Barak UpdatesAnalytics

পিজিটি শিক্ষকদের নিচের ক্লাসে পড়ানোর নোটিশ প্রসঙ্গে—– লিখেছেন ডি চৌধুরী

ওয়ে টু বরাক, ১৬ ডিসেম্বর : নোটিশ আর নোটিশ। শিক্ষা বিভাগের একের পর এক নোটিশে বিভ্রান্তিতে পরিণত রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলোর শিক্ষাদান পর্ব। বিভ্রান্তির শিকার শিক্ষকরাও। গত ১২ ডিসেম্বর শিক্ষা বিভাগ থেকে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। যার বক্তব্য হচ্ছে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-এর সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষা ক্ষেত্র অফিস মেমোরেন্ডামের গাইডলাইন অনুযায়ী রাজ্যে অনেক হাইস্কুলকে হায়ার সেকেন্ডারিতে উন্নীত করা হয়েছে এবং নিম্ন প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, হাই এবং হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলগুলোকে একত্রীকরণ করা হয়েছে, কিংবা একই ক্যাম্পাসে আনা হয়েছে। শিক্ষা বিভাগের পর্যবেক্ষণে নাকি দেখা গেছে, এমালগেমেটেড অথবা আপগ্রেডেড সেকেন্ডারি লেভেল স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত সংখ্যক পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচার আছেন। স্কুলগুলোতে শিক্ষাদান পর্বকে মসৃণ করতে এ বার থেকে পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচারদের ক্লাস সিক্স থেকে টুয়েলভ অব্দি ক্লাস করাতে লাগবে। এই আদেশনামাকে ত্বরান্বিত করতে সত্বর পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচারদের ক্লাস রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে রাজ্যের স্কুল প্রধানদের। এই নোটিশটা পড়ে আপাতদৃষ্টিতে কী বোঝা গেল? এই সময়ে আসামের প্রতিটি সরকারি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে পর্যাপ্ত পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচার সংক্ষেপে পিজিটি রয়েছেন।

প্রশ্ন হলো এই পিজিটি কারা? একসময় হায়ার সেকেন্ডারির শিক্ষক পদটির নাম ছিল লেকচারার। তারপর নাম বদল হয়ে হলো সাবজেক্ট টিচার, অর্থাৎ বিষয় শিক্ষক। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে বিষয় শিক্ষক পদটির নাম আবার বদল করা হলো। নতুন নাম পিজিটি অর্থ্যাৎ পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচার।

প্রসঙ্গক্রমে একটু বোঝা যাক জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ এর লক্ষ্যটা কী ? এতদিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬-এর ভিত্তিতে। সুদীর্ঘ ৩৪ বছর পর সেই শিক্ষানীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষানীতিতে ৩ থেকে ১৮ বছরের বাচ্চাদের শিক্ষার অধিকার আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। স্কুল শিক্ষাকে আগের ১০+২ এই বিভাগের পরিবর্তে ৫+৩+৩+৪ করা হচ্ছে। দশম শ্রেণির বোর্ডের পরীক্ষা অবলুপ্ত হচ্ছে। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এই চার বছর আটটি সেমিস্টারে ভাগ করা হচ্ছে। এই আটটি সেমিস্টারের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে দশম আর দ্বাদশ শ্রেণির জন্য একটি মাত্র রিপোর্ট কার্ড প্রদান করা হবে। উচ্চ মাধ্যমিকে আলাদা কোনও বিভাগ থাকবে না। অর্থাৎ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি অব্দি মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সিস্টেম চালু হচ্ছে। নতুন শিক্ষানীতিতে বৃত্তিমূলক পড়াশোনাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতিকে সামনে রেখে স্কুল একত্রীকরণ (amalgamation) কিংবা উন্নীতকরন প্রক্রিয়া চলছে। যেহেতু হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল বলে এখন আর নাকি কিছু থাকছে না। নাম পরিবর্তন করে হচ্ছে সিনিয়র সেকেন্ডারি স্কুল। নতুন শিক্ষানীতিতে সাবজেক্ট টিচারদের আবার নাম বদল হচ্ছে। এখন থেকে তারা পিজিটি অর্থাৎ পোস্ট গ্র‍্যাজুয়েট টিচার। এই পিজিটিরা শুধু একাদশ আর দ্বাদশ শ্রেণিতে শিক্ষাদান নয়, নবম-দশম শ্রেণিরও ক্লাস করাবেন। কখনও প্রয়োজনে অন্য ক্লাসে পাঠদানে অংশ নিতে পারেন। নতুন শিক্ষানীতিতে স্কুল শিক্ষার বিষয় নির্বাচন ইত্যাদি ব্যাপারে পুরো ফ্রেমটা কী, এখন অব্দি পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়। স্কুল একত্রীকরণ প্রক্রিয়াটাই শুধু বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে চলছে। সঙ্গে এলপি থেকে হাইস্কুলের টিচারদের মধ্যে যাদের স্নাতকোত্তর বা অন্য প্রোফেশনাল ডিগ্রি আছে, তাদের ডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে। এরই মধ্যে শিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা হয়েছে এই ‘বিভ্রান্তিকর’ নোটিশ। আপাতদৃষ্টিতে যা বোঝা গেছে, তা হলো, যেহেতু হায়ার সেকেন্ডারির টিচাররা এখন পিজিটি হিসেবে পরিচিত, তাই তাদের এখন ক্লাস সিক্স থেকে পড়াতে হবে।

টেটের মাধ্যমে শিক্ষক নিযুক্তিতে এলপি স্কুলে টিচার সমস্যা মেটাতে যতটা সহায়ক হতে পেরেছে, ততটা হাইস্কুলে পারেনি। হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। যেহেতু হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক দরকার পড়ানোর জন্য। কিন্তু প্রায় প্রতিটি স্কুলে সব বিষয়ের শিক্ষক নেই। এলপি, এমই , হাই সেকশনের তুলনার হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনে টেটে নিযুক্তির সংখ্যা অনেক কম। এরমধ্যে প্রতি বছর রিটায়ার করছেন অনেক শিক্ষক। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, গত কয়েক বছরে প্রতিটি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা প্রচুর বেড়েছে। একেকটি ক্লাসে দুশ-তিনশ কিংবা এরও বেশি ছাত্রছাত্রী। পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ নেই, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষক। একেকটি স্কুল এখনও চলছে সেই স্কুল প্রাদেশিকীকরনের সময়ের টিচার আর শ্রেণিকক্ষের পরিকাঠামোকে নির্ভর করে। তাই ছাত্রসংখ্যা বাড়লেও শিক্ষক সংখ্যা বাড়েনি, শ্রেণিকক্ষও বাড়েনি। যার দরুণ ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ৩৫/৪০ ছাত্রছাত্রীর বিপরীতে ১ জন শিক্ষক, কোনও সরকারি স্কুলেই স্থান পাচ্ছে না। পরিকাঠামো ব্যবস্থাকে ঠিক না করেই নতুন শিক্ষানীতি চালুর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে কোনও শিক্ষাপদ্ধতি কি ছাত্রস্বার্থে সঠিক অর্থে বাস্তবায়িত হতে পারবে? সরকার এ দিকটাকে গুরুত্ব না দিয়ে সব দায় টিচারদের উপরই চাপিয়ে দিচ্ছে বারবার।

টিচারদের উপর যখনই যে দায় চাপানো হয়েছে, টিচাররা তা মেনে নিয়েছেন। কোনও স্কুলে যদি প্রয়োজনীয় অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার থাকে না হাই সেকশনে, সেই স্কুলে হায়ার সেকেন্ডারি সেকশনে যদি পর্যাপ্ত বিষয় শিক্ষক থাকেন, এই পরিস্থিতিতে হাইস্কুলের ক্লাসগুলো যদি একের পর এক শিক্ষকহীন থাকে, তখন কোনও বিষয় শিক্ষকই কমনরুমে বসে সময় কাটাবেন না। কোনও সরকারি নির্দেশেরও তখন তারা অপেক্ষা করবেন না। ক্লাসে শতাধিক ছাত্রছাত্রী শিক্ষকহীন থাকলে স্বাভাবিকভাবেই শোরগোল করবে, সেটা সামলানোর জন্য হলেও তারা যেকোনও ক্লাসে যাবেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, রাজ্যের ভুরি ভুরি সরকারি স্কুল আছে, যেখানে হায়ার সেকেন্ডারির বিষয় শিক্ষকরা নিজেদের বিভাগের দায়িত্ব পালনের সঙ্গে হাইস্কুল সেকশনে পড়ানোর সঙ্গে মেট্রিক কিংবা ক্লাস পরীক্ষারও দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। শুধুমাত্র নৈতিকতার দিকটি বিবেচনা করে।

কিন্তু শিক্ষা বিভাগ যখন একজন বিষয় শিক্ষককে ক্লাস সিক্স থেকে প্রতিটি ক্লাসে নিয়মিত পড়ানোর জন্য নির্দেশ দেয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্ন উঠে আসে। প্রশ্নগুলো হলো– এলপি, এমই, হাই, হায়ার সেকেন্ডারিতে নিযুক্তির জন্য পৃথক পৃথক টেট হয়। টেটে উত্তীর্ণ হলে শূন্যপদে নিযুক্তি হয়। পদমর্যাদার ভিত্তিতে বেতন কাঠামোও পৃথক। এখন থেকে যদি পিজিটিদের নিম্ন শ্রেণি বলতে ক্লাস সিক্স থেকে নিয়মিত পড়াতে হয়, তাহলে পিজিটি পোস্টের জন্য পৃথক টেটের প্র‍য়োজন থাকার তো কথা নয়। বেতন কাঠামোও পৃথক থাকার দরকার নেই। এমই বা হাই টেটেই হোক হায়ার সেকেন্ডারিতে বিষয় শিক্ষক নিযুক্তি। কারণ শিক্ষা বিভাগের দৃষ্টিতে সব পোস্টই সমমর্যাদার। তাছাড়া কোনও হাইস্কুল সেকশনে হয়তো হিন্দি, বিজ্ঞান কিংবা অংকের টিচার নেই। ওই স্কুলের ইংরেজি কিংবা বাংলা কিংবা পলিটিক্যাল সায়েন্সের বিষয় শিক্ষককে দিয়ে অংক-বিজ্ঞানের ক্লাস করানো, কিংবা হিন্দি পড়ানো কতোটা যুক্তিযুক্ত বা বাস্তবসম্মত? হাইস্কুলে অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার যারা স্নাতকোত্তর, বিএড ইত্যাদি ডিগ্রিপ্রাপ্ত, তারা কি আগামীদিনে কোনও অতিরিক্ত অ্যালাউন্স বা ভাতা বা পদোন্নতি ছাড়া রাজি হবেন নিয়মিত হায়ার সেকেন্ডারির ক্লাসে পড়াতে? যদি উত্তরটি না হয়, তাহলে বিষয় শিক্ষকদের উপর যে অতিরিক্ত দায় চাপানো হচ্ছে, সেগুলোর জন্য তাদের কোনও বিশেষ ভাতা দেওয়া হোক। বিষয় শিক্ষকদের ক্লাস সিক্স কেন, হয়তো আগামী দিনে ক্লাস ওয়ান থেকে পড়াতে বলা হতে পারে? কিংবা তাদের বাধ্য করা হতে পারে। আচ্ছা, কোনও সরকারি অফিসের কিংবা শিক্ষা বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তা বা অফিসারকে যদি বলা হয়, তাদের পদের দায়িত্বের সঙ্গে ওই অফিসের কেরানির দায়িত্বটিও নিয়মিত পালন করতে, তখন কি তারা এটাকে মেনে নেবেন? তারা কি এমন নির্দেশকে অপমানজনক মনে করবেন ? তারা কি এই নির্দেশকে যুক্তিযুক্ত আখ্যায়িত করবেন? যদি উত্তরটি না হয়, তাহলে কেন বিষয় শিক্ষকদের উপর এভাবে স্বেচ্ছাচারী নীতি-নির্দেশ চাপানোর প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে?

সরকারি স্কুলের শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে যে বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত, সেগুলোতে দৃষ্টি না দিয়ে শিক্ষকদের চরকিপাক খাওয়ালে কি অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে? সরকারের যা করনীয়, তা হলো সামগ্রিকভাবে স্কুলগুলোর পরিকাঠামো ব্যবস্থার সংস্কার করা, শিক্ষক-ছাত্র অনুপাতের সামঞ্জস্য আনা। তারপর প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনা। নয়তো কোনও শিক্ষানীতি, শিক্ষকদের উপর কোনও নিয়মনীতিই শিক্ষার মান পরিবর্তনে সমর্থ হবে না।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Close
Close

Adblock Detected

Please consider supporting us by disabling your ad blocker