Barak UpdatesAnalyticsBreaking News
দীপক ভট্টাচার্য: এক ব্যতিক্রমী ধারার রাজনীতিবিদ, লিখছেন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদারDipak Bhattacharjee: A politician of exceptional genre, writes Subha Prasad Nandi Majumdar
রাজনীতির আকাশে নেতারা উদিত হন। নির্বাপিতও হন। কেউ জীবনাবসানের আগেই রাজনৈতিক মৃত্যুপ্রাপ্ত হন। আবার ক্ষমতার শীর্ষাসনে থাকার সময়েই কারো জীবনাবসান হলে জনসমাজে সাড়ম্বরে শোক পালিত হয়। রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে এই যে সাধারণ হিসেব নিকেশ, তা থেকে বহু দূরে ছিলেন দীপক ভট্টাচার্য।
একসময়ে বিধায়ক ছিলেন, দলের জেলা সম্পাদক ছিলেন। যে দল করেছেন আমৃত্যু সেই দলের জনসমর্থন বিগত কয়েক দশকে এই অঞ্চলে অনেকটাই কমে গেছে। কমেছে সাংগঠনিক শক্তিও। কিন্তু রাজনীতিবিদ দীপক ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা কমে নি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখযোগ্য ভাবে। কেউ কেউ দীপক ভট্টাচার্যের এই জনপ্রিয়তাকে তাঁর রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখতে চাইছেন। বলা বাহুল্য, এই মূল্যায়ন যথার্থ নয়। কারণ ব্যক্তি দীপক ভট্টাচার্য কখনোই নিজেকে রাজনীতির উর্ধে স্থাপন করার চেষ্টা করেন নি। মানুষও তাঁকে রাজনীতির মানুষ হিসেবে ভালোবেসেছে।
তাঁর প্রতি মানুষের এই দুর্নিবার ভালোবাসার এটাই কারণ যে তিনি আজকের দিনের রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। অর্থাৎ তাঁর ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক চরিত্রই তাঁকে মানুষের ভালোবাসার জন করেছে। এছাড়া আরেকটি কারণেও বলব দীপক ভট্টাচার্যের মধ্যে কোনো অরাজনীতি নেই। এমনটা অনেক সময়েই হয়েছে যে কোনো একটি আঞ্চলিক বা জাতীয় রাজনৈতিক প্রশ্নে তাঁর ব্যক্তিগত বা দলীয় অবস্থান জনসাধারণ্যে ততটা মান্যতা পাচ্ছে না, তা সত্ত্বেও দীপক ভট্টাচার্য ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কথা হিসেব করে নীরব থাকার কৌশল নেন নি। খবরের কাগজে চিঠিপত্রের কলামেই হোক বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতাতেই হোক, তিনি স্পষ্ট ভাষায় নিজের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন। জনস্রোতের বিপক্ষে এভাবে জোরালো ভাবে দাঁড়িয়েও তিনি জনপ্রিয়তা হারান নি। বরং তিনি সাধারণের কাছে একই ভালোবাসার মানুষ থেকে গেছেন।
এখানেই ব্যক্তি দীপক ভট্টাচার্য ও রাজনীতিবিদ দীপক ভট্টাচার্য অনন্য। এখানেই প্রশ্ন আসে সততার। তাঁর নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের সম্পর্কে মানুষ এতটাই শ্রদ্ধাশীল যে তারা জানত দীপক ভট্টাচার্যের এই স্বতন্ত্র অবস্থান কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থচিন্তার দ্বারা প্রভাবিত নয়। বৃহত্তর জনসমাজের সার্বিক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা থেকেই তিনি তাঁর বিশ্বাসকে, তাঁর ভিন্নমতকে তুলে ধরেছেন। সহমত হতে না পারার নেপথ্যে কোনো স্বার্থ চিন্তা নেই। এইব্যক্তিগত নিষ্কলুষ রাজনৈতিক চরিত্রের জন্যেই তিনি সকলের এত ভালোবাসার, এতটা শ্রদ্ধার।
দীপক ভট্টাচার্যের গানবাজনার প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ছিল। আর দশটা রাজনৈতিক নেতা যেমন তাঁর রাজনীতির কর্ম কৌশলের বাধ্যতা থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আসেন, এসে গান নাটক নৃত্যের আনন্দ পাওয়ার চেয়ে জনসংযোগের তৃপ্তি পান বেশি। কিন্তু ওনার ব্যাপারটা অনেকটাই আলাদা।। সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অনুরাগ, সংস্কৃতির ভেতর ঘরের মানুষের মতই অকৃত্রিম ও আন্তরিক। সেজন্যেই দীপক ভট্টাচার্য দর্শকাসনে বসে আছেন দেখলে শিলচরের গায়ক অভিনেতা নৃত্যশিল্পীরা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করতেন। এই অনুপ্রেরণা এখনকার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সর্বত্র ঝোলানো ফেস্টুনে শোভিত রাজনৈতিক ক্ষমতার অনুপ্রেরণার আস্ফালন নয়।
রাজনৈতিক মতভিন্নতা সত্বেও দীপক ভট্টাচার্য কোনও বিরোধী মতের নেতা বা সাধারণ কর্মীর সাথে শত্রুতামূলক আচরণ করেছেন এমন অসত্য কথা কেউ বলতে পারবে না। ঠিক এই কারণেই হয়ত তাঁর রাজনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা কবীন্দ্র পুরকায়স্থ বলতে পারেন, অজাতশত্রু ছিলেন দীপক বাবু। বলা বাহুল্য, এই কথাটি কবীন্দ্র বাবুর রাজনৈতিক বিবৃতি নয়। একান্ত মনের সত্য অনুভব। এটাই অন্য রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরোধী আছে, কিন্তু শত্রু নেই। এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠে নি আমরা জানি।
সাধারণভাবে বিচার করলে দীপক ভট্টাচার্যের এই অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তার গভীরে গেলে একটি অন্তর্নিহিত বার্তা খুঁজে পাওয়া যাবে। তাঁর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষ আসলে এটাই জানান দেয় যে কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি তারা দেখতে চান। রাষ্ট্র পেশীশক্তি ও অর্থশক্তির পরাক্রমের মুখে দাঁড়িয়ে তারা হয়ত নিজেদের পছন্দ অপছন্দকে দ্বিধাহীন কন্ঠে জানান দিতে পারে না। কিন্তু যখন কোনো ব্যক্তিনেতার মধ্যে তাদের স্বপ্নের ছবি দেখতে পায়, তখন সেই মানুষটিকে উজাড় করে ভালোবাসায় নন্দিত করে সাধারণ মানুষ এক ধরনের বার্তা পাঠায় রাজনৈতিক সমাজের কাছে। এই সামূহিক ভালোবাসা আসলে এক ধরনের জনাদেশ।