CultureBreaking News

তাঁর অভিনয়ই তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখায়, দেবাশিস চক্রবর্তীর সঙ্গে ডা. হিমব্রত দাস

ডা. হিমব্রত দাস

৪ আগস্টঃ দেবাশিস চক্রবর্তী সম্পর্কে বলার অনেক বিষয় রয়েছে। তিনি একজন দুর্দান্ত অভিনেতা, পরিচালক, পথ নাটক রচনা বা নির্দেশনায়ও তিনি কাজ করে চলেছেন। কবি, গীতিকার এবং টলিউডেও বর্তমানে কিছু কাজ করছেন। সায়ন (যে নামে তিনি সবার কাছে পরিচিত ) প্রত্যন্ত গ্রাম নিজ ফুলবাড়ি, শিয়ালটেক-এ হৃদয়ে অনেক স্বপ্ন নিয়ে জন্মেছিলেন। বালক সায়ন ৫ বছর বয়সে শিলচরে বড় হওয়ার জন্য বরাক পার হয়েছিলেন। তাঁর প্রয়াত পিতা অভিনয়ের প্রতি অনুরাগী ছিলেন এবং “নিহত গুলাম” এর মতো কিংবদন্তি “যাত্রা” প্রযোজনায় অভিনয় করেছিলেন। সায়ন তার আকর্ষণীয় সৃজনশীল যাত্রা সম্পর্কে কথা বলেছেন । এই বার্তালাপে আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছে তাঁর বিনম্র আচরণ।

সাংস্কৃতিক কর্মীদের পক্ষে এই মহামারী কতটা শক্ত? আপনি কীভাবে এই সঙ্কট মোকাবিলা করছেন?

দেবাশিস: আসলে বর্তমান প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে নতুন জীবনের পাঠ শিখাচ্ছে। এই মহামারী আমাদের মনের ভেতরের শিল্প সত্তাকে হারাতে পারেনি। মঞ্চে বা রাস্তায় সেইভাবে নাটক বা সাংস্কৃতিক উপাদান দিয়ে মনের খোরাক মেটাতে পারছি না ঠিকই, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে খানিকটা ঝোলের স্বাদ অম্বলে মেটানোর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছি। চলার আরেক নাম জীবন। আমাদের গঠনমূলক ভাবনা নিয়ে এগোতেই হবে যতই মহামারী আসুক না কেন।

থিয়েটার সামাজিক পরিবর্তনের একটি সরঞ্জাম হিসাবে কোন ভূমিকা পালন করে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?

দেবাশিস: শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, থিয়েটারে লোক শিক্ষা হয় তাঁরই ইঙ্গিত আমরা আমাদের কাজে সবসময় পাই। সামাজিক পরিবর্তনের একটি সরঞ্জাম থিয়েটার, তা তো অবশ্যই কারণ, থিয়েটারের মূল ভাবনা শুধুমাত্র বিনোদন নয়। মানুষের দৈনন্দিন এবং পারিপার্শ্বিক নানান ঘাত প্রতিঘাতের গল্পের মাধ্যমে সামগ্রিক অভিনয়ের মাধ্যমে সেই বার্তাগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরে জীবনের এক নতুন মোড় তৈরি করা, সেটাই থিয়েটার কর্মীদের উদ্দেশ্য বলে আমার মনে হয়। থিয়েটার মূলতঃ একটি প্রয়োগ শিল্প।

আপনার নাট্য জীবনের প্রথম দিনগুলিতে কে আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছিল?

দেবাশিস: অভিনয় করাটাই একটা চ্যালেঞ্জিং বলে আমার মনে হয়। কারণ নিজের ব্যক্তি সত্তা থেকে বেরিয়ে এসে থিয়েটারের চরিত্রে প্রবেশ করে চরিত্র অনুযায়ী যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও নিজেকে তৈরি করা সত্যি কঠিন ব্যাপার। আসলে গ্রুপ থিয়েটারে সবাই মিলে কাজ করে প্রযোজনাকে সাফল্যে নিয়ে যাওয়াই লক্ষ্য থাকে থিয়েটার কর্মীদের। একেকটি প্রযোজনায় নির্দেশকের ভূমিকা থাকে বাড়ির অভিভাবকের মতো। সহ-অভিনেতা বা অভিনেত্রী সেখানে একে অন্যের পরিপূরক।

আপনি নাট্যব্যক্তিত্ব ব্যতীত একজন কবি। আপনার কবিতায় প্রায়শই থিমগুলি কী থাকে? এবং  আপনার কবি প্রতিভা অভিনয়ের ক্ষেত্রে মঞ্চে আপনাকে সহায়তা করেছে?

দেবাশিস: আসলে থিয়েটার এমন একটা শিল্প যেখানে সঙ্গীত নৃত্য ,আঙ্গিক,বাচিক সব কিছুরই একত্রিত মেলবন্ধন রয়েছে। সেখানে লেখালেখিটাও ওইভাবেই মনের আবেগ এবং প্রতিবাদের মাধ্যম হিসাবে বেরিয়ে আসে। সময়ের ঘড়ি এবং যুগের চলনকে মাথায় রেখেই কবিতা লেখার খানিকটা চেষ্টা করি। আমি কিন্তু নিজেকে কবি ভাবি না কোনওদিনই কবিতার দাস-ই ভাবি। হ্যাঁ, অতি অবশ্যই মঞ্চে আমাকে কবিতাগুলো প্রতিনিয়ত সহায়তা করে।

Sesher Kobita

একজন অভিনয়শিল্পী হিসাবে কোন ভূমিকাটি আপনি সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন? এমন পরিস্থিতিতে একজন অভিনেতাকে উত্সাহিত করার ক্ষেত্রে পরিচালক ও সহ-অভিনেতাদের ভূমিকা কী?

দেবাশিস: আসলে প্রতিটি জায়গায় বিচরণটা থিয়েটারের ভাবনাকে মাথায় রেখেই। গায়ক নই আমি শুধুমাত্র প্রাণের এবং শেখার তাগিদে খানিকটা হলেও শুদ্ধতা রেখে গাইবার চেষ্টা করি। দলছুট কতদূর পৌঁছেছে সেটা দর্শকশ্রোতারা জানেন। সদস্য হয়ে আমার বলতে পারাটা কঠিন। তবে সবার ভালোবাসা এবং আশীর্বাদে দলছুট প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছে। আগামীতেও এই ১২ বয়সের দলছুট অনেক নতুন কাজ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আপনি কি বিশ্বাস করেন তরুণরা থিয়েটারের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে পারে?

দেবাশিস: সময়ে সময়ে জীবনের একেকটি ধাপ পরিবর্তন হতে থাকে এবং আমরা চলমান জীবনে শিখে শিখে প্রয়োগ করতে থাকি শিল্পে। তরুণদের ভূমিকা বরাকের থিয়েটারে অনেক। জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কোন তরুণ কিশোরের ধাপের সংজ্ঞা এখানে মুল নয়। কাজটাই এখানে মোক্ষ। একজন কিশোরেরও একজন তরুণ থেকে থিয়েটারের প্রতি টান বা আগ্রহ বেশী থাকতেই পারে। কাজেই জনপ্রিয়তা আনে। তবে জনপ্রিয়তা থেকে দায়বদ্ধতার জায়গাটাই আসল আমার মনে হয়।

আপনিও খুব ভাল গায়ক এবং দলছুটের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পেছন ফিরে দেখে ভাবতে কেমন লাগে যে গ্রুপটি কতদূর পৌঁছেছে?

দেবাশিস: আমার বয়স যখন ৫বছর তখন থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে এই থিয়েটার চালিয়ে যাচ্ছি যা আজও বহমান। প্রথমেই যাদের কথা বলবো তারা হলেন আমার বাবা প্রয়াত শঙ্কর চক্রবর্তী ,আমার মা সুস্মিতা চক্রবর্তী, আমার দুই দাদা শিবাশিস এবং শুভাশিস চক্রবর্তী। তাদের যত্নে শিখেছি অনেক গল্প কবিতায় নিজেকে দেখার ভাবনা। নাটকের প্রথম হাতেখড়ি উত্তর পূর্বাঞ্চলের প্রথিতযশা নাট্যকার এবং অভিনেতা বিশ্বজিত চৌধুরীর কাছে। হাতে ধরিয়ে নাটকের নানান দিক শিখিয়ে তুলেছিলেন। মূলত তাঁকে দেখেই থিয়েটার শিক্ষার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম।আমার চোখে অভিনব নাট্য ব্যাক্তিত্ব কে বলা খুব মুশকিল। কারণ তখন যারা নির্দেশনা বা অভিনয়ে ছিলেন সবাই আমার কাছে একেক জন নাট্যযোদ্ধা।

দীপক সোম, কিরণশঙ্কর দত্ত, অনুপ দাস, বিধান চৌধুরী, অমিত শিকিদার, বিশ্বনাথ মুখার্জি, বিশ্বজিত দত্ত, রূপক চক্রবর্তী, সমীর রায়, সুবীর ভট্টাচার্য, চম্পা ভট্ট্যাচার্য, বিকাশ চক্রবর্তী, মৌসুমী দেবরায়, ঈশানি ভট্টাচার্য, অপরাজিতা কর (পরবর্তীতে চৌধুরী), বিশ্বজিত দাস, শান্তুনু পাল, সুজিত পাল, অসিত চক্রবর্তী, জয়ন্ত বিকাশ পুরকায়স্থ,বলরাম দে এদের সঙ্গেই ছোটবেলায় প্রথম কাজ করার সুযোগ হয় আমার।

পরবর্তীকালে বরাক উপত্যকার স্বনামধন্য অভিনেতা পরিচালক এবং সংগঠকদের দেখার এবং তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই। চিত্রভানু ভৌমিক, প্রদীপ দাস, আশীষ ভৌমিক, সুব্রত ভট্টাচার্য, শেখর দেবরায়, নিখিল পাল, সুব্রত রায়, বিশ্বজিত সমাজপতি, দীপঙ্কর চন্দ, রাহুল দাসগুপ্ত, দেবজ্যোতি বন্দোপাধ্যায়, অশোক চক্রবর্তী, শান্তুনু সেনগুপ্ত, সায়ন বিশ্বাস প্রমুখ। বেকস্টেজে যারা আমাকে প্রতিমূহুর্তে শিখিয়ে চলেছেন তারা হলেন অভিক সেনগুপ্ত, দেবজ্যোতি রায়, সুমন রায়, রাজা পাল চৌধুরী, রঞ্জন দাস, জগদীশ দাস, গোবিন্দ দাস প্রমুখ। সংগঠকদের মধ্যে ভাষ্কর দাস, সঞ্জু রায়, জয়দীপ চক্রবর্তীরাও রয়েছেন। তা ছাড়া অসংখ্য অভিনেতা অভিনেত্রী এবং সংগঠক যাদের দেখে রোজ শিখে চলেছি অগ্রজ এবং অনুজ সবাই।

বর্তমান প্রজন্ম থেকে মঞ্চে তরুণ প্রতিভা কারা? এবং সবশেষে সমস্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিনেতাদের জন্য কিছু পরামর্শ।

দেবাশিস: বর্তমান প্রজন্মের প্রায় সবাই থিয়েটারে নিষ্ঠা এবং অধ্যবসায়ের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনাও করছেন। এই উপত্যকার বিনায়ক, বিপ্রজীত, দেবরাজ অনির্বাণ, অরিত্র, বিপ্লব, অনুরণ, শুভজিত, অরুণাভ, শোভন, দ্রোহিত, গদাই, স্নেহা, উদ্দিপ্তা, শ্বেতা, নেহা, প্রিশেতা, গার্গী,অনন্যা, সোমশিখা দিব্যেন্দু, শুভজিৎ(দে), নভোলীনা, বিজয়, পিকলু, এদিব, নির্ঝর, নিলাদ্রি, হিয়া সহ আরও নতুনরা এই মূহুর্তে দাপিয়ে কাজ করছে।
কাজ করলে ফসলের আশা সবারই থাকে তবে একমাস বা একবছরে চট করে কিছু শেখা যায় না আমার মনে হয় অনুশীলনই তার একমাত্র পথ। উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে গেলে পরিশ্রমী হতে হয়। সব শেষে বলব প্রবীনের প্রজ্ঞা এবং নবীনের উদ্যোগ নিয়েই আমাদের থিয়েটার এগিয়ে যাক। সন্ধান করে পাওয়া, পেয়ে দেখা, দেখে শেখা, শিখতে শিখতে জীবনে প্রয়োগ করা এটাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র।

**Dr. Himabrata Das, Registrar, Department of Psychiatry, Tezpur Medical College & Hospital (TMCH). Apart from this, he is a vivid lover of sports, an eloquent commentator and a columnist. 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker