Barak UpdatesBreaking News
নর্মাল স্কুলে মিলল ভট্টকবিতার দ্বিতীয় পুঁথি2nd Manuscript of Bhatta Poetry found at Silchar Normal School
৮ ডিসেম্বরঃ ভট্টকবিতার আরও একটি পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। এতদিন এই সাহিত্যধারার একটিমাত্র পাণ্ডুলিপি ছিল। তাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
পুঁথি বিশেষজ্ঞ যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য ‘শ্রীহট্টের ভট্টসঙ্গীত’ গ্রন্থের ভূমিকাংশে লিখেছেন, এ পর্যন্ত ভট্টকবিতার একটিই পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে। সেটি রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর দাবি ছিল, আরেকটা ভট্ট-পুঁথি রয়েছে তাঁর সংগ্রহে। সেটি পদ্মনাথ ভট্টাচার্য বিদ্যাবিনোদের সংগৃহীত। কিন্তু পদ্মনাথ ভট্টাচার্য নিজেই লিখেছেন, তিনি এই পাণ্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পড়তে গিয়ে দেখেন, সেগুলিতে বর্ণ-অশুদ্ধি, অস্পষ্টতা রয়েছে। তাই তিনি সেগুলি শুদ্ধ করেছেন। অর্থাত যতীন্দ্রবাবু পদ্মনাথ ভট্টাচার্যের সংগৃহীত পুঁথি সম্পাদনা করেছেন। ফলে তাঁর সংগ্রহশালায় যে ভট্টকবিতার পুঁথি রয়েছে সেটি মৌলিক নয়। সে-দিক থেকে দেখলে, ভট্টকবিতার দ্বিতীয় পুঁথিটি উদ্ধার হল শিলচরেই।
শিলচর নর্মাল স্কুলে শতাধিক বছর ধরে সংরক্ষিত পুঁথিগুলির বিবরণাত্মক তালিকা (ডিটেলস ক্যাটালগিং)-র কাজ চলছে এখন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজের আর্থিক সাহায্যে গত ১ মে এই কাজ শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলায় ৩৬২টি এবং সংস্কৃতে ১৫০টি পুঁথির ক্যাটালগিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তা করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে ১৮৭৬ সালে কবি জয়চন্দ্র ভট্টাচার্যের হাতে-লেখা ভট্টকবিতা ‘রাজনগর’। পূর্ববঙ্গের রাজনগর গ্রাম একবার বন্যায় চরম বিপর্যস্ত হয়েছিল। সেই কাহিনিই বর্ণিত হয়েছে তাতে। উল্লেখ রয়েছে কাছাড়ের ভূমিকম্পের কথাও।
প্রজেক্ট ইনচার্জ অমলেন্দু ভট্টাচার্যের অনুমান, এটি জয়চন্দ্র ভট্টাচার্য শিলচরে বসে লিখেছেন। কারণ উমেশচন্দ্র দেবের এক লেখায় উল্লেখ রয়েছে, জয়চন্দ্র প্রতি বছর শিলচরে আসতেন।
বই, পত্রপত্রিকার আগে ভট্ট-কবিরা একধরনের কবিতা তৈরি করতেন, সেগুলি হাটে-বাজারে শুনিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন। এগুলিকে সে সময়ের সংবাদ সাহিত্যও বলা যায়। কোনও আলোড়নকারী ঘটনা ঘটলেই তারা এর ওপর ভট্টকবিতা লিখতেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ও বহু ভট্টকবিতা রচিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলির পাণ্ডুলিপি কেউ কোথাও খুঁজে পাননি। এমনকী, মুদ্রণ ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরও বহু ভট্টকবিতা রচিত হয়েছে, মুদ্রিত হয়েছে। কোনওটিরই পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেননি। এই অঞ্চলেও ভাষাশহিদ দিবস, নেহরুর মৃত্যু, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যা, বন্যা-ভূমিকম্প নিয়ে ভট্টকবিতা রয়েছে। সবই মুদ্রিত, পাণ্ডুলিপির হদিশ নেই।
অমলেন্দুবাবুর কথায়, শুধু ভট্টকবিতাই নয়, পাঁচ শতাধিক পুঁথির বিবরণাত্মক তালিকা প্রস্তুতের মাধ্যমে খুব তথ্যনিষ্ঠভাবে বরাক উপত্যকার মধ্যযুগের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, ইতিহাস রচনার প্রত্যক্ষ তথ্যসূত্র পাওয়া গেল। এর ফলে ইতিহাস গবেষণা সমৃদ্ধ হল। নর্মাল স্কুলের সংগ্রহে সবচেয়ে পুরনো পুঁথি মিলেছে ১৬৯৯ সালে লেখা গীতার অনুবাদ। সেটি কবিতায় লেখা। রচয়িতা সন্তোষ শর্মণ। পুঁথিতে লেখা রয়েছে, তিনি তা লিখলেও বইয়ের মালিক আদিত্য বর্মণ। তবে এই পুঁথির পুরোটা মেলেনি। পুষ্পিতাতে লেখা রয়েছে, তাতে ৪৭টি পত্র রয়েছে। কিন্তু অমলেন্দুবাবুরা পেয়েছেন ১৫ পত্র। এমন বেশকিছু গ্রন্থেই সব পাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশেরই পুস্পিতা মেলেনি।
অমলেন্দুবাবু মূলত বাংলা পাণ্ডুলিপি নিয়েই কাজ করেছেন। তিনি নর্মাল স্কুলে পেয়েছেন ৮০টি রামায়ণ, ৪৫টি পাঁচালি, ১৬টি পুরাণ, ৬৪টি মহাভারত, ৪৪টি মঙ্গলকাব্য, ১২টি গীতা, ৬৯টি বৈষ্ণবসাহিত্য, ২টি যোগসাহিত্য এবং ২টি ইন্দ্রজাল বিদ্যার পুঁথি। ওইগুলি লেখা হয়েছিল দুধপাতিল, বিহাড়ার বিক্রমপুর, হাইলাকান্দির বড়বন্দ প্রভৃতি এলাকায় বসে।
সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিগুলির বিবরণাত্মক তালিকা তৈরি করেন এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষক বিবেকানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, এত পুঁথি উদ্ধার থেকেই এই অঞ্চলে ওই সময়ের সামাজিক অবস্থাটা বোঝা যায়। তাই এগুলি এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক সম্পদ। অধিকাংশ গাছের ছালের ওপর লেখা। এখানকার প্রাচীনত্বও ধরা পড়ে।
পাণ্ডুলিপির বিবরণাত্মক তালিকা প্রস্তুতে নর্মাল স্কুলে কাজ করে চলেছেন রত্না নন্দী, মহুয়া চন্দ্র, অঙ্কিতা বিশ্বাস, অনিন্দিতা কর ও ভাস্কর শর্মাচার্য। নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষা মানসী সিংহ সে জন্য সবাইকে সাধুবাদ জানান। তিনি বলেন, এর দরুন বরাক উপত্যকার প্রত্যাশা পূরণ হবে। গবেষকরা এখন এ নিয়ে কাজের সুযোগ পাবেন।