থেকে একটু ভেতরে হলেও খুব আনন্দ হয়। যেমন নিষ্ঠা সহকারে মাতৃ আরাধনা, তেমনি চলে নানা অনুষ্ঠান। দুর্গাপল্লীর সমস্ত মানুষ তাতে সামিল হন। বিভিন্ন বয়সের পুরুষ-মহিলা সবাই আনন্দ করেন। এ বারও ওই ধারাতেই এগোচ্ছিল।
কিন্তু ছন্দপতন ঘটল বুধবার রাতে। তখন আটটা বাজে। প্রতিমা নিয়ে আমরা শোভাযাত্রা করে যাচ্ছিলাম শিলচর বিসর্জনঘাটে। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই আমরা চলছিলাম। সামনে প্রতিমা। পরে জেনারেটর। সবশেষে ৪০৭ মডেলের লরিতে সাউন্ড সিস্টেম। এর ঠিক পেছনে পাড়ার মানুষ। গান বাজছিল, ছেলেমেয়েরা নাচছিল।
বীরবল বাজার পেরিয়ে ফ্লাওয়ার মিলের সামনে এলে আমি ঠাণ্ডা জলের বোতল সঙ্গে রাখার কথা ভেবে দোকানে যাই। হঠাত করে একটা শব্দ কানে এল। পেছনে তাকিয়ে দেখি, বিশাল এক লরি বিপরীত দিক থেকে এসে আমাদের সাউন্ড সিস্টেমের গাড়িটিকে ধাক্কা মারে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি, গাড়িটি সোজা শোভাযাত্রার ওপর দিয়ে ডানদিকে ঢুকে পড়ছে। হইচই শুরু হয়ে যায়। আরে কী হচ্ছে, কী হচ্ছে ! দৌড়ে যাই।
সামনে যেতেই দেখি, স্টিয়ারিংয়ে বসা যুবকটি দ্রুত দরজা খুলে লাফাতে চাইছে। প্রথমে তাকে গিয়ে ধরি। একদিকে তাকে আটকে রাখা, অন্যদিকে চাকার নীচ থেকে আর্তনাদ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা আমার। এরই মধ্যে আরেক যুবককে বের করা হয়েছে গাড়ির ভেতর থেকে। এরাই চালক-খালাসি। পরে জানলাম, খালাসির হাতেই স্টিয়ারিং ছিল। যুবকরা তাদের মারতে উদ্যত হয়।
তখনই বোলেরোতে চেপে এসে একদল পুলিশ ছুঁ মেরে দুইজনকে নিয়ে যায়। মনে হয়, গাড়িটির পেছনে পেছনেই আসছিল তারা। মুহূর্তে বোলেরোটি ঘটনাস্থল থেকে উধাও হয়ে পড়ে। তখনও কেউ চাকার নীচে, কেউ ধাক্কা খেয়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা পাথরের উপর কাতরাচ্ছে। পম্পা আর প্রিয়া (সোনালি ডাকনাম) সাউন্ড সিস্টেমের একেবারে শুরুতে থাকায় তারা মাথায় প্রচণ্ড চোট পায়। মেডিক্যাল লাইনই আমার পেশা। তাদের শিরা ধরেই বুঝে যাই, বেঁচে নেই এরা। তাই অন্যদের বাঁচানোর কথাই মাথায় আসে। গাড়ির তলায় আটকে পড়াদের নানা কৌশলে বের করা হয়। অনেকে উদ্ধারকাজে হাত লাগান।
আমি পাড়ার এক বৌকে টেনে হিচড়ে বের করে দেখি, হিঁচকি শুরু হয়ে গিয়েছে। উর্ধ্বশ্বাস টানছে। কোলে তুলে দৌড় দিই রাস্তার দিকে। একটি গাড়ি যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল, স্বেচ্ছায় এগিয়ে গিয়ে আমাদের তুলল। যাত্রীদের নামিয়ে দিল। মেডিক্যালের সামনে পৌঁছতেই সমস্যা বেড়ে গেল, হিঁচকি বন্ধ, উর্ধ্বশ্বাসও নেই। কী হল ! বুকে জোরে চাপ দিই। দেখি, শ্বাস ফেলেছে সে। হাসপাতালে যেতেই অবশ্য চিকিতসা শুরু হয়ে যায়। পেছনে একে একে অনেককে আনা হল। কেউ পা নাড়াতে পারেন না, কেউ কোমর সোজা করতে পারছেন না। কারও হাত ঝুলে রয়েছে, কারও বা সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে। ভাগ্যিস, লরিটা সাউন্ড সিস্টেমের গাড়িতে প্রথম ধাক্কাটা মেরেছিল। ঠিক ওই সময় আমাদের গাড়িটি সেখানে না থাকলে কী যে ঘটত! পোস্তবোঝাই লরি সোজা শোভাযাত্রার ভেতরে ঢুকে পড়লে মৃতের সংখ্যা ৫০ ছাড়াত !
বুধবার রাতের দৃশ্য এখনও চোখের সামনে থেকে সরাতে পারছি না। তাদের কথা ভাবতে না চাইলেও দেখি, পম্পি-প্রিয়া মৃত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। প্রতি মুহূর্তে শুনতে পাই জখমদের কাতরানোর শব্দ। তবে এই দুর্ঘটনা বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে।
প্রথমত, পুলিশের বোলেরোটি পোস্ত বোঝাই লরির ঠিক পেছনে পেছনে কেন যাচ্ছিল? কারও নির্দেশে এরা কি লরিটিকে এসকর্ট করছিল? নইলে বোলেরো নিয়ে পুলিশ লরিটিকে তাড়া করেছিল, এমন কথা তো এ পর্যন্ত কোনও পুলিশ কর্তা দাবি করেননি। আউলিয়াবাজারে দুর্ঘটনা করে আসার যে কথা বলা হচ্ছে, সেখান থেকে গাড়িটি তাড়া খেয়ে রাঙ্গিরখাড়ি আউটপোস্টের সামনে দিয়ে নো এন্ট্রি ভেঙে ফ্লাওয়ার মিল পর্যন্ত চলে গেল, পুলিশ তাদের ধরতে পারল না, আর সেখানে চালক-খালাসি ধরা পড়তেই তারা পৌঁছে গেলেন!
দ্বিতীয়ত, রাঙ্গিরখাড়িতে সাধারণ গাড়িরই বাঁক নিতে অনেক সময় লাগে। ১৮ চাকার গাড়ির তো দ্রুত গতিতে বাঁক নেওয়া একেবারে অসম্ভব। অবশ্যই ওই জায়গায় গতি কমিয়েছে, তখন ধরা হল না কেন?
তৃতীয়ত, ফ্লাওয়ার মিলে দুর্ঘটনার পরপরই আউলিয়াবাজারে দুর্ঘটনা করে আসার গল্প ছড়িয়ে পড়ে। তাহলে স্পষ্ট, প্রথম দুর্ঘটনার কথা পুলিশ আগে থেকেই জানত। সে ক্ষেত্রে কি রাঙ্গিরখাড়ি আউটপোস্টকে গাড়ির নম্বর দিয়ে আটকানোর ব্যবস্থা করতে নির্দেশ পাঠানো হয়েছিল? হয়ে থাকলে কী করে এত পথ এগোল লরিটি? রাঙ্গিরখাড়ি পেরনোর পর কি ঘুংঘুর আউটপোস্টকে জানানো হয়েছিল? হলে এরা এলো না কেন?
চতুর্থত, পুলিশের গাড়িটি চালক-খালাসিকে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে গেল! অথচ তখন চাকার নীচে পিষ্ট অবস্থায় পড়েছেন বেশ কিছু মানুষ। দুইজনকে মারের হাত থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি কি দুর্ঘটনার শিকার মানুষদের উদ্ধারের প্রয়োজন ছিল না?
পঞ্চমত, পোস্ত নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু পুলিশ কর্তারা নীরব কেন? চালক-খালাসি যেহেতু তাদের জিন্মায় ছিল সারা রাত, ওই পোস্ত নিয়ে কী বলল তারা? কোথা থেকে এসেছিল, কোথায় যেত? কারা মাল তুলে দিয়েছে? কাদের বুঝে রাখার কথা ছিল?
ষষ্ঠত, প্রশাসন যখন আমাদের লিখিত অনুমতি দিয়েছে, তখন নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা কি তাদের দায়িত্ব নয়?
এ সব প্রশ্নের উত্তর কোনওদিন মিলবে কি না কে জানে !