AnalyticsBreaking News
কা, কা-কা এবং কাকাতুয়া (পর্ব -১), লিখেছেন সুব্রত দাস
8 জানুয়ারি: দেশে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট বা সিএএ আইন প্রণয়ন হবার পর কিছু সংখ্যক মানুষ ‘কা’ নামক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত! একদিকে বিরোধী শিবিরে কা কা রব, অন্যদিকে কাকাতুয়ারা মুখস্থ করছে ‘কা’ নিয়ে অলীক গল্প কাহিনি। তারা মিথ্যে বুলি মুখস্থ করে সবাইকে চেষ্টা করছে বারবার শোনাতে, যাতে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বারবার উচ্চারিত একটা মিথ্যাকে জনগণের সামনে একসময় সত্যি বলে প্রতিষ্ঠা করা যায়! দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু কিছু শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক এই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন।
সম্প্রতি বিশিষ্ট বাঙালি কবি জয় গোস্বামীও বললেন যে, ভারতের মতো হিন্দু রাষ্ট্রে থেকে তিনি লজ্জিত! কিমাশ্চর্যম, আজকাল কিছু হলেই বুদ্ধিজীবী, কবি, সাংবাদিক, সিনেমাওয়ালা, শিল্পী সবাই রাজনৈতিক নেতাদের মতো হিন্দু জাতি এবং সনাতন সংস্কৃতিকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আক্রমণ করেন! কেউ ভারতে বাস করতে লজ্জা, কেউ ভয়, কেউবা বিতৃষ্ণা বোধ করেন! এদের বক্তব্য প্রায়শই অনেক মানুষকে মর্মাহত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তোলে! এর কারণ এই নয় যে ‘কা’-এর মতো একটা সরকারি মানবিক পদক্ষেপকে এরা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে আলটপকা মন্তব্য করছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক মতামত থাকতেই পারে। এমনিতেও ভারতীয় সংবিধান সবাইকে সে অধিকার দিয়েছে। তাছাড়া কারো ইচ্ছে এবং রুচির মালিক তার মন, যা ভারতবর্ষ নামক দেশের মতোই সম্পূর্ণ স্বাধীন।
তবে ঐতিহ্য মেনে ভারতের অধিকাংশ শহুরে লেখক, বিশেষ করে বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই কোনও না কোনও রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় থাকা পছন্দ করে আসছেন। এমনকি সম্পূর্ণ ভিন্ন মত এবং পথের দর্শন হলেও শাসক দলের সঙ্গে বরাবরই তাদের রুচি এবং নীতি অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায় সবসময়। বারবার মনে হয়েছে, আসলে দলগুলো পাল্টেছে, কিন্তু তারা পাল্টাননি; যেন নীতিহীন দলগুলোই গঙ্গা স্নান করে বারবার সততার পরাকাষ্ঠা দেখাতে বুদ্ধিজীবীদের গলায় ঝুলে পড়েছে!
আর সত্যিইতো, কবি বা বুদ্ধিজীবীরা পাল্টাবেনই বা কেন? তারা তো আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে করেন রচনা। নাহলে পশ্চিমবঙ্গের মাটির উপর দাঁড়িয়ে একদল বুদ্ধিমান বুদ্ধিজীবী বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো নিরীহ, অত্যাচারিত হিন্দুদের দেখেও বারবার হিন্দুদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করতে পারেন!
আগ্রাসন এবং ধ্বংসে অবিশ্বাসী এই হিন্দু মানুষেরা উদার এবং সুমহান সনাতন সংস্কৃতির বিশাল সিন্ধুর ছোট্ট ছোট্ট বিন্দু! তারা হয় কখনও চাপে পড়ে কারও সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন, কখনও আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে নিগৃহীত অথবা নিহত হচ্ছেন, কখনওবা পালিয়ে দেশান্তরী হয়েছেন। তাই সাধারণ মানুষের বেশি খারাপ লাগে যখন তারা বুঝতে পারেন, জয় গোস্বামীর মতো লেখক, কবি এবং সৃষ্টিশীল মানুষের সততা, নিষ্ঠা এবং নিরপেক্ষতা আসলে তাদের কষ্টকল্পিত স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়! মানুষ অবাক এবং আহত হন এই ভেবে যে, এদের প্রতিবাদ সবসময়ই কেন এতো সিলেকটিভ বা নির্বাচিত হয়? বারবার একতরফা দশ হাজার বছরের পুরনো একটা উর্বর এবং মানবিক এক ভারতীয় দর্শন যা সনাতন দর্শন বলে বিশ্বে পরিচিত, কেন অবিরাম অহেতুক অপমানে বারবার নিষ্পেষিত এবং নির্বাসিত যেখানে সবাই জানে – ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ ভারতীয় সংস্কৃতির মূল দর্শন! তা সত্ত্বেও, যদি হিন্দু শব্দ এবং সংস্কৃতিতে জয় গোস্বামীর মতো বিশিষ্ট কোনও ভারতীয় মানুষের লজ্জা বর্ধিত হয়, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, জয় পারবেন কি নিজের গোস্বামী পদবী ত্যাগ করতে?
সত্যি বলতে ইদানীং মনে হয়, এইসব বিশিষ্ট মানুষের একপেশে দৃষ্টিকোণের জন্যই ভারতবর্ষ আজ অশান্ত। যা মনে হয়, এই বিজ্ঞ এবং সম্মানীয় মানুষেরা ভারতকে সত্যিসত্যি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত না করে ছাড়বেনই না। কোনও সমস্যা নেই যদি কেউ অন্য ধর্মের শান্তি ও মানবিকতার পরাকাষ্ঠা নিয়ে উল্লসিত এবং উদ্বেলিত বোধ করেন, কিন্তু সমস্ত হিন্দু মানুষ এবং সংস্কৃতিকে নীচু করে এরকম কোনও মন্তব্য করেন; তখন প্রশ্ন ওঠে, এটা কি কারও কবিসুলভ খামখেয়ালিপনা নাকি বিদ্বজ্জনের রুচিশীলতা? তাও গ্রহণযোগ্য হতো যদি কথাটা সত্যি হতো।
প্রথমতঃ জিজ্ঞাস্য, ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হলো কবে থেকে? এতো মনে হচ্ছে, বিখ্যাত আরেক চলচ্চিত্র শিল্পী ও নির্দেশক কর্তৃক এই উপমহাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে অভিহিত করার মতো আরেক হাস্যকর পণ্ডিতমন্যতা! কবি বা সৃজনশীল হলেই কি ইতিহাস আর সাধারণ জ্ঞান খরচের খাতায় তুলে রাখতে হয়? আমাদের দেশে একটা অদ্ভুত মানসিকতা আছে, যেটাকে অনেকে মানবিকতা বলেন, কিন্তু আসলে সেটা মানবিক না পারমানবিক খোদায় মালুম! আর যেটা আসলে মানবিক, সেটা হয়ে যায় এদের চোখে সাম্প্রদায়িক!
ধর্মীয় কারণে পাশের বাড়ির কতগুলো অসহায়, নির্যাতিত, প্রতারিত উদ্বাস্তু মানুষ আমাদের দেশে আশ্রয় পেতে যাচ্ছে বলে তাদের কি উদ্বেগ আর লজ্জা! কারণ, এদের মতানুযায়ী, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া সেই দেশের অত্যাচারী মানুষ, তারা অত্যাচারিতের সঙ্গে কেন এই দেশে অবাধ নাগরিকত্ব পাবে না? অর্থাৎ শরণার্থী আর অনুপ্রবেশকারী কেন সমার্থক হবে না! হয়তো এজন্যই জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে ভাড়াটে সৈন্য এনে পরিকল্পিতভাবে যেভাবে দেশের শান্তি, সংহতি এবং আক্রমণের চেষ্টা করা হয়, সেটা এইসব বিদ্বজ্জনের কাছে নিরীহ, নির্দোষ ছাত্রদের সামান্য গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক অধিকার মাত্র!
ঠিক যেভাবে বখতিয়ার খিলজি স্টাইলে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয়েছিল একসময়; সেভাবেই দেশে আক্রমণ, ভাঙ্গচুর, লুটপাট করা হলো, অথচ একবারও শহুরে বুদ্ধিজীবীরা প্রশ্ন করলেন না যে, এরকম অন্যায়ভাবে জাতীয় সম্পত্তি কেন ধ্বংস করা হলো। একসময় যেমনি চরম বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী নাস্তিক(?) জেএনইউ-র বিদ্যার্থীর মুখে শোনা গিয়েছিল স্বপ্নিল বিপ্লবী স্লোগান ‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে ইনশাআল্লাহ ইনশাআল্লাহ’, তেমনি হালের এই উত্তাপে দেশবাসী শুনতে পেল আরেক নতুন হল্লা বোল ‘তেরা হামারা রিস্তা কেয়া, লা ইলাহি ইল্লাহ লা’!
অথচ একটি লাইন ব্যয় করে এই সুশীল, শিক্ষিত এবং শহুরে বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী উচ্চারণ করেন না যে, ‘কা’ বা সিএএ কারও নাগরিকত্ব হরণ করার জন্য নয়, এটা নাগরিকত্ব দান করার জন্য গৃহীত। কাদের জন্য? একদিকে আসামের বরাক উপত্যকা, অন্যদিকে সংস্কৃতির মক্কা কলকাতা মহানগরী থেকে মাত্র সামান্য কয়েক কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ নামক দেশের কিছু ধর্মীয় প্রতারিত, অত্যাচারিত ছয়টি জনগোষ্ঠীর মানুষ যারা ২০১৪ সাল পর্যন্ত ভারতে এসেছেন, তাদের জন্য! বাংলাদেশের সঙ্গে আছে আরও প্রতিবেশী দুটো দেশ পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান। কেন?
কারণ, এই তিনটি ইসলামিক দেশেই সংখ্যালঘু বিধর্মীরা দশকের পর দশক ধরে অবহেলিত, প্রতারিত, নির্যাতিত। সংবাদপত্র, টিভির খবর বাদ দিলেও বাংলাদেশের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং বুদ্ধিজীবী ডঃ আবুল বরকতের গবেষণালব্ধ প্রতিবেদন বলে, যেহারে প্রতিদিন হিন্দু ওই দেশ থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, তাতে আগামী এক-দু দশক পর বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য দেশে পরিণত হবে। এসময় কেন কোনও বুদ্ধিজীবী, কবি, শিল্পীর সৃজনশীল সত্তা জাগ্রত হয় না?
সবচেয়ে বড় কথা- যে কা, এনআরসি, এনপিআর নিয়ে এতো হট্টগোল, এরা কেউ কি জানেন যে নাগরিকত্ব পরিচয়পত্র শুধু আমেরিকা, ইতালি, চীনে নয়; আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও প্রদান করা হয়। ভারত বোধহয় এ ব্যাপারে একদম লাষ্ট বেঞ্চার! কই কোনও দেশে তো এ নিয়ে কোনও হল্লা বা প্রতিবাদ হয়নি! অন্য দেশগুলোতেও যে সিটিজেন আইডেনটিটি বা নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র প্রদান করার রীতি বর্তমান, সেটা নেটে উইকিপিডিয়া সার্চ করলেই তো জানা যায়! এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা কি করে দেশের বিরাট বিরাট পণ্ডিতদের কাছে প্রশ্ন, সন্দেহ, বিরক্তি, প্রতিবাদের কারণ হয়, সেটা ভীষণ আশ্চর্যজনক! অথচ এরা নাকি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক জ্ঞানে পরিপক্ক!
কারও কারও এজন্য ভারতে থাকতে লজ্জা করে, কারও করে ভয়! কেউ বা বীতশ্রদ্ধ দেশের প্রতি! এদের ভেতর যদি বিন্দুমাত্র সততা থাকতো, তাহলে যে কাজটা করলে লজ্জা এবং ভয় মুক্ত হবেন, সেটা অতিসত্বর সম্পন্ন করে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেই পারেন? কিন্তু না, এরা এই দেশ তারা ছেড়ে যাবেন না! হয়তো কেউ বা প্রতিজ্ঞা করবেন মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হলে এই দেশে আর আসবেন না, কিন্তু সেটা শুধু মৌখিক। এরা একদিকে বলবেন, এই দেশে সংখ্যালঘুরা অসুরক্ষিত; কিন্তু এরাই আবার অন্যদিকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের নাগরিকত্বের জোর দাবিতে মিটিং, মিছিল, ধর্নায় বসবেন!
To be continued….
(Views expressed in this article are solely of the author and does not necessarily reflect the views of the portal)