NE UpdatesBarak UpdatesAnalytics
সরকারি স্কুলের খারাপ ফলাফলে কি শিক্ষক দায়ী ! নাকি শিক্ষা ব্যবস্থা, লিখেছেন দেবযানী চৌধুরী
Are the teachers or the system responsible for poor performance of students of govt schools, writes Debjani Choudhury
১৭ জুন : মাধ্যমিকে সরকারি স্কুলের হতাশাজনক ফলাফলের পর সবার অভিযোগের আঙ্গুল শুধু শিক্ষকদের দিকে। শিক্ষকরা ফাঁকিবাজ। দায়িত্ব পালন না করে তারা প্রতিমাসে বড় অংকের বেতন গুনেন। শিক্ষকরা যদি তাদের ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলে পড়াতেন, তাহলে তারা ঠিকমত শিক্ষাদান করতেন। তখন সরকারি স্কুলের রেজাল্ট স্বাভাবিকভাবেই ভাল হতো। তাই অনেকে সরকারি শিক্ষকদের ছেলেমেয়েকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করানোর নিদান দিয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকতার চাকরি এখন আর সম্মানজনক পেশা নয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি অতিরিক্ত জাতীয় সব দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে যে বেতনটুকু তারা পাচ্ছেন, সেটা পাওয়ার অধিকারও যেন তাদের নেই। এমনই হাবভাব এখন রাজ্যের সাধারন জনতা থেকে নেতামন্ত্রী মশাইদের।
ফাঁকিবাজ সব যুগে ছিল, সব বিভাগে আছে। এই সময়েও আছে। তাই বলে সব শিক্ষকদের এভাবে অসম্মানিত করাটা কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? যারা এভাবে শিক্ষকদের নিয়ে অপমানজনক মন্তব্য করছেন, তাদের সন্তানরা, তাদের ছোট্ট ভাই-বোনরা কি শিখছে তাদের কাছ থেকে? তারা কি জানবে শিক্ষকদের সম্মান দিতে, শ্রদ্ধা করতে? তারা তো শিক্ষকদের আদেশ-নির্দেশ পালন করারও প্রয়োজনীয়তাটুকু মনে করবে না। করবেই বা কী করে? তারা তো অবিরত শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞাসূচক কথা শুনেই বড় হচ্ছে । যারা সবকিছুতেই সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দোষী ঠাওরান, তারা এখন অব্দি সরকারি শিক্ষাক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা কোথায়, সেটিই জানেন না। সামাজিক মাধ্যমে, বৈঠকখানায় শুধু এরা বিপ্লবী, সমাজসেবী, রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিজ্ঞ। সমালোচনা আর বিতর্ক না জুড়ে বসে এরা যদি সরকারি স্কুলগুলির হালহকিকৎ জানার চেষ্টা করতেন, সরকারের কাছে সমস্যার জায়গাগুলো তুলে ধরতেন, তাহলে এতদিনে হয়ত সরকারি শিক্ষার ছবি অনেকটা বদলে যেত। ———সমস্যার গোড়ার কথা জানতে হলে সরকারি স্কুলের অন্তর্তদন্ত প্রয়োজন। তাহলে এই ঈশানকোনের গ্রাম-কাছাড়ের একটি সরকারি স্কুলের অন্দরমহলের ছবি দেখা যাক।
ভারত-বাংলা সীমান্তের কাটিগড়া বিধানসভা কেন্দ্রের জালালপুরের বলেশ্বর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ওই সীমান্ত এলাকার এটি একমাত্র উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিশাল ওই অঞ্চলে সরকারি এলপি, আর এমই স্কুল থাকলেও মাধ্যমিক আর উচ্চতর মাধ্যমিক পড়ার সুযোগ শুধু এই স্কুলেই । ১৯৫৭ সালে স্থাপিত স্কুলটির প্রাদেশিকীকরন হয় ১৯৮৫ সালে। বর্তমানে ছাত্রসংখ্যা ১৬৫৩ জন। ১৯৮৫ থেকে ২০২২ সাল অব্দি স্কুলটির ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আর ক্লাসরুমের সংখ্যার একটি ছবি তুলে ধরা যাক। ১৯৮৫ সালে স্কুলটি যখন প্রাদেশিকীকরন হয়, তখন স্কুলটির জন্য মঞ্জুরীকৃত শিক্ষক-কর্মচারীর স্থায়ী পোস্টের সংখ্যাটি ছিল এরকম– ১ জন অধ্যক্ষ , ১ জন উপাধ্যক্ষ, এসিস্ট্যান্ট টিচার ১১ জন, ইলেকটিভ সাব্জেক্ট — সংস্কৃত টিচার ১জন, হিন্দি টিচার ১ জন, অসমিয়া টিচার ১জন, আরবি টিচার ১ জন, মিউজিক টিচার ১ জন এবং ৯ জন বিষয় শিক্ষক-শিক্ষিকা। অফিস কর্মচারীদের মধ্যে ইউ ডি এ-১জন, এলডিএ- ১জন, গ্রেড ফোর কর্মী ২ জন। যদিও ওই সময় স্কুলটিতে শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ছিল ১৭ জন বিপরীতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৬২০ জন। অনুপাত হিসেবে তখন ৩৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ছিল ১ জন শিক্ষক। RTE Act ২০০৯ অনুযায়ী নিম্ন প্রাথমিক স্কুলে অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেনী অব্দি ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হবে ৩০ জনে ১জন শিক্ষক, উচ্চ প্রাথমিক অর্থ্যাৎ ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেনী অব্দি ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হবে ৩৫ : ১, মাধ্যমিক অর্থ্যাৎ নবম- দশম শ্রেনীতে হবে ৪০ : ১ আর উচ্চতর মাধ্যমিক অর্থ্যাৎ একাদশ -দ্বাদশ শ্রেনীতে হবে ৬০ : ১ জন। ১৯৮৫ থেকে ২০২২ সাল, বহমান এই সময় জুড়ে স্কুলটিতে ছাত্রছাত্রী সংখ্যা ৬২০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬৫৩ জনে।
বর্তমান হিসেবে ক্লাস সিক্স থেকে টেন অব্দি প্রতিটি ক্লাসে গড় হিসেবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫০ জন, যদিও ক্লাস নাইনে সংখ্যাটা একটু বেশি ২৮৯ জন। ক্লাস টুয়েলভে ২৪৬ জন, আর ক্লাস ইলেভেনের ১০০ জনের ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। ১৯৮৫ থেকে আজ অব্দি ক্লাসরুমের সংখ্যার হিসেবে বেড়েছে মাত্র দু চারটি রুম। যদি শ্রেনীকক্ষের হিসেব করতে হয়, তাহলে চল্লিশ জন ছাত্রের জন্য একটি ক্লাসরুমের দরকার, সেই হিসেবে ৪০টা শ্রেনীকক্ষের প্রয়োজন বর্তমান সময়ে এই স্কুলে । কিন্তু ক্লাসরুম আছে মাত্র ১২টি। ছাত্রসংখ্যা বাড়লেও মঞ্জুরীকৃত শিক্ষকপদের সংখ্যা রয়ে গেছে সেই একই। তাও ওসব পদের কয়েকটিতে বর্তমানে শিক্ষক নেই। উপাধ্যক্ষের পদ শূন্য। হিন্দি, অসমিয়া, আরবি, সংস্কৃত বিষয়ের শিক্ষক নেই। গ্রেড ফোর কর্মী রয়েছেন একজন, দুটো কেরানী পদই শূন্য। এসিস্ট্যান্ট টিচার রয়েছেন ৯ জন, কন্ট্রাকচুয়াল টিচার ২জন, আই টি( I T) টিচার ১ জন আর কম্পিউটার টিচার রয়েছেন ১জন। নতুন শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে রিটেল (Retail) বিষয়ের ১জন শিক্ষক নিযুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এখানে একটি লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, নবম – দশম শ্রেনীতে ইলেকটিভ প্রায় সব বিষয়ের পদ শূন্য। আইটি বিষয়টি সব স্কুলে থাকে না। যেসব স্কুলে আছে, সেখানে শুধুমাত্র ২০-২৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী বিষয়টি ইলেকটিভ হিসেবে নির্বাচন করতে পারে না। কারন এই বিষয়ে প্র্যাকটিকাল থাকে বেশি। স্কুলগুলিতে সীমিত সংখ্যক কম্পিউটার থাকে, তাও এর বেশিরভাগ মেরামতির অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। রিটেল এবং আই টি বিষয়টি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেনী অব্দি পড়ানো হবে। রিটেল বিষয়টি একদমই নতুন। এবার থেকে চালু হলো। কম্পিউটার বিষয়টি শুধু নবম আর দশম শ্রেনীর জন্যই। স্বাভাবিকভাবেই আই টি, কম্পিউটার আর রিটেল বিষয়টি মাত্র ২৫০-৩০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৫/৩০ জন পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বাকি ছাত্রছাত্রীরা কোন শিক্ষক ছাড়াই ইলেকটিভ বিষয়ের পরীক্ষা দিচ্ছে।
বর্তমানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট টিচার রয়েছেন ৮ জন। এরমধ্যে অংক ১ জন, ইংলিশ আর অলটারনেটিভ ইংলিশ ২জন, বাংলা ১ জন, ইতিহাস ১ জন, রাজনীতি বিজ্ঞান ১ জন, এডভান্স বাংলার পদ শূন্য। টেট থেকে সদ্য নিযুক্তি পেয়েছেন অর্থনীতিতে ১ জন, আর একাউন্টসে ১জন। তবে স্কুলটিতে যেহেতু শুধুমাত্র আর্টস বিভাগই আছে। একাউন্টস বিষয়টিই নেই স্কুলটিতে। তাই এ পদে নিযুক্তি দেবার কারন বোঝা যায় নি। হয়তবা নতুন শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে এই পদে নিযুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, হাই আর হায়ার সেকেন্ডারি মিলিয়ে বর্তমানে শিক্ষক সংখ্যা ২২জন। গড় অনুপাত হিসেব করলে দেখা যাবে ৭৬ জনে ১জন শিক্ষক রয়েছেন।
কিন্তু সরকারি নিয়ম অনুযায়ী স্কুলটিতে এই মুহূর্তে দরকার কতজন শিক্ষকের? আর কতটিই বা ক্লাসরুমের প্রয়োজন? সেটার হিসেব দেখা যাক।ক্লাস সিক্সে ২৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য প্রতি ক্লাসে ৩৫জন ছাত্রের হিসেবে দরকার ৭ টি ক্লাসরুম, পিরিয়ড হিসেবে ক্লাস টিচার দরকার ৭ জন, এডিশনাল টিচার ২জন, একই হিসাব ক্লাস সেভেন আর এইটের ক্ষেত্রে। নবম শ্রেনীতে ২৯০/৩০০ জন ছাত্রের জন্য প্রতি ক্লাসে ৪০ জন হিসেবে ক্লাসরুম দরকার ৭/৮ টি , ক্লাস টিচার ৭/৮ জন, সঙ্গে এডিশনাল টিচার ৩ জন, ক্লাস টেনে ২৫০ জন ছাত্রের জন্য ৬ টি ক্লাসরুম, ক্লাস টিচার ৬ জন, এডিশনাল টিচার ২জন দরকার। এরসঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে অষ্টম শ্রেনী অব্দি বিজ্ঞান শিক্ষক ৪ জন, হিন্দি শিক্ষক ৪ জন দরকার। নবম আর দশম শ্রেনীর জন্য বিজ্ঞান শিক্ষক ৬ জন, হিন্দি শিক্ষক ৩ জন, অসমিয়া শিক্ষক ৩ জন, সঙ্গে আরবি এবং সংস্কৃত , মিউজিক বিষয়েরও শিক্ষক দরকার। তাহলে সবমিলিয়ে শুধুমাত্র মাধ্যমিক স্তর অব্দিই স্কুলটিতে প্রয়োজন ৭০ থেকে ৭৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার। কিন্তু সেখানে রয়েছেন সবমিলিয়ে মাত্র ২১ জন।
ক্লাস ইলেভেনে ছাত্রভর্তি সংখ্যা প্রতি বছর পরিবর্তন হয়, এবছর মাধ্যমিকে উত্তীর্নের সংখ্যা কম, তাই ১০০ জনের ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে । কিন্তু দ্বাদশ শ্রেনীতে এবারের ছাত্রসংখ্যা ২৪৬ জন। ৬০ জন হিসেবে ক্লাসরুম বিভাগ করতে হলে দুটো ক্লাস মিলিয়ে ৫/৬ টি ক্লাস রুমের দরকার। বিষয় শিক্ষকের সংখ্যা তো আগেই বলেছি। ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে দ্বাদশ শ্রেনি অব্দি ক্লাসরুমের সংখ্যা হওয়া উচিত ছিল কম-বেশি ৪০ টির। সেখানে ক্লাসরুমের সংখ্যা মাত্র ১২ টি। তাই স্বাভাবিকভাবেই এক ক্লাসে ২০০/২৫০ জন ছাত্রছাত্রীকে গুঁজে দিতে হচ্ছে। এক বেঞ্চে ছাত্র বসছে ৭/৮ জন। ডেস্কও ঠিকমত নেই। পুরো এলাকায় একটি মাত্র উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুল। বাকি যে তিন চারটি সরকারি স্কুল আছে ওই অঞ্চলে, ওগুলো হয় এলপি, নয়ত এমই স্কুল। মাধ্যমিক আর উচ্চতর মাধ্যমিকে পড়তে হলে একমাত্র ওই স্কুলটিতে ভর্তি হতেই হয়। তাই ছাত্রসংখ্যা বাড়বেই। কিন্তু সরকার স্থায়ী বা অস্থায়ী কোন শিক্ষকপদের সংখ্যা বাড়ানোর কথা ভাবেননি। মঞ্জুরীকৃত যে শিক্ষকপদ নিয়ে স্কুলটি প্রাদেশিকীকরন হয়েছিল, সেটা নিয়ে আজও চলছে। তাও বর্তমানে ওই পদগুলোরও কয়েকটি শূন্য পড়ে আছে।
এই যখন অধিকাংশ গ্রামীন স্কুলের ছবি , তখন সরকারি হিসেব কিন্তু অন্যকথা বলছে। ২০২১ সালের ২ আগস্ট কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান লোকসভায় যে হিসেব তুলে ধরেন, সেই হিসেবে কিন্তু ছাত্র- শিক্ষক অনুপাতে সামঞ্জস্য তো আছেই। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তো ছাত্র অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। সরকারি নথিতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি প্রাইমারি স্কুলে ২৪ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক, আপার প্রাইমারি সেকশনে ১৭:১, এলিমেন্টারি সেকশনে ২১:১, সেকেন্ডারি সেকশনে ১১:১, হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ১৬ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক রয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, সরকারি হিসেবের সঙ্গে বাস্তবের হিসেব কেন মিলছে না? গ্রাম -গ্রামান্তরের বেশিরভাগ সরকারি স্কুলের ছবিই তো প্রায় একই রকম। তুলনামূলক শহরে অনেক স্কুলের ছবি পুরোপুরি বিপরীত। উদাহরন হিসেবে বলা যেতে পারে, বলেশ্বর স্কুলটির যখন এই ছবি, তখন করিমগঞ্জ জেলার নীলমনি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে টিচার রয়েছেন ৩৭ জন, আর ছাত্র সংখ্যা হলো ১২০ জন। এবারের মাধ্যমিকে সারা আসামে হতাশাজনক ফলাফল প্রকাশের পর রাজ্যের এমন অনেক স্কুলের ছবি প্রকাশ্যে এসেছে । এখানেই রয়েছে ফাঁকটি।
সরকার যখন রাজ্যের স্কুলগুলোর ছাত্র-শিক্ষকের খতিয়ান সংগ্রহ করেন, তখন প্রতি স্কুল ভিত্তিতে হিসেবটা খুঁজে দেখেন না। হয়ত জেলা ভিত্তিতে স্কুলগুলোর খতিয়ান নেন। এতে ছাত্র আছে -শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছে- ছাত্র নেই = সব স্কুলের হিসেব মিলেমিশে একাকার হয়ে যে হিসেবটা প্রকাশ্যে আসে, এতে রাজ্য ভিত্তিতে যে অনুপাতের হিসেব দাঁড়ায়, তা হলো লোকসভা অধিবেশনে তুলে ধরা হিসেব। সরকার যদি প্রতিটি স্কুল ভিত্তিতে হিসেবের খতিয়ান সংগ্রহ করতেন, তাহলে এমন একটা হযবরল ছবি উঠে আসতো না ।
পরিকাঠামো নড়বড়ে থাকলে শিক্ষাসৌধ কি গড়ে তোলা সম্ভব ? কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয়গুলি এন্ট্রান্স পরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ভর্তি করায়। পরীক্ষায় যারা পাশ করে, তারাই শুধু ভর্তি হতে পারে। কিন্তু রাজ্য সরকারের স্কুলগুলোতে এ নীতি-নিয়ম নেই। সবার জন্য শিক্ষা নীতিতে সব ছেলেমেয়েকে স্কুলে ভর্তি করাতে হবে। স্কুলের আসন সংখ্যা কিংবা শিক্ষক সংখ্যা, এখানে কোন গুরুত্ব পায় না। তাছাড়া এখন যে ক্লাস পরীক্ষণ পদ্ধতি, সেটাতেও ফাঁক রয়ে গেছে। ছাত্রের গুণমান যাই হোক, যেভাবেই হোক , অষ্টম শ্রেনী অব্দি ফেল করানো যাবে না। প্রয়োজনে Remedial (প্রতিকারমূলক) ক্লাস নিয়ে পাশ করাতেই হবে সব ছাত্রকে। নবম শ্রেনীর পরীক্ষায় গিয়ে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে বাছাই করে আটকাতে হলে সমস্যা আছে। কারন এদের পুনরায় নবম শ্রেনীতে পড়াতে হলে জায়গা কিভাবে দেওয়া হবে? অষ্টম শ্রেনী থেকে নবম শ্রেনীতে উত্তীর্নের সঙ্গে প্রতি বছর বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এমই স্কুলগুলো থেকে এসে ভর্তি হচ্ছে। তাই নিম্নমেধার ছাত্রছাত্রীকে আটকে একই ক্লাসে রাখতে গেলে সব মিলিয়ে এক জগাখিচুড়ি অবস্থায় পরিনত হবে। তাই ক্লাস সিক্স থেকে বিনা বাধায় ক্লাস টেনে পৌঁছে যাচ্ছে ছেলেমেয়েগুলো।
এরমধ্যে করোনা কালে দুবছরে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা সম্পূর্ন ব্যাহত হয়েছে। পরীক্ষাবিহীন পাশ বা অনলাইনে বই খুলে খাতায় লেখার মানসিকতায় অভ্যস্ত ছাত্রছাত্রীরা মাধ্যমিককে সিরিয়াসলি নিতেই পারেনি। যার প্রভাব পড়েছে মাধ্যমিকের রেজাল্টে। এ বছর উচ্চতর মাধ্যমিকের রেজাল্টেও যে এর প্রভাব পড়বে না, এটারও কোন গ্যারান্টি নেই। এমনকি এ বছর একাদশ শ্রেনী থেকে যারা দ্বাদশ শ্রেনীতে উঠলো, তারা আগামী বছর উচ্চতর মাধ্যমিক পরীক্ষা বসবে। এই ব্যাচটা করোনার জন্য বিনা পরীক্ষায় মাধ্যমিক পাশ করলো। যার দরুন ওই শিক্ষাবর্ষ সেবার ইতিহাসে সেরা পাশের হারের বছর ছিল হয়তো। ফলত বিশাল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী পেয়েছে প্রতিটি স্কুল-কলেজ, বিশেষত গ্রামীন উচ্চতর মাধ্যমিক সরকারি স্কুলগুলো। এই ব্যাচটা একাদশ শ্রেনীর পরীক্ষায় বসলেও কাউন্সিলের সিদ্ধান্তে অনায়াসে দ্বাদশ শ্রেনীতে উঠে গেল।
এমনিতেই প্রতিটি সরকারি উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুল এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি স্কুলে গতবছর ছাত্রভর্তি হয়েছিল দুশ থেকে চারশ অব্দি, সেখানে আসন সংখ্যা, শিক্ষকহীনতা কোন গুরুত্ব পায় নি। এরাই বিনা বাধায় আগামী শিক্ষাবর্ষে হায়ার সেকেন্ডারি ফাইনাল পরীক্ষায় বসবে। তারপর তাদের কাছ থেকে কি আশানুরূপ রেজাল্ট প্রত্যাশা করা যাবে? সরকারি স্কুলে মূলত সাধারন, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই ভর্তি হচ্ছে। অভিভাবকদের পক্ষে বাড়িতে তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি অনেক অভিভাবক তো এনিয়ে সচেতনও নন। তাই মূলত এরা স্কুলের শিক্ষাদানের উপরেই নির্ভর থাকে। এরপর যদি আগামী শিক্ষাবর্ষে হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্টের হার নিম্নমুখী হয়, তখন কিন্তু আঙ্গুল উঠবে সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দিকেই। যেমন উঠছে এবার, যেমন উঠছে সব সময়।
আশা করা যায় আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষানীতি চালু হবে। প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। যার দরুন স্কুলগুলির একত্রীকরন (amalgamation), rationalisation (যৌক্তিকরন) চলছে। এতে হয়ত আগামী দিনে ছাত্র আছে- শিক্ষক নেই, আর শিক্ষক আছে- ছাত্র নেই সমস্যা অনেকটাই কমবে। কিন্তু পরিকাঠামো ব্যবস্থাকে ঢেলে না সাজিয়ে শুধু শিক্ষকদের দোষী সাব্যস্ত করলে লাভ কিছু হবে না। দিল্লি মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের একটা বক্তব্য শুনেছিলাম অনেক আগে। তাঁকে যখন সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলেন, কি করে তিনি দিল্লির সরকারি স্কুলকে জাতীয় স্তরের স্কুল হিসেবে তৈরি করলেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, প্রথম গুরুত্ব তিনি পরিকাঠামো সংস্কারে দিয়েছিলেন। তারপর তিনি স্কুলগুলোর অধ্যক্ষ এবং শিক্ষক- শিক্ষিকাদের বিদেশ পাঠিয়ে ট্রেনিং দিয়েছেন। যার দরুন আজ দিল্লির সরকারি স্কুলগুলো জাতীয় পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার রাজ্যে তো ক্লাস সিলেবাস, কোর্স, শিক্ষাদান সিস্টেমের উপরে আজ অব্দি কোন ট্রেনিং দেওয়া হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে শিক্ষকতার জন্য বিএড ডিগ্রি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এর আগে নিযুক্তিপ্রাপ্ত অনেকে তো কোনধরনের প্রফেশনাল কোয়ালিফিকেশন ছাড়াই শিক্ষকতা করছেন। সবাই তো আর শিক্ষক হওয়ার মত কোয়ালিটি নিয়ে জন্মগ্রহন করেন না। ট্রেনিং তাদের প্রফেশনাল করে তুলতে সাহায্য করতো।
সাধারন ঘরের ছেলেমেয়েগুলোর ভবিষ্যৎ কিন্তু সর্বকালে সরকারি স্কুলের উপর নির্ভর। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে। ওখানে তো ইংরেজি মিডিয়াম বা প্রাইভেট স্কুলের ওতো দহরম- মহরম নেই। থাকলেও ভর্তি হবার মত সামর্থ্য নেই সবার। শহরাঞ্চলের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার ছবি, স্কুলের ছবির অনেক ফারাক। সেটা বুঝতে হবে। বলেশ্বর উচ্চতর মাধ্যমিক স্কুলটির কথাই ধরা যাক। ওখানে শিক্ষকরা শিক্ষাদানের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে কেরানিগিরিও করেন। ছাত্র ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষণ প্রক্রিয়া, হিসাব নিকাশ, বেতনের বিল তৈরি সব শিক্ষকরাই করেন। তারপরও এ বছর শতকরা হিসেবে পুরো কাটিগড়া বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে স্কুলটি মাধ্যমিকেএই স্কুলই সবচেয়ে ভাল ফল দেখিয়েছে। ১৬০ জনে ৫৬ জন পাশ করেছে। এরমধ্যে প্রথম বিভাগে ৬ জন, দ্বিতীয় বিভাগে ৩৩ জন, তৃতীয় বিভাগে ১৫ জন। লেটার এসেছে ২৩টি। স্টার মার্কস এসেছে ১টি। লক্ষনীয় হলো , করোনা শিক্ষাবর্ষে গতবছর বিনা পরীক্ষায় মাধ্যমিকের রেজাল্টে যখন প্রতিটি স্কুলে পাশের হার ছিল একশ শতাংশ, তখন এই স্কুলে ছিল ৫৬ শতাংশ। স্কুল থেকে বিষয়ের নম্বর পাঠানো হয়েছে বলে অনৈতিক পথ অবলম্বন করে গণহারে পাশ করানো হয়নি। সততা বজায় রাখতে চেষ্টা করেছে স্কুলটি। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার রেজাল্টের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে প্রতি বছর ৭৫ থেকে ৮৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রী উত্তীর্ন হচ্ছে। ফলাফলে প্রথম বিভাগ, লেটার মার্কস, স্টার মার্কসও থাকে। বলেশ্বর উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি যেমন শত সমস্যার বেড়াজাল পেরিয়ে যেভাবে শিক্ষাদান কার্য চালিয়ে যাচ্ছে , তেমনি শিক্ষাদান অব্যাহত রাখতে চেষ্টা চালাচ্ছে রাজ্যের শত- সহস্র গ্রামীন স্কুলগুলো ।
এই স্কুলগুলোর উপরই মূলত নির্ভর গ্রাম আসামের শিক্ষার ছবি। গ্রাম আসামের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ। শহর- গ্রামের সব স্কুল হয়ত পরীক্ষায় লক্ষণীয় রেজাল্ট দেখাতে পারছে না। যদি প্রতি স্কুল ভিত্তিতে পোস্টমর্টেম করা হয়, তাহলে হয়ত দেখবো, এমন হাজারো সমস্যায় পক্ষাগাতগ্রস্ত স্কুলগুলো। কিন্তু আজ অব্দি স্কুলগুলোর সমস্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সরকার শুধু সামগ্রিক নথির হিসেবেই হিসেব কষছেন। যার ফল ভোগ করছে ছেলেমেয়েগুলো। হতাশার ব্যাপার হলো, শিক্ষক সংগঠনই হোক, কিংবা ছাত্র সংগঠন কেউই আজ অব্দি এ নিয়ে কথা বলছে না। শিক্ষার ছবি বদলাতে হলে সমস্যার শেকড়ে না গিয়ে অভিযোগের তীর ছুঁড়ে লাভ কিছুই হবে না। তাই রাজ্যের প্রতিটি স্কুল ভিত্তিতে সমস্যার সন্ধান করে সমাধানের চেষ্টা করা হোক। স্কুল পরিকাঠামো ব্যবস্থার পুরো পরিবর্তন হোক। তারপর যদি সরকারি স্কুলের শিক্ষার চালচিত্র না বদলায়, তখন শিক্ষকদের কাছে জবাব চাওয়া হোক।