Barak UpdatesCulture

এক্সিডেন্টাল নাট্যকারের ‘নুরি’, কতটা সফল গণসুর?

নাট্য আলোচনায় সায়ন বিশ্বাস

গণসুরের নতুন নাটক ‘নুরি’ ঘিরে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা কি পূরণ হল? দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে উত্তর দিতে গেলে, নিশ্চয়ই হয়েছে। বিরতিহীন প্রায় পৌনে তিনঘন্টার শো দেখার পরও দর্শকদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। নাটকের শেষ দৃশ্যে গোটা বঙ্গভবন জুড়ে যেভাবে করতালির বৃষ্টি পড়েছে, তাতেই প্রযোজনার প্রাথমিক ‘ফিডব্যাক’ পেয়ে গিয়েছিলেন কলাকুশলীরা। পেয়ে গিয়েছিলেন হলঘরে হাজির নাট্যকার অরিজিৎ আদিত্য নিজেও। ‘লিগেসি কোড’ ও ‘আত্মহত্যার পর’-এর মতো সেমি-পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনার সফল মঞ্চায়নের পর, রীতিমতোই একটা কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়েছিল গণসুর ও নাট্যকার অরিজিতকে। দিতে হয়েছিল কারণ, পূর্ণাঙ্গ নাটক ঘিরে যেসব প্রাথমিক শর্ত থাকে, সেসব পূরণ করে একটা নাটককে ‘নাটক’ হিসেবে গড়ে তোলা কঠিন, বেশ কঠিন। বিশেষ করে দু’পক্ষই যখন পুরোদস্তুর পেশাদার নন, তখন নাট্যকারকে যেমন নাটকটি রচনার ক্ষেত্রে খুব বেশি সংযত থাকতে হয়, ঠিক তেমনি নাটকের টেক্সটের ক্ষেত্রে সুবিচার করা জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় প্রযোজক গোষ্ঠীর। আর এই দুই যখন একাকার হতে পারে, তখনই একটা সফল মঞ্চায়ন আমরা উপহার পাই, যেটা ‘নুরি’র ক্ষেত্রে হয়েছে।

আলোচনার শুরুতেই নাট্যকারকে একটা সাধুবাদ জানাতে হয়, তাঁর বিষয় নির্বাচনের জন্য। ‘অস্থির’ এই সময়কে মঞ্চে তুলে আনার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন; সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার যে ঝুঁকিটা তিনি নিয়েছেন, তাতে অন্য নাট্যকার, লেখক, কবিরা নিশ্চয়ই উৎসাহিত হবেন। ইতিহাস সাক্ষী, যে কোনও অতি-সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে যখনি কোনও সৃষ্টিকর্ম হয়েছে, তা ঘিরে চর্চা হয়েছে বিস্তর। চর্চা হয়েছে ভাল-মন্দ দুটো দিক নিয়েই। অরিজিতের লেখা নুরি-ও এর ঊর্ধ্বে নয়। প্রযোজনাটির অতি-সংবেদনশীল নাট্য মুহূর্তে বা সংলাপে, দর্শকরা তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। ফিসফাস শোনা গেছে। একজন তার পাশে বসে থাকা অন্যজনের দিকে তাকিয়ে ‘বেশ তো, সাহস আছে বটে’ গোছের প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এবং এই প্রতিক্রিয়া নাট্যকার সহ কলাকুশলীদের বড়সড় উৎসাহ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

অরিজিৎ আদিত্য কিন্তু লিখেছেন দারুণ। প্রতিটি দৃশ্যে সাসপেন্স, সংলাপের শক্ত বাঁধন, দুরন্ত সব নাট্য মুহূর্তের সম্ভাবনা লুকিয়ে রেখেছেন স্ক্রিপ্টে। দীর্ঘ নাটক ‘ঝুলে’ পড়ার যে প্রবল সম্ভাবনা বয়ে বেড়ায়, অন্তত ‘নুরি’ এর থেকে মুক্ত ছিল, টেক্সটের দিক দিয়ে। আসলে গল্পটাই এতো দুর্দান্ত যে ‘এরপর কী হবে’ ব্যাপারাটা যেমন ছিল, তেমনি ছিল ‘শেষ পর্যন্ত কী হবে’ তা দেখার প্রবল আগ্রহ। একসময় যেন ক্লাইমেক্সে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তর সইছিল না! এখানেই নাট্যকার সফল।

তবে নাট্যকার এটা স্বীকার করেছেন যে, নাটকটি প্রয়োজনের চেয়ে একটু দীর্ঘ হয়ে গেছে। নিজের সৃষ্টির প্রতি আপনার এই সততার জন্যই, প্রযোজনাটি দীর্ঘ হলেও আমাদের ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটেনি। আমরা টানটান রোমাঞ্চ নিয়েই দেখেছি। এবং নাটক শেষে মঞ্চে উঠে আপনি যখন নিজেকে বলেছেন ‘এক্সিডেন্টাল নাট্যকার’, সবাই করতালি দিয়েছেন। শুধু দুয়েকটা জায়গায় ডায়লগের রিপিটেশন রয়েছে, সেটা যদি ‘অভিনেতার ভুল’ না হয়ে থাকে, একটু দেখে নেবেন নাট্যকার, সে আশা করে যেতেই পারে।

এবার আসি প্রযোজনার কথায়। দীর্ঘ নাটক রচনার ক্ষেত্রে নাট্যকারকে যতটা না খাটুনি করতে হয়, এর চেয়ে বেশি পরিশ্রম যায় প্রযোজক এবং বিশেষ করে নির্দেশকের। সুব্রত রায় এখানে নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন নিঃসন্দেহে। এতগুলি দৃশ্যকে গুছিয়ে তোলার পাশাপাশি মঞ্চ দাপিয়ে যে মাপের অভিনয় তিনি করলেন, যেভাবে নিজের চরিত্রকে মাল্টি-ডায়ামেনশন দিলেন, যেভাবে কো-আর্টিস্টদের অভিনয় করার সুযোগ করে দিলেন, তাকে ভাই একটা সেলাম দিতেই হয়। না, সবটাই যে নিখুঁত হয়েছে, এমন নয়। আরও, আরও অনেক ভাল করার মতো অনেক জায়গাই হয়তো রয়ে গেছে। কিন্তু যে সীমিত রিসোর্স নিয়ে, যে সীমিত পরিকাঠামো, যে অপেশাদার মানসিকতার আবর্তে, ও আর্থিক সংকটের মধ্যে বরাকের নাট্য চর্চা এগোয়, সেই হিসেবে এই প্রযোজনা পাঁচের মধ্যে অন্তত ফোর ষ্টার তো পেতেই পারে।

সেদিন সুব্রত রায়ের অভিনয় নিয়ে কোনও বিশ্লেষণ হয় না, দুর্দান্ত। তবে কোনও অংশেই পিছিয়ে ছিলেন না ৬৭ বছর পেরিয়ে আশা প্রদীপ দাস। কী অসামান্য ও সহজিয়া অভিনয় তিনি উপহার দিলেন আমাদের! মন ভরে গেল। তাকে যত দেখি, অবাক হই। প্রদীপ দাস ও সুব্রত রায়ের প্রথম সাক্ষাতের ওই দৃশ্যটা বহুদিন মনে থাকবে। দুটো ভাল অভিনয় কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী—- সব উত্তর ওখানেই ছিল। হাঁটাচলার ক্ষেত্রে মঞ্চের জ্যামিতিক ব্যবহার। গলার স্বরের ওঠা-নামা। অফ দ্য ডায়ালগ অ্যাকশন-রিয়্যাকশন। চোখের ব্যবহার, নাট্যশাস্ত্রের সাত্ত্বিক পর্যায়ের নবরস। দু’জনই ফাটিয়ে দিয়েছেন। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়।

সিনিয়র অভিনেতাদের মধ্যে আশিস ভৌমিকও ফাটিয়ে দিয়েছেন। শর্মিলা দত্ত, রুমি রায় এই দু’জনের দু’টি পৃথক চরিত্রের যে ছবি আমরা পেয়েছি, তাও দীর্ঘদিন মনে থাকবে। তবে রুমিকে আরেকটু আন্ডারটোন রাখা যায় কিনা, পরিচালক ভেবে দেখতে পারেন। নুরি চরিত্রের মেয়েটির অভিনয়, এক্সপ্রেশন দর্শকদের মনে গিঁথে আছে, থাকবেই। দারুণ লাগল ওকে। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে বিশ্বজিৎ সমাজপতি, বিভাস রায়, অনির্বাণ, সৌম্যায়ন, হর্ষজিত, নবারুণ, শুভম, তানিয়া, নয়না, অনন্যা, অনিন্দিতা সবাই নিজেদের দায়িত্ব দারুণভাবেই পালন করেছেন। এর মধ্যেও তানিয়া দাসকে নিয়ে একটু বলতে হয়, এদিন পার্শ্ব চরিত্রে তার অভিনয় কিন্তু বাড়তি পাওনা। একজন পরিণত ও দুরন্ত অভিনেত্রী হওয়ার মতো সব সম্ভাবনাই ওর মধ্যে পাওয়া গেল। অভিবাদন সাথী।

বিভাস রায় তার প্রথম দৃশ্যে দুর্দান্ত একটা ম্যানারিজম রেখে অভিনয় করেছেন। দর্শকরা তার অভিনয়ে মুগ্ধ হন। কিন্তু পরের দৃশ্যে তিনি ওই ধাঁচটা ধরে রাখতে পারলে আরও ভাল লাগতো। হয়তো নাটকটি সম্পাদনার ক্ষেত্রে সাংবাদিক চরিত্র নিজের নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি, এটাও একটা কারণ হতে পারে। আর ছোট্ট হৃতিষার কথা কী বলি! এইটুকুনি বয়েসে সে আগুনের গোলা।

সেট-সেটিংস দুর্দান্ত। এতো ছিমছাম মঞ্চ, এতো পরিষ্কার বুঝিয়ে দিচ্ছিল সব। এমনকি দৃশ্য পরিবর্তনে; সেট পাল্টাতেও কোনও ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ফলে সুজিত পাল সহ যে যে এই সেট-এর নিচে পরিশ্রম করেছেন, একটা ধন্যবাদ আপনাদেরও প্রাপ্য।

মিউজিক ভাবনার ক্ষেত্রে যতটা মুন্সিয়ানা সুদীপ্ত চক্রবর্তী দেখিয়েছেন, ততটাই আবহ প্রক্ষেপণে নিজের পেশাদারিত্ব দেখান সেবায়ন রায়চৌধুরী। সংলাপ, নাট্য মুহূর্ত, দৃশ্য পরিবর্তন, এসবের সঙ্গে যখন আবহ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন আবহও যেন সংলাপ হয়ে ওঠে; দৃশ্য হয়ে ওঠে। সাবাস সেবায়ন-সৌম্য।

মেকআপও দারুণ হয়েছে, সব চরিত্রকেই বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল, আরোপিত নয়। আলোক সম্পাতে চমক ছিল না, তবে দেবজ্যোতি রায় ছিলেন নিখুঁত ও চমৎকার। আসলে অভিনয়ের সঙ্গে আনুষাঙ্গিক এই বিষয়গুলি এতই খাপ খেয়েছে, যে নাটকটি এক অন্য মাত্রায় উন্নীত হয়। আর, এ কারণেই প্রযোজনাটি গণসুর ও শিলচরের ডাইরিতে একটি সফল প্রযোজনা হিসেবেই লেখা থাকবে।

তবে সবকিছুর পরেও তো কয়েকটা খটকা রয়েই গেল, তাই না? লিঞ্চিংয়ের ঘটনা, কিংবা ডি-নোটিশ পাঠানোর পেছনে কী রহস্য ছিল, সেটা কি দর্শকরা জানতে-বুঝতে পারলেন? না, পারলেন না। প্রদীপ দাস, নাটকের দুটি অতি-গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ মিস করে বসায় ঘরে ঢুকে মহল্লার ছেলেদের উৎপাত, বা ফেক ডি-নোটিশ পাঠানোর রহস্যটি রহস্যই রয়ে গেল। আসলে, এই প্রতিবেদকের স্ক্রিপ্ট পড়া আছে বলেই এটা জানি যে, জমি দালাল চক্রের নজর পড়ছিল হিন্দু পাড়ার বাসিন্দা ফারুক আহমেদের বাড়ি-জমিতে। এবং সেই সূত্র ধরেই ফারুককে নানা ভাবে চাপ তৈরি করছিল চক্রটি। এর সঙ্গে মিনিস্টার প্রণব চালিহা বা তার পরিবারের কোনও সম্পর্ক ছিল না। গোটা ব্যাপারটাই ঘটে অন্য কনটেস্টে। আসলে, নাট্যকার বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যে, সমাজবিরোধীরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ধর্মকেও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, এটাই বাস্তব। কিন্তু আফসোস, নাটক মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটি অনুন্মোচিত রয়ে গেল। বরং মনে হল, নাট্যকার অতি সাসপেন্স তৈরি করতে গিয়ে এই বিষয়গুলিকে এনেছেন, অনর্থকভাবেই। এছাড়া নাটকটি সম্পাদনার ক্ষেত্রেও আরেকটু যত্নবান হওয়া যেত। কারণ, সম্পাদনার কারণে সাংবাদিকদের চরিত্রটি দাঁড়ায়নি, অদরকারী মনে হয়েছে। এছাড়া মনে হয়েছে, ফারুকের পরিবারও যেন দুম করেই তারা তাদের স্নেহের নুরিকে সমঝে দিতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। আসলে নাটকের দৈর্ঘ্য কমানোর জন্যই এই সম্পাদনা; সেটা জেনেও আমরা তো চাইব একটা টানটান, একটা ত্রুটিহীন চিত্রনাট্য। এই চাওয়া তো দাবি করতেই পারি এত ভাল একটা প্রযোজনার স্বার্থে। যাই হোক, গণসুর এসব সহজে শুধরে নেবে বলেই বিশ্বাস করি।

শেষ করার আগে দুয়েকটা কথা মঞ্চ ব্যবহার নিয়ে। গোটা নাটকটি হয়ে গেল মূলত আপ ও মিডিল স্টেজে। দুয়েকটি দৃশ্য ছাড়া ডাউন স্টেজের ব্যবহার কার্যতই হয়নি। এতে মনে হয়েছে, সবকিছুই যেন একটু দূর থেকে দেখছি। পরিচালক ব্যপারটা দেখবেন একটু।

শেষ উক্তি- নাট্য শিল্পে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ফলে সব ত্রুটি বিচ্যুতি মুছে এই নাটক এক মাইলস্টোন হবে, সেটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আর, ‘এক্সিডেন্টাল নাট্যকার’ আরও এমন ‘এক্সিডেন্টাল নাটক’ উপহার দেবেন, সেটা আশা করতেই পারি। আশা করতেই পারি, নবীন-প্রবীণের ককটেলে এমন আরও দুর্দান্ত প্রযোজনা উপহার দেবে গণসুর। যে প্রযোজনা দেখে আমরা বলতে পারব – ‘বেশ তো, সাহস আছে বটে’।

(অতিথি কলাম। লেখক একজন সাংবাদিক তথা নাট্যকর্মী)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also

Close
error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker